জোবায়ের রাজুর দুটি গল্প

জোবায়ের রাজুর দুটি গল্প

অকৃজ্ঞ 

রিনা খালাকে মাঝে মাঝে আমার আধা পাগল মনে হয়। মাঝে মাঝে কি সব অদ্ভুত আচরন করেন। এ বয়সে তার নাকি শখ হল নাচ শেখার। মা তো এই ঘটনা শুনে হেসে খুন। অট্টহাসি দিয়ে মা বললেন ‘তোকে পাবনা পাঠাতে হবে।’ মায়ের কথায় নিজেকে অপমানিত বোধ করে রিনা খালা রাগ করে নিজের বাসায় চলে গেলেন।
রিনা খালা না আমাদের আত্মীয় না আমাদের কাছের কেউ। বছর খানেক আগে আমাদের পাশের বাসায় ভাড়া উঠবার পর থেকে আমাদের পরিবারের সাথে রিনা খালার বেশ সখ্যতা। বয়স আমার মায়ের বয়সের কাছাকাছি বলে আমি তাকে খালা ডাকি। ভীষণ আদর করেন আমাকে। মাঝে মাঝে টাকাও দেন। দু’চার দশ টাকা নয়, একেবারে একশ টাকার কচকচে নোট।
রিনা খালা উদার মনের হলেও আমার মা তাকে দু চোখে দেখতে পারেন না। অবশ্য আমার মা একটু শক্ত মনের। পরের উপর বিশ্বাস জিনিসটা মায়ের একদম নেই। এ কারনে বাবার সাথে মায়ের খুব একটা বনিবনা হয় না। দুজনের ঝগড়া যখন চুড়ান্তে, বাবা তখন মাকে বলেন ‘রাগারাগি বন্ধ করো বলছি। নয়তো আমার ঘর থেকে এক্ষুনি বের হও।’ মাও তখন দৃঢ় কণ্ঠে বলেন ‘আরেকটা বিয়ে করার সুযোগ তোমাকে কখনো দেব না।’
রিনা খালার সাথেও মায়ের টুকটাক ঝাশেরা হয় মাঝে মাঝে। ব্যাপারটা তদন্ত করতে গেলে দেখা যায় সব মায়ের। এই তো সেদিন রিনা খালা আমাদের কিচেনে ঢুকে গ্যাসের চুলা বন্ধ করে দিয়ে বলল ‘এভাবে চুলো জ্বালিয়ে রাখবেন না ভাবি। গ্যাসের অপচয় হয়।’ মা রেগে মেগে আগুন হয়ে বলল ‘তোর সমস্যা কি ডাইনি? এখান থেকে ভাগ বলছি। নয়তো পাছায় লাথি খাবি।’ চোখ কপালে তুলে রিনা খালা বলল ‘খারাপ কি বললাম!’ এতেই মা দৌড়ে এসে রিনা খালার গালে কষে এক চড় মারলেন। কান্না চেপে রিনা খালা চলে যেতে যেতে বললেন ‘এখানে আর কখনো আসব না।’
এ অভিমান পর্ব বেশীদিন চলেনি। এ ঘটনার তিনদিন পর দুপুরে খেতে বসে দেখি মা ভুনা মাংশ আমার প্লেটে দিলেন। বললাম ‘বাবা আজ মাংশ কিনেছে?’ মা হেসে বলল ‘না। পাশের বাসার রিনাটা দিয়ে গেছে। জানিস মেয়েটা কত্ত ভালো। গরুর মাংশের আজকাল যা দাম। কে কাকে মাংশ দেয়? আজকের নামাযের মোনাজাতে রিনার জন্যে দোয়া করব।’ মায়ের কথায় আমি অবাক হলাম। এত পাষাণ আমার! দুদিন আগে যাকে চড় মেরে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে, আজ তার মাংশ খেয়ে তার জন্য প্রার্থনা করবে? রিনা খালাও যে কি! খেয়েছে চড়। খাওয়াচ্ছে ভুনা মাংশ। দুজনই অদ্ভুত।
ভুনা মাংশ খাওয়ানোর তিনদিন পর আমাদের বাসায় এসে রিনা খালা দেখেন মা সোফায় বসে বিলাপ করে কাঁদছেÑ‘ও আল্লাহ গো। আমার বড় আপার অবস্থা খারাপ। হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে দুলা ভাই। টাকার খুব অভাব। আপার ছেলেগুলি বউ নিয়ে আলাদা থাকে। মায়ের কোন খবরই নেয় না ওই শুয়োরগুলি। কি হবে আমার আপার?’ এই শোকে কাতর হয়ে রিনা খালা এক দৌড়ে বাসার চলে গেলেন আর মিনিট পাঁচেক পর তিন হাজার টাকা এনে মায়ের হাতে দিয়ে বললেন ‘কিছু মনে করবেন না ভাবি। এই টাকাগুলি আপনার আপাকে দিয়ে বলবেন যে এগুরি রিনা দিয়েছে। উনি আমাকে চিনেন। শেষবার যখন এখানে এসেছে, আমাকে খুব আদর করেছে। আমি নাকি দেখতে পরীর মত।’ রিনা খালাকে জড়িয়ে ধরে মা চেঁচিয়ে বললেন ‘তোর এ উপকারের কথা মনে থাকবে বোন। বিপদে আমার আপার পাশে এসেছিস।’
সন্ধ্যায় আগে রিনা খালার দেয়া টাকাগুলি মা কার মারফতে যেন বড়খালাদের ওখানে পাঠিয়ে দিলেন।
২.
চারমাস পরের ঘটনা। সকাল সাড়ে এগারটার দিকে রিনা খালা উন্মাদের মত আমাদের বাসায় ছুটে এসে মাকে বলল ‘ভাবি, আমার হাজব্যান্ড অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। সব টাকা আলমারিতে। চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার কাছে পাঁচ হাজার টাকা আছে? ধার দেন তো! হাসপাতালে যেতে হবে।’ মা পানের খিলি মুখের ভিতর ভরতে ভরতে বললেন ‘ঘরে তো একটা পয়সাও নেই। ইশ, এই অভাবের দিনে এসেছিস!’ মায়ের জল জ্যান্ত মিথ্যা কথাটি শুনে আমি অবাক হলাম। বাবা পরশুদিন তার বেতনের পুরো পনের হাজারই মায়ের হাতে তুলে দিয়েছে দেখলাম। সিন্দুকের ভিতর সে টাকা মা ভরে রেখেছে যতনে।
ধার চেয়েও টাকাটা পাবে না জেনে রিনা খালা হাল ছেড়ে দিয়ে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি বললাম ‘খালা আপনি সেদিন নিচতলার দারোয়ানকে দুই হাজার টাকা ধার দিয়েছেন। তার কাছে গিয়ে দেখেন তো টাকাটা পান কিনা।’ চমকে উঠে রিনা খালা বলল ‘তাইতো! নাসিরকে যে টাকাগুলি দিলাম। মনেই নেই।’ বলে রিনা খালা সিঁড়ি কাঁপিয়ে নিচতলায় ছুটে গেল।
মাকে বললাম ‘মা, টাকাটা তো ছিলই। তুমি রিনা খালাকে ধার দিতে পারতে তে। রনিা খালার উপর কি তোমার কোন বিশ্বাস নেই?’ মা ডাইনীর মত শাষনের সুরে বলল ‘চুপ থাক। কিসের বিশ্বাস! সব সমস্যার মূল হচ্ছে মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করা।’ আমি হা করে মায়ের দিতে তাকিয়ে ভাবি আমার মা কত অকৃজ্ঞ।

কলঙ্ক 

ফুলে ফুলে অপরুপ সাজে সজ্জিত বাসর ঘরের এত দামী খাটে বসে আছে মুমু। সৌরভের সাথে বিয়েটা আজই, হঠাৎ বিয়ে যাকে বলে। এই তো, সপ্তাহ খানেক আগে প্রস্তাবটা এসেছে সৌরভের পরিবার থেকে। দু পরিবারের জানা শোনার উপর ভিত্তি করে আজ বিয়েটা ফাইনাল।
খুবই উঁচু ঘরের ছেলে সুদর্শন সৌরভকে স্বামী হিসেবে পেয়ে মুমু মনে মনে ভীষণ খুশি। অবশ্য রুপের দিক থেকে মুমুও কম যায় না। বেশ নজর কাড়া চেহারা মুমুর। তা না হলে সৌরভের বাবা মা কিভাবে সাধারণ একজন স্কুল শিক্ষকের মেয়েকে তাদের ঘরের একমাত্র পুত্রবধু করে শহরে নিয়ে আসবেন।
শেরওয়ানিতে রাজকুমারের মত দেখতে সৌরভ রাত সাড়ে এগারটায় বাসর ঘরে এসে মুমুকে প্রথম যে কথাটি বলল, সেটি হলÑ তোমাকে আমার জীবনের একটি সত্য কথা জানতে হবে মুমু।’ মুমু চুপচাপ নিরব ভূমিকা পালন করে বেনারশির দীঘল ঘোমটায় পরাজিত সৈনিকের মত কেবল বসেই রইল। এমনিতেই বিয়ের প্রথম রাত। সেই সংশয়ে সে অস্থির।
সৌরভ স্বাভাবিক গলায় বললÑ‘মুমু, তোমার পরিবারের কাছে একটি সত্য গল্প গোপন রেখে আজ আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমি আগেও একটি বিয়ে করেছি মুমু।’ একি শুনল মুমু! কি বলছে তার নিজের মানুষটি! ভুল বলছে না তো!
সৌরভ আবারো স্বাভাবিক গলায় বলল তিন বছর আগে মাধবীর সাথে বিয়ে হয়েছে আমার। সৌরভের কথা শুনে মাথায় যেন বাজ পড়ল মুমুর। মানুষটা কি তামাশা করছে, না সিরিয়াস! বাসর রাতে কেউ স্ত্রীর সাথে প্রথমে এভাবে তামাশা করে। তারপরও মুমু মনে মনে ধারনা করল তামাশাই হবে।
কিন্তু সৌরভ তরতর করে পরের কথাগুলি বলে যাচ্ছেÑ‘জানো মুুমু, আমার কারণে মানবী আত্মহত্যা করেছে। সব দোষ আমার। কারণ একাধিক নারীর সাথে আমার অবৈধ সম্পর্ক মন থেকে মানতে পারেনি মাধবী।’
একি বলছে সৌরভ! এ কোন পরিবেশের মুখোমুখি মুমু! সৌরভ যেভাবে বলছে, এটা তামাশা হতে পারে না। সত্যিই। কিন্তু এ কেমন সত্যি! সৌরভের একাধিক নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক মানে কি! সে কি নারী আসক্ত! বাবা মা তাকে এ কার হাতে তুলে দিল? কোথায় ভুল হয়েছে যেন!
মুমুর এমন নিরব ভূমিকা দেখে সৌরভ আবারো বললÑ‘জানি তোমার খারাপ লাগছে মুমু। আমি চেয়েছি বিয়ের আগে তোমার পরিবারকে আমার এই গোপন কলঙ্কের কথা জানাতে। কিন্তু বাবা মা রাজী ছিলেন না তোমার পরিবার যদি তোমাকে বিয়ে না দেন, সে ভয়ে।’
সৌরভের কথায় মুমুর এবার সত্যি চোখে জল চলে এলো। সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় মুমুর মাথা থেকে ঘোমটা সরে যাবার পর সৌরভ মুমুর চোখে সে জল দেখে মনে মনে ভেঙ্গে পড়ল। একটা নিষ্পাপ মেয়েকে এভাবে ঠকানো তার উচিত হয়নি। মুমুর চোখের জল ক্রমশ গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে। এটার জন্য সৌরভের অতীতের কলঙ্ক অধ্যায়ই দায়ী। আর কিছু নয়।
মুমুকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে সৌরভ তার পাশে বসে অনুনয় সুরে বললÑ‘এই তোমার হাত ছুঁয়ে কথা দিলাম আমি আর আজে বাজে নারীদের সাথে খারাপ সম্পর্ক রাখব না। পড়ালেখার জন্য অনেক বছর বিদেশে থেকেছি তো, সে কালচারে জড়িয়ে গেছি। কিন্তু স্বামীদের বাজে অভ্যাস বাঙালী মেয়েরা কখনো মানে না। মাধবী আমাকে সেটা দেখিয়ে দিয়েছে। আমি তোমায় নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাই মুমু।’
চুপচাপ বসে আছে মুমু। সৌরভ যে ভুল করেছে, সে ভুলের মাশুল দিয়ে গেল মাধবী। এখন সৌরভ যেহেতু নিজের জীবনের ভুল বুঝতে পেরেছে, তাকে অনায়াসে ক্ষমা করে দেয়া যায়। ভুল থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়। সৌরভও সে শিক্ষা পেয়েছে। তাদেরকে সে শিক্ষা দিতে হয় মাধবীদের। মুমু মনে মনে সৌরভকে ক্ষমা করে দিল, যেহেতু মানুষটি তার ভুল বুঝতে পেরেছে।

আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
অচিনপুরের দেশে: একাদশ পর্ব

অচিনপুরের দেশে: একাদশ পর্ব

পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় এবং গৌতম সরকার পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় মৃত্যুকে আর ভাবতে ইচ্ছে করেনা “মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান”৷ মৃত্যুর কালো ছায়ার বিস্তার পৃথিবী জুড়ে। তার ...
নেই, কোথাও কেউ

নেই, কোথাও কেউ

জোবায়ের রাজু গ্রাম থেকে শহরে এসেছে দিদার। ভর্তি হয়েছে শহরের নামকরা একটি কলেজে। এই শহরে থাকার মত দিদারের কেউ নেই। তাই সে বন্ধুদের সাথে মেসে ...
The Top 11 Traits Health Ceos Have in Common

The Top 11 Traits Health Ceos Have in Common

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
 শহরের আর্তনাদ | কবিতা

 শহরের আর্তনাদ | কবিতা

|নাঈমুর রহমান নাহিদ   থালার মত চাঁদ গিলে খাচ্ছে রাতের আধার পুরো শহর নিস্তব্ধ, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নির্ঘুম চোখে, নীরব রাতে নিস্তব্দধ পথে হেঁটে চলেছি ...
7 Answers to the Most Frequently Asked Questions About Automobile

7 Answers to the Most Frequently Asked Questions About Automobile

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
অচিনপুরের দেশে: অষ্টম পর্ব

অচিনপুরের দেশে: অষ্টম পর্ব

পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় এবং গৌতম সরকার  গৌতম সরকার অনিশ্চিতপুর কোনো জাদু রাজ্য নয়। এখানে প্রবেশদ্বারে কোনো জাদুকর দাঁড়িয়ে থাকেনা যে আহুত-অনাহুত-রবাহুত আগন্তুকের গায়ে জাদুদন্ড বুলিয়ে তাদের ...