Uncategorizedঅণুগল্পগল্পছোট গল্পজীবনের গল্পপ্রথম পাতাবাংলা গল্পসর্বশেষসাপ্তাহিক সংখ্যা

ছোটগল্প- চশমা

লেন্স খুলে পড়া চশমার ফ্রেমটা নিয়ে কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে খুটুরখাটুর করার পর শেষমেশ মুখটা ব্যাজার করে ভদ্রলোক বললেন, ‘ না দাদা, এ জিনিস মিউজিয়ামে রেখে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করবার নেই। ফ্রেমের দুকোণা একেবারে ক্ষয়ে গিয়ে…! কোনো লেন্সই আর বসানো যাবে না…তবে…।’
‘ তবে? ‘
লম্বামতো সরু পিন জাতীয় কিছু দিয়ে লেন্সটাকে সেট করার একটা শেষ চেষ্টা করবার পর হাল ছেড়ে দিয়ে পূর্বেকার কথার রেশ টেনে তিনি বললেন,’ ভ্যালুয়েবল জিনিস! কোত্থেকে পেলেন?’
সেকথা সত্যিই কোনোদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। বাবাও নিজে থেকে কিছু বলেন নি। শৃঞ্জয় শুধু আজন্মকাল দেখে এসেছে বাবাকে চশমাটা ব্যবহার করতে।
‘ এই ক্ষয় ধরে যাওয়া আদ্যিকালের চশমাটা আর তোমাকে ব্যবহার করতে দেবো না বাবা। ‘
বলেছিল শৃঞ্জয়। যেদিন লেন্স টা ফ্রেম থেকে ঠক করে খুলে পড়ে গেল।
বাবার চোখ তখন নিবিষ্ট মনে কাঁচটাকে পরীক্ষা করতে ব্যস্ত। কোথাও ফাটেনি তো? না ফাটে নি। কিন্তু…।
‘ ঐ যা…জোড়া দেওয়া যাবে তো রে…? এ চশমাটার সাথে জড়িয়ে কত ইতিহাস আছে জানিস? সোনালি রঙটা এখনো এক ফোঁটা চটে নি। ‘
শৃঞ্জয় ফ্রেমটা হাতে নিয়ে একঝলক তাকিয়ে দেখেছিল মাত্র। কথাটা ঠিকই। ফ্রেমের গায়ে খুদি খুদি অক্ষরে কি একটা কোম্পানির নামও লেখা রয়েছে। ব্যাস,এইটুকুই দেখেছিল।
‘ একটু যাস না বাবা দোকানে। চশমাটা ঠিক করে আনিস…দৃষ্টি অপটিক্যালেই যাস। ঐ যে, পাশের কাউন্টারে ঘড়ি বিক্রি করে…চেনা দোকান…ছেলেটা আমার ছাত্র… এর আগে ঘড়ি সারিয়েছি। ঠিক করে দেবে।  ‘
বাবার গলায় কিসের যেন আবেগ।
‘ সে তো যাবো। কিন্তু তুমি এই সেকেলে নকশা করা চশমাটা সারিয়ে কী করবে শুনি? আবার চোখে দেবে? তুমি না সত্যিই ব্যাকডেটেড বাবা।’
বলেছিল শৃঞ্জয়।
দোকানদারের হাল ছেড়ে দেওয়া কথায় যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস পেল শৃঞ্জয়। মনস্থ করেছিল, এ চশমা আর ঠিকই করাবে না। কিন্তু দোকানদার আবার বাবার ছাত্র। কোনোসময় যদি রাস্তাঘাটে দেখা হয়..?
….’কোত্থেকে পেলেন… ‘ ভদ্রলোকের প্রশ্নের জবাবে শুধু ছোট্ট করে হেসে বলেছিল শৃঞ্জয়, ‘ রশিদ পুর স্কুলের অংকের স্যার বিনয় বাবুর ছেলে আমি…. ওঁরই ব্যবহৃত চশমা
‘ আপনি স্যারের ছেলে! আগে বলবেন তো…খুব শৌখিন প্রকৃতির মানুষ আমাদের স্যার। স্কুলে দেখতাম ঠিক এরকম শীতের সময় একটা মকমলের নকশা কাটা কাশ্মীরি শাল গায়ে জড়িয়ে আসতেন স্যার। কোনোদিন কোট,প্যান্ট। আর ঠিক এই চশমাটাই পড়ে থাকতেন। তাই ভাবছিলাম খালি, কোথায় যেন এমন চশমা আমি দেখেছি…কারণ এই অদ্ভুত নকশা করা ফ্রেম এ তল্লাটে কোথাও আজ পর্যন্ত দুটো খুঁজে পাই নি…বুঝলেন না…তাই আর কি..।’
পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ বিনয় বাবু বাড়ির নীচতলার খোলা বারান্দায় চেয়ারে বসে একমনে তাকিয়েছিলেন  গায়ে লাগানো পাঁচিলের ওপারে পড়ে থাকা ইঁট পাথরের  ধ্বংসস্তূপের দিকে। নগেন গুহর দোতলা বাড়িটার কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। খোলা আকাশের নীচে তাকিয়ে রয়েছে প্রোমোটারের কাছে বাঁধা পড়া দশ কাঠা জমি।
‘ বাবা..’ বলে সামনে এগিয়ে গেল শৃঞ্জয়।
ফিরে তাকালেন বিনয় বাবু।
‘ কিছু করা গেল না। এতই পুরনো যে ফ্রেমটাই ক্ষয়ে গেছে। তোমার জন্য শোরুম থেকে একটা ভালো চশমার অর্ডার দিয়েছি। একেবারে নিউ মডেলের রিমলেস। কিন্তু তোমাদের বয়সের সাথে দারুণ মানানসই। শুধু এ বেলাটা ওয়েট করো। ওবেলায় লেন্সটা ফ্রেমের সঙ্গে সেট করে ওরা দিয়ে দেবে বলেছে। ভালো অ্যান্টিগ্লেয়ার গ্রীণ কাঁচ লাগাতে বলেছি আমি। তাই একটু সময় চেয়েছে আর কি। ‘
ক্ষয়ে যাওয়া চশমার প্রান্ত দুটোকে হাতে নিয়ে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন বিনয় বাবু।
‘ লেন্স আর গ্লাস দুটো হঠাৎ আমার নজরে পড়ে গেল বাবা…এত সুন্দর অ্যারিস্ট্রোকেট ডিজাইনের..! কতদিন আর এই পুরনোটা চোখে দেবে…সেই আমার জন্ম থেকে দেখে আসছি এ চশমা!’
সামনের বিরাট ফাঁকা জমিটার দিকে ইতিউতি তাকিয়ে স্নেহভরে ছেলের হাতখানা ধরে  বিনয় বাবু বললেন,’কলকাতায় ম্যাকিনটস কোম্পানিতে আমি আর নগেন চাকরি করছি তখন। সেখান থেকেই আলাপ, পরিচয়, বন্ধুত্ত্ব, পাশাপাশি জমি কেনা, বাড়ি করা। একদিন দুজনে ঘুরতে ঘুরতে  রাসেল স্ট্রিটের এক বহু পুরোনো অকশন মার্কেট থেকে “স্পেক্টাকুলার আই” নামে জার্মান কোম্পানির তৈরি নকশা করা দুটো চশমা কিনে ফেললাম। একেবারে ঝকঝকে, স্টেইনলেস, কেতাদুরস্ত চশমা…শুনেছিলাম   স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত ভারতে এ চশমা মাঝে মাঝে আমদানি হতো সাহেবসুবোদের জন্য। সেকেন্ড ওয়াল্ড ওয়ারে জার্মানি ডিফিটেড হওয়ায় ও দেশের ইকনমির সাথে সাথে কোম্পানির মনোপলি চশমার ব্যবসা ভীষণ রকম ধাক্কা খায়…তারপর একসময় প্রোডাকশান বন্ধ হয়ে কোম্পানি উঠেও যায়। এই হলো ইতিহাস। কেন জানি না, ইতিহাসের গন্ধের প্রতি একটা টান বরাবরই আমার ছিল। হয়তো নগেনেরও ছিল। তার সঙ্গে অবিশ্যি হাতে টাকাও ছিল। হুবহু একই ডিজাইনের দু’দুটো চশমা দুজনে মিলে কিনে নিলাম অকশনে। সেদিন থেকে পাড়ায় একটা নতুন  নামও হয়ে গেল আমাদের… “মানিক জোড়”। কতকালের কথা সেসব…!’
মুখের আগায় আলগা একটা হাসির রেখা যেন চিকচিক করে উঠলো বিনয় বাবুর।
একটা ভেঙে যাওয়া চশমাকে ঘিরে সময়ের স্রোতে হঠাৎ করে ভেসে আসা এক নতুন ইতিহাস ক্রমশই ঘিরে ধরছিল শৃঞ্জয়ের মনকে। নগেন কাকুর সঙ্গে বাবার হৃদয়ের সম্পর্কের কথা যতখানি তার জানা,ঠিক ততটাই যেন অজানা পুরনো এই গন্ধ।
বউমা রঞ্জিতার এনে দেওয়া চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অন্যমনস্ক চিত্তে বলে চলেন বিনয় বাবু, ‘ যখনকার কথা এসব,তখন কি আর নগেন জানতো নিজের হাতে তিলতিল করে গড়ে তোলা বাড়িটা একদিন ধূলো হয়ে মিশে যাবে ওরই অবর্তমানে…জানলে নিশ্চই আমায় বলতো ছেলেদের শলা পরামর্শের কথা…. আমার কাছ থেকে সাজেশনও হয়তো চাইতো। ম্যাকিন্টস ছেড়ে কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে যতই বাড়ির কাছে স্কুল মাস্টারীর মতো আরামের চাকরিতে জয়েন করি না কেন, আত্নীক সম্পর্ক কি কখনো ঘুচে যায়…। কথা নেই বার্তা নেই, একদিন  হুট করে চলে গেলি…!’
চায়ের খালি কাপটা আস্তে আস্তে চেয়ারের পাশে সরিয়ে রাখেন বিনয় বাবু। পাঁচিল ঘেরা জমিটার চারপাশে ঘুরে বেড়ানো দৃষ্টিতে এক অদ্ভুত শূণ্যতা। আবার অনেক কিছুর বার্তা।
শৃঞ্জয় তাকিয়ে আছে। কি যেন বলতে চায় বাবা।
‘ একদিন চশমা দেখে লোকে আমাদের “মানিক জোড়” বলতো। এখনো বোধহয় জড়িয়ে রয়েছে শব্দ দুটো..কোথাও না কোথাও। এই আলো,হাওয়া বাতাসের সঙ্গে…। ঠিক যেভাবে জড়িয়ে রয়েছে ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া সেদিনকার বাড়িটা… ছায়া হয়ে…।’
আলো কমে এসেছে। শেষ বিকেলের কোণে কোণে গোধূলির অভিমানের সুর ভারি হয়ে আসছে ক্রমে। জমি জুড়ে তিলতিল করে গড়ে তোলা বাড়ির পুরনো ইঁট,কাঠ, পাথরের ভগ্নস্তূপ….ভাঙা কাঁচের আয়না, তুলো ওঠা ফেলে দেওয়া সোফা, কাঠের পায়া ভাঙা চেয়ার, ভাঙা টিন, অ্যাসবেস্টাস, অক্ষত টিউবওয়েল, লাল সিমেন্টের আলপনা আঁকা তুলসীমঞ্চ….ইতিউতি ছড়ানো স্মৃতির অবশিষ্টাংশ। সকাল বেলাতেও বাড়ির একতলার বৈঠকখানার খানিকটা অংশ কোনোক্রমে মাথা উঁচু করে অস্তিত্ব টুকু বাঁচিয়ে রেখেছিল। ওপাশের শিমূল গাছের দীর্ঘতর ছায়া ঘিরে রয়েছে জায়গাটাকে এখন শুধুই। মিস্ত্রি মজুরের দল ফিরে যাচ্ছে দিনের কাজ সেরে, জোট ভেঙে, যে যার মতো।
‘বাবা…’
ডাকলো শৃঞ্জয়।
একটা হাত জড়িয়ে রয়েছে বাবার পিঠে।
বউমা এসে চাদরটা জড়িয়ে দিল শ্বশুর মশাইয়ের গায়ে। হাওয়া আসছিল। দূরে ঝিলপার বেয়ে শুনশান ফাঁকা জমির ওপর দিয়ে।
‘ জানিস খোকা, কিছুই পড়ে থাকে না জীবনে।সময়, মানুষ, দিন, অনুভব…কিছুই না। অনেক স্বাদ করে তৈরি করেছিল নগেন দোতলার ঘরটা। ওর বউ কাঁচা প্লাস্টার গুলোয় রোজ বালতি টেনে টেনে জল দিত৷ নগেনের ছোট বউমা তুলসী তলায় শাঁখ বাজিয়ে সন্ধ্যে দিত। গাছটা কেমন নুইয়ে পড়েছে। প্রাণ শুকিয়ে গিয়েছে।’
বাবার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে শৃঞ্জয়। দাঁড়িয়ে রয়েছে  বউমা রঞ্জিতা।
ধীরে ধীরে ছেলের মুখের দিকে তাকান বিনয় বাবু।
‘ বুঝলি খোকা, তোরা পারলে এ বাড়িটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করিস। ঐ ইঁট,কাঠ,পাথরগুলোকে দেখতে দেখতে নিজের বাড়িটাই যেন আজ বড় ভেসে উঠছে বারবার চোখের সামনে। বড় ভেসে উঠছে….পুরনো চশমাখানার কাঁচে।’
এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

ছাইলিপির কথা

লেখালিখি ও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার চেষ্টা খুবই সহজাত এবং আবেগের দুর্নিবার আকর্ষণ নিজের গভীরে কাজ করে। পাশাপাশি সম্পাদনা ও প্রকাশনার জন্য বিশেষ তাগিদে অনুভব করি। সেই প্রেরণায় ছাইলিপির সম্পাদনার কাজে মনোনিবেশ এবং ছাইলিপির পথচলা। ছাইলিপিতে লিখেছেন, লিখছেন অনেকেই। তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি লেখা মূল্যবান। সেই মূল্যবান লেখাকে সংরক্ষণ করতে লেখকদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কোন লেখার মধ্যে বানান বিভ্রাট থাকলে সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। ছাইলিপি সম্পর্কিত যে কোন ধরনের মতামত, সমালোচনা জানাতে পারেন আমাদেরকে । ছাইলিপির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ছাইলিপির নতুন সংযোজন ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল Chailipi Magazine। সাবস্ক্রাইব করার আহ্বান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]