সে বার গন্তব্যস্থল ছিলো কুসুমপুর।শীতের শেষে, ঋতুরাজ বসন্তের আগমন।কলেজের সাময়িক ছুটিতে হোস্টেল থেকে বাবা-মায়ের অনুমতি নিয়ে চললাম কুসুমপুর।অপার (অপরাজিতা)দাদার আমলে জমিদারি ভাবটা ছিলো বলে,এখন কেমন আর জমিদার বাড়ি দেখার ইচ্ছেতে সাত ঘন্টার যাত্রা শেষে পৌছালাম।আমাদের যাওয়ার খবর শুনেই অপার বাবা ঘাটের রাস্তায় গাড়ি পাঠিয়েছিলেন।প্রত্যক্ষ করলাম বেশ রাজকীয় ব্যাপার সেখানে।বড় বাড়ি,বাগানের পরিচর্যায় নিয়োজিত তিনটে মালি,শান বাধানো পুকুর ঘাট,এছাড়াও বসার ঘরে পুরোনো দিনের হাত পাখা আর রেশমী কাপড়ের পর্দা।যদিও অপার বাবা অনেক ঘসা-মাজা করেছেন এ বাড়ির, তবুও বাবার স্মৃতি রক্ষার্থে বিশেষ কিছু চিহ্ন রেখেছেন।আমাদের যে ঘরে থাকতে দেওয়া হলো, সেটা ছিলো অতিথিসালা।বেশ বড় ঘর।একটা গ্রামোফোন ও আছে।নিলু(নিলয়) বল্ল অপার দাদা বেশ শৌখিন ছিলেন।
সন্ধ্যাবেলা।অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি বলে অপার মা আমাদের রাতের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিতে বললেন।খাওয়া শেষে বেলকনিতে দাঁড়িয়েছি, দেখলাম রুপোলী থালার মতো পূর্ন চাঁদ উঁকি মারছে পূর্বাকাশে। আধার কেটে শুভ্র আলোর পরশ বুলিয়ে জ্যোৎস্নায় আলোকিত হলো চারিদিক। এক মোহময় রুপ মূহুর্তে আমার মনে দোলা দিলো।
অপা বল্ল পুকুরপাড়ে আরও সুন্দর পরিবেশ।পুকুরের বাধানো সিড়িতে পানির খুব কাছে বসলাম। পা ভিজিয়ে জ্যোৎস্না বিলাস। নীল ঐ আকাশের বুক চিরে যেনো জ্যোৎস্না চুয়ে পড়ছে।চারিদিকের শান্ত বাতাস মনকে পুলকিত করছে বারেবার।নিলু গান ধরেছে ,
ও চাঁদ, সামলে রেখো জোছনাকে
নিলুর কন্ঠ চমৎকার। কলেজেও শুনেছি বেশ কয়েকবার গান।
প্রকৃতির এই নীরব হাতছানি যেনো কোন এক রুপকথার রাজ্যে টানছে আমাদের। আমি আর অপার পুকুরের পানিতে পা দুলাচ্ছি আর নিলুর সাথে গলা মিলিয়ে গান গাইছি। রুপোলী চাঁদ যেনো আজ পুকুরের পানিতে ভাসমান। যে দু-একটা মাছ লাফাচ্ছে, স্বচ্ছ আলোয় যেনো তা চকচক করছে।
চারিদিকে সুনশান-নিস্তব্ধতা। দূর থেকে গ্রামোফোনের গান ভেসে আসছে।অপা বল্ল তার বাবা রাতে খাবার পর বেলকনিতে চেয়ার পেতে ঘন্টা দু-এক গান শোনে।দক্ষিণের ঘর হওয়াতে ক্ষীণ আওয়াজ আসছে।
নিলু একের পর এক গান বলে যাচ্ছে। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি আর মাঝে মাঝে তাল দিতে গলা মিলাই।
আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে,
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে…
রবী ঠাকুরের গান।পুকুরের পানির শব্দ, নিস্তব্ধ বাতাসের সাথে তিনজনে গলা মিলিয়ে তাল দিচ্ছি। জ্যোৎস্নার উপচে পড়া স্নিগ্ধতা রাত বাড়ার সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।মাঝে-মাঝে শুভ্র মেঘের দল লুকোচুরি খেলছে চাঁদের সাথে।হৃদয়ের কোণে লালিত বাসনার পরিতৃপ্তিতে আনন্দিত মন। অপার কন্ঠে চলছে,
ও চাঁদ,সামলে রেখো ।
জোছনাকে,কারো নজর লাগতে পারে
অজানা গন্তব্যের মেঘেদের মতো আজ কোথাও হারিয়ে যেতে মন চাইছে।আজ হারিয়ে যেতে নেই মানা।
কিন্তু করার নেই কিছু।রাত গভীর হওয়ায় অপার মা ডেকে পাঠান।যে সুধা মনকে ব্যাকুল করে তুলেছিলো, তা আস্বাদনে যে কয়েকদিন ছিলাম রোজ যেতাম পুকুরঘাটে।জ্যোৎস্নালোকিত চাঁদের সংস্পর্শে আকাঙ্ক্ষার পরিতৃপ্তি পেতাম।