আশিক মাহমুদ রিয়াদ
সেবার রুপাকে কাঁদতে দেখে আমি হেসেছিলাম। বার্ষিক পরিক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলো। আমি ফার্স্ট হলাম আর রুপা সেকেন্ড।সারাপথ ওকে ব্যঙ্গ করতে করতে বাড়িতে এলাম। বাড়িতে ঢুকেই কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’ফার্স্ট হয়েছিস দেখে মহাভারত শুদ্ধ করে ফেলিসনি বুঝেছিস! এত গর্ব করিস না।দেখিস একদিন তুই ফেল করে কাঁদবি। ‘ এই বলে রুপা ভেঁউ ভেঁউ করে কেঁদে ফেললো। আমি মুখ চেপে হাসতে হাসতে অট্টো হাসিতে ফেটে পড়লাম। আর রুপা ভেউ ভেউ করে কাঁদলো।
পরিক্ষার আগে রুপা বেশ অহংকার করে বলেছিলো,সে নাকি পরিক্ষায় ফার্স্ট হবে৷ আমাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছিলো। আমিও সেই চ্যালেঞ্জের জবাব দিয়েছি। ফার্স্ট হয়েছি। এবার আমার ভাব নেওয়ার পালা। আমার এই ভাব রুপার সামনে বেশিদিন নিতে পারলাম না। একদিন পথ দিয়ে আসার সময় রাস্তায় কলা রছোলায় পা দিয়েই হুড়ুম করে পা পিছলে পড়ে গেলাম। আশেপাশে তাকালাম। কেউ দেখেনি তো! ও মা ও বাবা বলে কাতরাতে কাতরাতে উঠলাম। হঠাৎ অট্টোহাসি ভেসে আসলো কানে। রুপা হাসলো! আমি ভ্যাবলার মতো কোমড়ে হাত দিয়ে বাড়ির দিকে হাটলাম।
রুপাদের বাড়িটা আমাদের বাড়ির পরেই৷রুপার বাবা আর আমার বাবা এক অফিসে চাকরী করেন। দুজনের বেশ ভালো বন্ধুত্ব আছে৷ ঈদ, পূজোতে আমরা আনন্দ ভাগাভাগী করি।
২.তখন ক্লাস টেনে পড়ি। মন সবে মাত্র আকুপাকু করছে। এতদিনে বুঝে নিয়েছি রুপাকে আমার ভালো লাগে৷ তাই সুযোগ পেলেই লুকিয়ে রুপাকে দেখি। রুপা যখন গোসল করে এসে বেলকুনিতে কাপড় শোকা দেয় তখন দেয়ালের আড়াল থেকে দেখি ওকে। একদিন দেখতে গিয়ে হক চকিয়ে গেলাম। কে যেন কান টান দিলো! ব্যথায় চিৎকার দিয়ে উঠে দেখলাম রুপা। দাতে দাত পিষে বলল,’কি দেখিস? কানটা মলে দেব? ‘এই বলে কান মোচড় দিলো। আমি ব্যথায় কাঁকিয়ে উঠলাম।
দিন গড়ালো, মাস পেড়লো।স্কুল থেকে কলেজে উঠলাম। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পরিক্ষা দিলাম।রুপার সাথে আমার সম্পর্ক প্রেমে গড়ালো। ভার্সিটিতে চান্স পেলাম। রুপার সাথে আমার ফোনে কথা বলাবলি চলতে থাকলো। গরমের দিনে কাথা মুড়ি দিয়ে কথা বলতাম, গরমে সিদ্ধ হয়ে যেতাম।
সেবার,দূর্গা পূজা উপলক্ষে গোটা এলাকা বর্নিল লাইটিং দিয়ে সাজানো হয়েছে৷ ছাদের সিড়ি ঘরে আমি আর রুপা লুকিয়ে কথা বলছি।
-রুপা! তুই এত সুন্দর হলি কিভাবে?,’বললাম আমি।
-রুপা মুচকি হেসে বলল,’সুন্দর হয়ে বুঝি দোষ করেছি?’
-হ্যা! দোষ তো অবশ্যই করেছিস।আমার মন কেড়ে নিয়েছিস যে!
-রুপা ভেঙচি কেটে বলল। উঁহ্! আদিখ্যেতা।
-আমি রুপার দিকে এগোলাম। রুপা পিছনে পা বাড়ালো। ছুবি না আমাকে৷ মন্দিরে যাব! একদম ছুবি না।রুপা দৌড় দিয়ে বসলো। ওর খোপা নাচলো। পায়ের নুপুর ঝুনঝুন করে বেজে উঠলো। আর এদিকে আমার মন ধুপধুপ করে মাদল বাজিয়ে তুলল।
৩.
রুপাকে আবার কাঁদতে দেখলাম। হঠাৎ করেই রুপার বাবা মারা গেলেন। রুপা হাউমাউ করে কাঁদলো। রুপার মাকে আর রুপাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে আমার মাও কাঁদলো। বাবাকে বিষণ্য মুখে বসে থাকতে দেখা গেল।মাগরিবের নামাজ শেষে, সন্ধ্যে বেলায় বাবার চোখ থেকেও জল গড়ালো। সেদিন রায়ে রুপা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলো হাউমাউ করে। আমি রুপার কান্না দেখে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম।
গোধূলীর সময় কেন যেন দারুন মন খারাপ হয়৷ আজ রুপার বিয়ে, বিয়ের জন্য সব আয়োজন করেছেন আমার বাবা। সামনের রাস্তাটায় বর্নিল সব আলোকসজ্জা।বাবার পাশাপাশি আমাকেও সাহায্য করতে হয়েছে।আমি আমার রুমে বসে আছি। চারদিকে অন্ধকার। মশা ভন ভন করছে।জানলা থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসে ঠোট শুকিয়ে আসছে।গলা শুকিয়ে আসছে৷ মাথা জুড়ে চিন্তা শুরু হলো,’সবে মাত্র ভার্সিটিতে একটা বছর পাড় করেছি। আমাদের দুটো পরিবার যেন একসুতোয় গাঁথা।
তাছাড়া রুপার ধর্ম আর আমার ধর্ম….ভাবতেই কেন যেন ভয় হয়। হারানোর ভয়! রুপাকে কি আমি হারিয়ে ফেলছি?
রুপার বাবা মারা যাওয়ার পরে। রুপাদের পরিবারের দায়িত্ব নেন বাবা।আজ রুপার বিয়ের দায়িত্বটাও তিনি নিয়েছেন। রুপার বাবার কথা মতো সব তিনি করছেন।
সেদিন বিকেলে সিড়িঘরে রুপার সাথে দেখা করতে পেরেছিলাম। রুপা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলো তখন।নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছিলো। হোস্টেলে বসে যখন শুনলাম রুপার বিয়ে ঠিক হয়েছে;বুকটা তখন ধড়াম করে উঠেছিলো।যেন আকাশ থেকে পড়েছি;আর পায়ের নিচে মাটি নেই৷ রুপা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’চল পালিয়ে যাই!’ আমি ভ্যাবলার মতো ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিস্তব্ধে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওর সামনে। হঠাৎ গালে ঠাস করে একটা চড় দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,’আজ থেকে আমার আশেপাশে আসবি না।আমার দায়িত্ব যখন নিতে পারবি না তখন ভালোবেসেছিলি কেন আমাকে?’ রুপা হন হন করে হাটা দিলো। আমি রুপাকে ডাকতে চাইলাম। পারলাম না।
সময় বয়ে চলে গেল। রুপাদের বাড়ি থেকে ঢাক ঢোলে আওয়াজ ভেসে আসলো কানে। শঙখ আর উলু ধনি কানে আসলো৷ আমি জানলাটা দিয়ে তাকিয়ে রইলাম রুপাদের বাড়ির দিকে৷
রুপা কি এখন আমাকে নিয়ে ভাবছে, নাকি নতুন জীবনের আয়োজনে সে নিজেকে সাজাচ্ছে অতীতের ধুলে ঝেড়ে ফেলে? কে জানে!