জীবনানন্দের সিনেপসিস

জীবনানন্দের সিনেপসিস

আশিক মাহমুদ রিয়াদ 

বরিশালে বৃষ্টি মানেই সৃষ্টির অন্য রূপ এসে ধরা দেয় প্রকৃতিতে। সারাদিনের ব্যস্ত সময়, বৃষ্টিস্নাত ভরদুপুরে এসে ঝিমিয়ে পড়ে নিছক কোন অযুহাতে। সেরকমই একটি ভরদুপুরে, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চোখ গেলো দক্ষিণ দিকের পুরানো বাড়িটার দিকে।শ্যাওলা জড়িয়ে ঝুপ ঝুপিয়ে বৃষ্টিপাতে ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রাত্তিরে আঁধিয়ারে ওখান থেকেই ভেসে আসে হুতুম প্যাঁচাদের নির্লিপ্ত বিষণ্যতা। মাঠে জোড়া শালিকের ঘাঁস খাওয়া-খাওই আর গোসল। সাদা গরুটা তাদের কাছে আসতেই ফুরুৎ করে উড়ে গেলো সেই পুরনো বাড়িটার দিকে। বাড়িটা কাদের? কে জানে! নিচের সিমেন্টের রাস্তায় কে একজন পায়ের জুতা টানতে টানতে হেঁটে যাচ্ছে। আমার চোখ ভর্তি ঘুম~অফিস নেই, থাকলেও এই বাদলা দিনে হাফ ছুটি নিয়ে এসে ঘরে বসে থাকতাম নির্দ্বিধায়। বৃষ্টির দিনে আবার অফিস কিসের? বৃষ্টি শুধু শান্তির, বৃষ্টির দিনে কোন পুঁজিযুদ্ধ নয়। পাশের রুম থেকে ভ্যাঙোর ভ্যাঙোর গলায় সংবাদ পাঠক জানাচ্ছে সব এলোপাতারি যুদ্ধ আর কাঁচা বাজারে আগুনের বিভৎস সব খবর। চোখ দুটো ঘুমে জ্বলছে, তাও ঘুমাতে ইচ্ছা করে না। শান্তি অতিরিক্তের পর্যায় চলে গেলে মানুষ হালের বিপরীতে চলে যায়।

সন্ধ্যে বেলায় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি! মিষ্টির দোকান থেকে গরম তেলে ভাজা আর সাথে গরম দুটো রসগোল্লা পেটে দিয়ে একটি সিগারেট ধরিয়ে ফুরফুর করে টানছি। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, ছিটে ছিটে বৃষ্টি! ভাবলাম তার ডেরায় একবার হানা দেয়া যাক। রিক্সা নেব নাকি সিগারেটের সাথে একটা জর্দা-পান খেয়ে হাটা দেবো সেটা ভাবতে ভাবতে ভাবনার শেষ পর্যায়ে এসে রিকশাই নিলাম। উদেশ্য কবির বাড়ি! উনার সাথে ভোলা থেকে আসার পথে হুট করে দেখা। লঞ্চের কোণে দাঁড়িয়ে নদীপাড়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিলেন। সেদিন অবশ্য একটি কবিতা দেখিয়েছিলেন, দু একটা লাইন মনে করার চেষ্টা করলাম।

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে
চেয়ে দেখি ছাতার মতো ব্ড় পাতাটির নিচে বসে আছে
ভোরের দয়েলপাখি – চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ

কবির হাত ভালো। আমি সিগারেট বাড়িয়ে দিলাম, তিনি অবশ্য তা গ্রহণ করলেন না। চোখ বুজে কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বর্ষার পানিতে নদী টৈ-টুম্বুর। কচা, সন্ধ্যা, সুগন্ধা, কীর্তণখোলার ঐশ্বরিক সুন্দর নামের কালপ্রবাহে এ পানি কত জায়গাতেই যায়, গিয়ে মেশে বঙ্গোপসাগরে! সেখান থেকে কত সাগর মহাসাগরে! ভদ্রলোকের স্বভাব চারিতায় প্রকাশ পেলো তিনি কবি। কাব্যের প্রতি তার অদ্ভুত ঝোক আছে! তিনি জাদুকরের মতো সৌহার্ত্য লাইন এঁকিয়ে বেঁকিয়ে সৃষ্টি করতে পারেন; একদিন সান্ধ্য দাওয়াতে তার বাড়িতে গিয়ে খান কয়েক চটি খাতায় তার কবিতা পড়েছিলেন। তিনি অবশ্য তার কবিতা খুব বেশি কাউকে দেখাতে চান না !

এসব কিছু ভাবতে ভাবতে রিক্সা পৌছে গেলো কবির দরজায়। রিক্সা থেকে নেমে মাথাটা একটু নিচু করে চৌকাঠ পেড়িয়ে ঢুকতেই দেখলাম ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে তিনি মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখলেন, অভ্যর্থনা জানিয়ে আবার মনযোগ দিলেন খাতায়। আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে তার কার্যকলাপ দেখে বললাম, চলুন কীর্তণখোলে দর্শণ করে আসা যাক। একটু বাঁদেই চাঁদ উঠবে। তিনি আর বিলম্ব করলেন না, হিন্দু-পাড়া থেকে বেরোবার আগে টুং টাং ঘন্টা আর উলুধ্বনী বুকের ভেতর অদ্ভুত এক প্রলাপ সৃষ্টি করলো!

কীর্তণখোলা বয়ে যাচ্ছে, ছিটে ছিটে বৃষ্টি। আকাশে ছড়া ছড়া মেঘ! সূর্য্যের মতো করে থালার মতো চাঁদ উঠলো। বর্ষাকালে পূর্ণিমা দেখে অতন্ত্য মাদকতার ব্যাপার। কীর্তণখোলা ফুলে ফেপে টইটম্বুর! কবিকে জিজ্ঞেস করলাম, নতুন কি লিখছেন? তিনি কিছু বললেন না। নদীর জলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। নদীর মাঝখানটাতে জ্বলের ঘোল সৃষ্টি হয়েছে। চাঁদনি রাতে দিনের আলোর মতো পরিস্কার হয়ে উঠেছে সব। তিনি কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে থেকে বললেন, আপনার কাছে সিগারেট হবে? আমি মাথা নাড়িয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করে দিলাম। কবি বললেন জীবনটা নদীর ঐ জলের মতো গোলকধাঁধা! তিনি ফুঁড়ফুড় করে সিগারেট টানতে রইলেন । মৃদুবাতাস তার চুল দোলাচ্ছে শস্য ক্ষেতের মত। পেছন থেকে গরুর আওয়াজ শুনতে পেলাম, বাতাসের ঝাপটা বাড়লো। বৃষ্টির তোড়জোড়ও বোধয় বাড়লো। হঠাৎ করে কবিকে পাশে দেখতে পেলাম না! চোখ দুটো খুলে পরিস্কার হলো এটি বিভ্রম নেশাতুর স্বপ্ন ছিলো। উত্তর দিকে কালো মেঘ করে এসেছে। আকাশে রাক্ষসের মতো মেঘ করে এলে সমতলের সৌন্দর্য্যে ফিনিক ফোঁটার মতো ঝলে ওঠে। সবুজ মাঠের মাঝখান দিয়ে গরুটা ডেকে ডেকে হেটে হেটে যাচ্ছে পুরনো বাড়িটার দিকে। আমি অ্যাশ ট্রে থেকে আঁধখাওয়া সিগারেট টা জ্বালিয়ে স্বপ্নটার জাবর কাঁটছি। কীর্তণখোলার পূর্ণিমা সন্ধ্যায় জীবনবাবুর সিনেপসিস!

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
The Top 11 Traits Health Ceos Have in Common

The Top 11 Traits Health Ceos Have in Common

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
ভাষাশহিদ

ভাষাশহিদ

ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম বাংলা ভাষায় কথা বলার পেয়েছি স্বাধীনতা, লাল-সবুজ পতাকা পেয়ে ভেঙেছি পরাধীনতা। যুদ্ধ করে পেয়েছি আমরা নতুন এক দেশ, বিশ্বের বুকে ...
তুফান: শাকিবের নতুন রেকর্ড | দ্বিতীয় খন্ডে থাকবেন আমিন খান? Shakib Khan | Dushtu Kokil

তুফান: শাকিবের নতুন রেকর্ড | দ্বিতীয় খন্ডে থাকবেন আমিন খান? Shakib Khan | Dushtu Kokil

শাকিব খানের তুফান ঝড়ে যেনো উড়ে যাচ্ছে সব। তুফান সিনেমার মধ্য দিয়ে বাংলা সিনেমায় নতুন মাইলস্টোন ক্রিয়েট করতে যাচ্ছেন মেগাস্টার শাকিব খান। তুফান মুক্তির পর ...
কবিতা : অপলাপ

কবিতা : অপলাপ

ড.গৌতম সরকার ভেবেছিলাম আশ্বিনের ঝরা মেঘে বৃষ্টি হবে, হীরক কুচির ঘোর আলপনায় আমার দুয়ার,  উঠোন, কলতলা, তুলসীমঞ্চে লক্ষ্মী জেগে উঠবে, কোত্থেকে হিংসুটে একচিলতে হাওয়া  ভুঁইফোড় ...
মাতৃদেবতা

মাতৃদেবতা

শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ষোলোর পল্লী আর বিপ্লবী সংঘ। শৈশবের দূর্গা পুজোর কথা বললে প্রথমেই ভেসে আসে আমাদের পাড়া ঘরের এই দুই পুজো প্যান্ডেলের নাম। এরা উভয়েই ...
কালো গোলাপ 

কালো গোলাপ 

|মুহাম্মদ ফারহান ইসলাম নীল   বন্ধুদের সাথে অাড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরেছি ঠিক বারোটার সময় ৷ যদিও ফেরার ইচ্ছা ছিলনা ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে ফিরতে ...