জীবনানন্দ দাশের মনন ও সৃষ্টি নিয়ে , তাঁর মনোবিকলণ ও আত্মহত্যাপ্রবণতা নিয়ে কত যে চর্চা হয়েছে , তার বোধহয় ইয়ত্তা নেই । এই সব চর্চা বহুক্ষেত্রেই পূর্বনির্দিষ্ট তত্ত্বে খাপ খাওয়ানোর অপচেষ্টামাত্র ।
তারপরেও বলা যায় , এত ডায়নামিক চরিত্র বাংলা সাহিত্যে বিরল । প্রথমত , আমাদের দেশের কবি সাহিত্যিকদের প্রায় সবাইই জীবন নিয়ে রাখঢাক পছন্দ করতেন , আরোপিত ইমেজের ঘেরাটোপে বাঁচতে চাইতেন । আর দ্বিতীয়ত , তাঁদের নিয়ে যারা কলম ধরেছেন , তারাও প্রশস্তিগাথা রচনাতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন । এক অদ্ভূত চরিত্র জীবনানন্দ , যে তীব্র আকাঙ্খায় , দেহজতায় ‘মেয়েমানুষের ‘ কথা বলেছেন , শরীরের কথা বলেছেন , বোধ ও বিচ্ছেদের কথা বলেছেন , মৃত্যু ও আত্মরতির কথা বলেছেন , ঘেন্না ও ভালবাসা দিয়ে যুগপৎ জীবনকে এঁকেছেন !
জীবনানন্দের ‘ মাল্যবান’ উপন্যাসকে অনেকেই তাঁর আত্মচরিত বলে মনে করেন । সেখানে মাল্যবানের উদ্বেগ , আশঙ্কা , ব্যাক্তিত্বহীনতা, যৌনতা ও যৌনতার বিকৃতি বাধ্যতাধর্মীতার অপারগতা নিয়ে বারবার ফুটে উঠেছে । আত্মরতি যৌনবাসনা ও অক্ষমতার টানাপোড়েন মাল্যবান চরিত্রকে ক্ষতবিক্ষত করেছে আর লেখক অবলীলায় তা গ্রন্থিত করেছেন।
অবসেসিভ কমপাল্সিভ বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বমেহন ও সে সম্পর্কিত অপরাধবোধ ইবসেনীয় আত্মনির্যাতনের মতোই তাঁর জীবনেও এসেছে।
“মাল্যবান নীচে চলে গেল । নিজের বিছানাটা মন্দ লাগছিল না তার । মাল্যবানের মনে হল, মানুষের মন সারাটা দিন– রাতের প্রথম দিকটাও– বোকা হ্যাংলার মতো চায়– অপেক্ষা করে, সাধনা করে, যেন নিজের কিছুই নেই তার, অন্যে এসে দেবে তাকে, তবে হবে । কিন্তু গভীর রাতে বিছানায় শরীরই তো স্বাদ । শরীরটাই তো সব দেয় মানুষকে । মন কী ? মন কে ? মন কিছু নয় । বেশ নিবিড় শীতের রাতে চমৎকার শরীরের স্বাদ পাচ্ছিল মাল্যবান ।
পুরুষের সঙ্গে সংস্পর্শ ঘুচিয়েছে বটে উৎপলা ; কিন্তু তাই বলে শরীরের স্বাদের সঙ্গে নয় । দোতলায় গভীর রাতে তার নিজের বিছানায় আশ্চর্য স্বাদ উপলব্ধি করছিল সে ।”
আগের এপিসোডে বলেছিলাম , স্বমেহনজনিত অবসেশান দেহসম্পর্কে অপরাধবোধ জন্ম দিতে পারে (মনোসমীক্ষণ অনুসারে ) এবং দেহসত্তার অবসানকে বিকল্প হিসাবে ভেবে নেওয়ার অবচেতন ইচ্ছা জাগ্রত হতে পারে । আত্মহত্যা সম্পর্কিত জীবনানন্দীয় বোধকে আমরা ইবসেনীয় জীবন ও মৃত্যুর আকাঙ্খার দ্বন্দ্ব যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ঠিক সেভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারি । একগাছা দড়ি হাতে মৃত্যুমুখী হওয়া আর বুড়ি চাঁদকে বেনো জলে পার করে দেওয়ার পরস্পরবিরোধী ইচ্ছা দেহের আবদ্ধ অপরাধীসত্তা ও মুক্তসত্তার দ্বন্দ্ব হিসাবে দেখা যেতে পারে । ঠিক যেভাবে ইবসেনের অন্তর্দ্বন্দ্বকে মনোসমীক্ষকরা ব্যাখ্যা করেছেন।
শরীর , যৌনচাহিদা ও যৌনঅক্ষমতার দ্বন্দ্ব ইবসেনের মতই জীবনানন্দে দেখি আমরা যখন তিনি লেখেন , ‘ যৌনক্ষিদে আমার উদ্দীপনা জাগালো :তোমার সব হারিয়েছে ;তুমি কি আর সমর্থ হবে ! ‘ নারীশরীর তাই
‘ শরীরে ননীর ছিরি , ছুঁয়ে দেখো , চোখা ছুরি -ধারালো হাতির দাঁত
হাড়ের কাঠামো শুধু ‘
‘ সব বাসি , সব বাসি -একেবারে মেকি -‘
দেহ নিয়ে তাঁর এই যুগপৎ আকাঙ্খা ও ঘৃণা বারবার প্রতিফলিত হয়েছে :
“-কুড়ি একুশ বছরের মেয়েমানুষ ?
-হ্যাঁ , বেশ সুন্দরী ছিল , বেশ সোমত্ত । শবটাকে মাটি খুঁড়ে বার করার পরও গা ফুটে রূপ বেরোচ্ছে , আর গতরের সেকি পুষ্টতা
–এই জন্যই চুরি করা হয়েছিল -মাল্যবান বললে
মাল্যবানকে খুব বেশি জাগিয়ে দিয়েছে উৎপলা …সে রাতটা মাল্যবান আর উৎপলার
বেশ নিবিড় ভাবেই কাটলো । “
এই কথোপকথন নিঃসন্দেহে অদ্ভূত ! নারীশব নিয়ে এরকম যৌন ফ্যান্টাসি (Necrophilia ) DSM 5 (মনোবিদ্যার আধুনিক সর্বসম্মত ডায়াগনোস্টিক মানদণ্ড ) অনুসারে একটি প্যারাফিলিক অস্বাভাবিকতা (condition characterized by abnormal sexual desires, typically involving extreme or dangerous activities)। আর প্যারাফিলিয়ার সঙ্গে অবসেসিভ ধারণার সহগতি উল্লেখযোগ্য ।
DSM -5 অনুসারে প্যারাফিলিক চিন্তা থাকতে পারে এমন মানুষদের যাদের মধ্যে রয়েছে ‘ the wish to possess an unresisting and unrejecting partner ‘.
প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় যেন বারবার এসেছে তাঁর সৃষ্টিবিশ্লেষণে । মনোবিদ্যার গবেষক শাওনা সেনগুপ্ত ও তিন্নি দত্ত ২০১৫ সালে একটি জার্নাল পেপারে জীবনানন্দের ‘পঁচিশ বছর পরে’ কবিতার মনোবিশ্লেষণ করেন ॥ তাঁদের মতে , এই কবিতায় দয়িতার জন্য অপেক্ষা অথচ অপেক্ষাপূরণে ব্যর্থতা (এবং অনীহাও ) তাঁর need for affiliation ও rejection এর মধ্যে দ্বন্দ্ব । Activity এবং Passivity র মধ্যে দ্বন্দ্ব । এই passivity বা নিস্পৃহতা যা তাঁকে প্রেমিকার সঙ্গে মিলনের তীব্র ইচ্ছা সত্ত্বেও উদাসীনতায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে তা তাঁর ‘ প্রত্যাখ্যানের ভীতি’ থেকে উদ্ভূত । সময় চলে যায় , তিনি থাকেন প্রত্যাশী অথচ উদাসীন । ‘ কুড়ি বছর পরে ‘ কবিতায় কুড়ি বছরের অপেক্ষা আকাঙ্খার সঙ্গে অদ্ভূত ভাবে মিলেমিশে থাকে বিপরীতমুখী এক লাইন :
‘ কুড়ি বছরের পরে , তখন তোমারে নাই মনে ‘
এই অপেক্ষার তীব্রতা আমরা ‘ বনলতা সেন ‘ এও দেখি । যেখানে মিলন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পার্থিব নয় -অপার্থিব , চিরঅন্ধকারে সমাচ্ছন্ন, দেহভারহীন !
‘ ক্যাম্পে ‘ কবিতার জন্য অশ্লীলতার দায়ে পড়তে হয়েছিল কবিকে । আসঙ্গলিপ্সায় প্ররোচিত করে ঘাইহরিণীরা শিকারীর বন্দুকের কাছে নিয়ে আসছে হরিণদের :
‘একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে
সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে ‘
ঘাইহরিণী । এই শব্দটি আপত্তির কেন্দ্রস্থল । ঘাই একটি অসমীয়া শব্দ । অন্য পাখিকে ফাঁদে ফেলার জন্য টোপ হিসাবে ব্যবহৃত হয়
‘ ঘাই ‘ পাখি । ঘাই এর সঙ্গে হরিণী শব্দকে জুড়ে দিয়ে কমোত্তেজিত হরিণীর আকর্ষণীয় রূপকল্প তৈরি করেন তিনি যে হরিণী পুরুষ হরিণকে আকৃষ্ট করে -কিন্তু শেষপর্যন্ত মিলন নয় -মৃত্যু উপহার দেয় ।
‘ ঘুমোতে পারিনা আর
শুয়ে শুয়ে থেকে
বন্দুকের শব্দ শুনি ‘
প্রলুব্ধ ভাগ্যহত হরিণরা প্রতারিত হয় , প্রত্যাখ্যাত হয় , সংহার হয় । লেখক নিষ্ক্রিয় ভীত দর্শকমাত্র এই ঘটনার ।
ঘাইমৃগীর তীব্র আসঙ্গকামী ডাকের বিপরীতে জেগে থাকে নিষ্ক্রিয় কবির মৃত্যুভয় । তাঁর self এখানে দুটি সত্তায় বিভক্ত , কামাতুর প্রত্যাখ্যাত হরিণ , আর passive , ভীত দর্শক !
‘ শিকার ‘ কবিতাতেও ‘ সারারাত চিতাবাঘিনীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে ‘ সুন্দর বাদামি হরিণ এই ভোরের জন্য অপেক্ষা করেছিল’। কিন্তু তারপরই আসে সেই অক্ষরমালা ,
‘ একটা অদ্ভূত শব্দ
নদীর জল মচকা ফুলের পাপড়ির মতো লাল
আগুন জ্বললো আবার
উষ্ণ লাল হরিণের মাংস তৈরি হয়ে এলো ‘
কামনা ও প্রত্যাখ্যানের কি আশ্চর্য দ্বৈতসমাহার । ইরোস ও থ্যানাটোসের বিচিত্র লীলাময় বিবরণ ।
“স্থূল হরিণ শিকারীই শুধু প্রলোভনে ভুলিয়ে হিংসার আড়ম্বর জাঁকাচ্ছে না , সৃষ্টিই যেন তেমন এক শিকারী , আমাদের সকলের জীবন নিয়েই যেন তার সকল শিকার চলেছে , প্রেম , প্রাণ স্বপ্নের একটা ওলটপালট ধ্বংসের নিরবচ্ছিন্ন আয়োজন যেন সবদিকে” (আলেখ্য, ১৯৯৯)
সম্পর্ক তাঁকে প্রত্যাখান করেছে বারবার , আর রক্তমাংসকে পাওয়ার সুতীব্র ইচ্ছা ও বিপরীতমুখী প্রত্যাখ্যানভীতি তাঁকে করেছে ক্রমনিঃসঙ্গ । ক্রমশঃ passive যে
‘প্রকৃতি ‘ , তাকেই দয়িতা হিসাবে বেছে নিয়েছেন তিনি ।
প্রত্যাখ্যানের ভয় , সেই ভয় থেকে উদ্ভূত ঘৃণা , আত্মরতি , স্বমেহন , তৎজনিত অপরাধবোধ -আর তা থেকে সৃষ্ট আত্মহনন ও আত্মনির্যাতন চিন্তা । এক বিপন্ন বিস্ময় জন্ম হয় , যা গভীর রাতে দড়ি হাতে টেনে নিয়ে যেতে চায় , থ্যানাটোস আহ্বানে ।
শরীরের জালে আবদ্ধ মুক্তিকামী মানুষের যন্ত্রণা ইবসেনের মতোই তাই জীবনানন্দে দেখছি আমরা । কিন্তু জীবনানন্দের কাছে শরীরের অবসান অবশ্য কবরে বা শ্মশানে আবদ্ধ সমাপ্তি বা আত্মার পুনরুত্থান নয় , নক্ষত্রপুঞ্জ ও প্রকৃতিতে একাকার হয়ে যাওয়া । প্রচলিত অস্তিত্ববাদ , আত্মার পুনর্জন্ম ইত্যাদি নয় , শরীরের অবসান মানে অবসানই – এবং সেই অবসান প্রকৃতির সঙ্গে মিলনইচ্ছা , একাকার হয়ে যাওয়া –চিরমুক্তি নয় ।