অণুগল্পআরওগল্পজীবনের গল্পসর্বশেষসাপ্তাহিক সংখ্যা

ছোটগল্প – প্রাপ্তির হাসি

তাসফির ইসলাম ইমরান 

বৃদ্ধাশ্রমের আরো একটি ঘর বুকিং হয়েছে আজ। সেই সাথে ফাঁকা হয়েছে একটা বাড়ির অপ্রয়োজনীয় উচ্ছিষ্টের মতো কোনো একজন প্রবীণ। এক সময় পুরো সংসার আগলে রাখা কোনো একজন আজ পরিনত হয়েছে সংসারের অপ্রয়োজনীয় উচ্ছিষ্টে। সাদা শাড়ী পরা মাথায় পাকাচুলের মাঝে দুয়েকটা অধপাকা চুলের সংমিশ্রণ, বয়সের ভারে শরীরটা নুইয়ে পড়েছে। চেহারায় স্পষ্ট মলিনতার ছাপ তবুও তা ঢেকে রাখার ব্যার্থ চেষ্টা চালিয়ে একটা হাতে লাঠি নিয়ে টুক টুক শব্দে বৃদ্ধাশ্রমের দিকে এক পা দুই পা করে এগিয়ে আসছে রহিমা বেগম । আরেকটা হাত ধরে আছে তার একমাত্র আদরের সন্তান শিমুল। যেই হাতটা শিমুলের আদর্শ অনুপ্রেরণা আর তাকে গড়ে তোলার কারিগর সেই ভরসার হাতটার মালিককেই আজ এই বৃদ্ধাশ্রম নামক ঘরটাতে রাখতে এসেছে । ছেলেটা বড্ড বড়ো চাকরি করে, ঘরে নানান মানুষের আনাগোনা সেখানে এই বৃদ্ধা মা বড্ড বেমানান তাকে নিয়ে একপ্রকার ইতস্তত বোধ করে । বৃদ্ধাশ্রমের ঘরটাতে রহিমা বেগমকে রেখে শিমুল এগিয়ে যাচ্ছে পথে রাখা গাড়িটার দিকে। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রহিমা বেগম, চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো এই বুঝি বর্ষা নামবে।

সন্তান জন্মের ১ বছর পর স্বামীহারা হন রহিমা বেগম। একমাত্র ছেলের মাঝেই খুঁজে পান স্বামীর একটুকরো অস্তিত্বকে।রহিমা বেগম নিজের হাতে সংসারের হাল ধরেন, দারিদ্রতা আর অভাবের আঁচ বেশ ভালোই পেয়েছিলেন। তবে সব কিছুকে উপেক্ষা করে সন্তানকে আগলে রাখেন দারুণ মমতা দিয়ে, একটু একটু করে গড়ে তুলেন সমাজের উপযুক্ত একজন হিসেবে। আজ হয়তো তার প্রতিদানই পেলেন রহিমা বেগম। তাতে কি তার এই একজীবনে না হয় অসীম স্নেহ ভালোবাসার বিনিময়ে একটু অবহেলা আর অবজ্ঞাই পেয়েছে এতেই তার জীবন সার্থক।

২.
শিমুলের গাড়িটা বৃদ্ধাশ্রম পিছনে ফেলে শহরের পিচ ঢালা রাস্তায় এগিয়ে চলছে বাড়ির দিকে। শহুরে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ে চারদিকে গাড়ির যান্ত্রিক আওয়াজ আর দুপরের কাঠফাটা রোদের মাঝে হাজারো কর্মব্যাস্ত মানুষের আনাগোনা। কেউ হয়তো আচার হাতে আবার কারো হাতে বাদাম । গাড়ির ভেতরে হয়ে বসে শিমুল তাকিয়ে দেখছে চারদিকের মানুষের কর্মব্যাস্ততা,আর ভাবছে কত মানুষের জীবিকা এই ট্রাফিক জ্যামের উপর নির্ভরশীল। সব কিছু ছাপিয়ে একটা দৃশ্যে তার চোখ আটকে গেলো।

একটা মধ্য বয়স্কা পাগলি ছুটে বেড়াচ্ছে ৫ টা টাকা ভিক্ষার জন্য অন্য ভিক্ষুকদের থেকে একদম আলাদা সে, একবারের বেশি দুইবার টাকা চায় না কারো কাছে । কেউ তাকে ভিক্ষা না দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছিলো তবুও সে থেমে নেই একজনের পর একজনের কাছে যাচ্ছে, তার চোখ জলে টলমল করছে । ক্ষুধার্ত পেটটা দেখে মনে হচ্ছে দুইদিন কিছু খায়নি। খালি পায়ে গরম কড়াইয়ের মতো উত্তপ্ত রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সে। এবার শিমুলের গাড়ির দিকে এগিয়ে এসে স্বভাবতই টাকার জন্য হাত পাতলো পাগলিটা। শিমুল গাড়ির গ্লাসটা নামিয়ে ২০ টাকার একটা নোট পাগলিটার হাতে দিলো। টাকাটা পেয়ে পাগলিটা একমুহূর্ত দেরি না করে চলে গেলো ফুটপাতের চায়ের দোকানে। শিমুল তাকে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছিলো সে ভেবেছিলো হয়তো ক্ষুধার্ত তাই খেতে গিয়েছে। কিন্তু পাগলিটা দোকান থেকে একটা বনরুটি আর কলা নিয়ে এগিয়ে গেলো ফুটপাতের এককোনায় বসে থাকা রুগ্ন বাচ্চাটর দিকে। রুটি কলা বাচ্চাটার হাতে দিয়ে পাগলিটা যুদ্ধ জয় করা যোদ্ধার মতো এক টুকরো যুদ্ধ জয় করা হাসি দিলো যেটা অমূল্য।

জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে গাড়ি চলতে শুরু করেছে হালকা গতিতে, এর মাঝেই শিমুল খেয়াল করলো এখন আর পাগলি আর কারো কাছে টাকা চাচ্ছে না স্থির হয়ে বসে আছে আর মলিন মুখে লেগে আছে তৃপ্তির হাসি। কি যেনো ভেবে হঠাৎ শিমুলের চোখ থেকে দুফোঁটা অশ্রু বিসর্জন হলো আর বলে উঠলো ড্রাইভার গাড়ি ঘুরাও।

আমি মাকে আনতে যাবো!

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

ছাইলিপির কথা

লেখালিখি ও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার চেষ্টা খুবই সহজাত এবং আবেগের দুর্নিবার আকর্ষণ নিজের গভীরে কাজ করে। পাশাপাশি সম্পাদনা ও প্রকাশনার জন্য বিশেষ তাগিদে অনুভব করি। সেই প্রেরণায় ছাইলিপির সম্পাদনার কাজে মনোনিবেশ এবং ছাইলিপির পথচলা। ছাইলিপিতে লিখেছেন, লিখছেন অনেকেই। তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই ওয়েবসাইটের প্রতিটি লেখা মূল্যবান। সেই মূল্যবান লেখাকে সংরক্ষণ করতে লেখকদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। কোন লেখার মধ্যে বানান বিভ্রাট থাকলে সেটির জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি। ছাইলিপি সম্পর্কিত যে কোন ধরনের মতামত, সমালোচনা জানাতে পারেন আমাদেরকে । ছাইলিপির সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ। ছাইলিপির নতুন সংযোজন ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল Chailipi Magazine। সাবস্ক্রাইব করার আহ্বান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]