জোবায়ের রাজু
অধিকার
কাশিপাড়ায় আসতে আসতে বেলা বারোটা বেজে গেল। আমি যাবো কাশিপাড়ার খান বাড়িতে। এটা অবশ্য আমার বাবার বাড়ি। কিন্তু আমি এখানে থাকি না। আমি থাকি মায়ের সাথে নানাজানের রসূলপুরের বাড়িতে। বাবার সাথে মায়ের ডিভোর্স হয়েছে সেও অনেকদিন হল। তারপর থেকে মায়ের সাথে আমার বেড়ে উঠা।
খান বাড়িতে ঢুকার পর প্রথমে দেখলাম দাদাজানকে। তিনি এই ভরদুপুরে উঠানের রোদে চেয়ার পেতে বসে আসেন কেন কে জানে। দাদাজান চোখে খুব একটা দেখেন না। বাড়িতে কেউ এসেছে, এটা টের পেয়ে দরাজ কণ্ঠে বললেনÑ‘কে!’ আমি বিনীত গলায় বললাম ‘দাদা, আমি আবির।’ আমার পরিচয় জেনে দাদাজান পকেট থেকে মোটা হাইপাওয়ারের চশমা বের করে চোখে পরে বললেনÑ‘আমার দাদু ভাই! আমার দাদু ভাই।’
তারপর আমার আগমনের খবর সারা খান বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লো। চাচি জেঠি থেকে শুরু করে চাচাতো বোন জেঠাতো বোন সবাই এসে হুড়মুড় কান্ড পাকিয়ে ফেলল। আমি লাজুক দৃষ্টিতে সবাইকে দেখছি। ছোট চাচি আমাকে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলো। ছোট্ট একটা ছেলে, সম্ভবত আমার চাচা জেঠা কারো সন্তান হবে, সে কচি কণ্ঠে বললÑ‘উনি ই আবির ভাইয়া?’ ছেলেটাকে আমার বেশ মায়া হল। কি সুন্দর চোখ দুটো।
সব শেষে এলেন আমার দাদিজান। তিনি ব্যাকুল হয়ে কান্না জুড়ে দিলেন। আমার খানিকটা বিরক্তও লাগলো। এতো কান্নাকাটির কি আছে! আমি তো এই বাড়িরই সন্তান।
এই বাড়িতে আমি আরও একবার এসেছি। অনেক বছর আগে। তখন ভাদ্রমাস ছিল। খানবাড়িতে অনেক তাল গাছ। দাদিজান আমার সামনে গরম গরম তালের পিঠা এনে বললেন ‘সব খাবি।’
ছোট চাচি আমার হাত ধরে নিয়ে গেলেন খানবাড়ির প্রকান্ড ঘরের পেছনের দিকে। যেখানে আম গাছের সাথে পায়ে শিকল বেঁধে রাখা হয়েছে একজন মাঝবয়সি মানুষকে। চাচি বললেন ‘উনি তোমার বাবা। সালাম দাও।’ আমি সালাম দেয়ার আগেই বাবা নামের মানুষটা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বললেন ‘এই ছেলে কে? খানবাড়িতে এই ছেলে ঢুকলো কিভাবে? ছোট বৌ, দা দিয়ে এক কোপে ওর মাথা ফালাই দাও। সাহস কত। খানবাড়িতে আসে।’ চাচি ভীতু গলায় বললেন ‘ভাইজান, ও আবির। আপনার ছেলে।’ চাচির কথা লোকটি শুনতে পেলো কিনা বুঝতে পারলাম না।
সবাই মিলে আমাকে নিয়ে এলো খানবাড়ির অবিজাত ঘরে। বিশাল ঘর। সোফায় আমার পাশে বসে আছেন দাদাজান। পাশে দাদিজান। বাকিরা চারপাশ ঘিরে ধরেছে। এই মধ্যে যুবতী বয়সের যে মেয়েটি আমার জন্য লেবুর শরবত নিয়ে এলো, সেও রাজ্যের কৌতুহল নিয়ে আমাকে দেখছে। পাশ থেকে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে, চিনি না, প্রশ্ন করলোÑ‘তোমার মা কেমন আছে?’ সংক্ষেপে জবাব দিলাম ‘ভালো।’ দাদিজান কাঁপা গলায় বললেনÑ‘বৌমার ডান পায়ের হাঁটুর পেইনটা এখনো উঠে?’ ছোট্ট করে বললামÑ‘মাঝে মাঝে উঠে।’ সোফার পেছন থেকে শিমু নামের একটা মেয়ে, সম্ভবত আমার কোন চাচাতো বোন টোন হবে, সেও বললÑ‘জেঠি আম্মা নাকি ভালো ছবি আঁকেন, তাই না ভাইয়া?’ আমি লেবুর শরবতের গøাসের দিকে তাকিয়ে বললামÑ‘অনেকের কাছে শুনি মা নাকি ছবি আঁকতেন। কখনো দেখিনি।’ আমার মাকে নিয়ে আরো কত জনের কত প্রশ্ন। কত জিজ্ঞাসা।
আমার অবাক লাগছে। যে খানবাড়িকে গুরুত্ব না দিয়ে আমার মা চিরদিনের জন্য এ বাড়ি থেকে চলে গেছে, সে খানবাড়িরই মানুষের কত আগ্রহ আমার মাকে নিয়ে। এরা কি সবাই মাটির মানুষ!
কোন এক আশ্বিন মাসে খানবাড়ির বউ হয়ে এসেছিলেন আমার মা। আমার জন্মের তিন বছর পর বাবার মানষিক সমস্যা দেখা দেয়। কোন ডাক্তারই বাবাকে শেষ পর্যন্ত সুস্থ করতে পারলেন না। একজন পাগলের সাথে ঘর করা যায় নাÑএমন প্রত্যয় নিয়ে মা আমাকে নিয়ে চলে গেলেন তার পিতার রাজ প্রাসাদের মত বাড়িতে, যেখানে বড় হতে থাকলাম আমি। বাবাকে ডিভোর্সের পর মা আর বিয়ে করেননি।‘ডিভোর্স’ নামের নির্মম নিয়তির কাছে দুজন মানুষ আলাদা হয়ে গেল।
না না, খানবাড়িতে এসে আমি এসব ভাবতে চাই না। সারা জীবন তো এসব ভেবে ভেবে কষ্ট পেয়েছি। ঘরের পেছন থেকে শিকল বাঁধা বাবার উঁচু গলার বিশ্রি ভাষায় গালি শোনা যাচ্ছে। মানষিক ভারসাম্য এই মানুষটির এই বাড়িতে ভালো চিকিৎসা হয় কি না, জানি না। এটা ভাবতে গিয়ে কেন জানি আমার চোখে পানি চলে এলো।
আগামি মাসে প্রাইভেট কম্পানিতে আমার চাকরি হবে। ভালো মাইনে। আমি এই খানবাড়ি থেকে তখন বাবাকে নিয়ে যাবো। শহরে তার চিকিৎসা করাবো। উন্নত চিকিৎসায় তাকে ভালো করাবো।
যে মানুষটি পাগল হয়ে গেছে বলে স্ত্রীর ভালোবাসার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, পায়ে শিকল পরার মত দুঃভাগ্যের ভাগিদার হয়েছে, আমি তার পাশে দাঁড়াবো। আমি তার সেবা করবো। সেবায় সেবায় তাকে ভালো করে তুলবো। সন্তানের কাছে এটাই তো একজন বাবার অধিকার। সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না খানবাড়ির এই পাগল মানুষটি। আমি আজ থেকে সবাইকে বলে বেড়াবো খানবাড়ির এই পাগল মানুষটি আমার বাবা। আমাকে তিনি জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু নিয়তি তার কাছ থেকে আমাকে আলাদা করে দিয়েছে।
অতীত
টিকেট বিক্রির একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে আমি টিকেট কিনেছি। তাও একেবারে শেষ টিকেটটা। ভাগ্য ভালো আজকের দৈনিকে ন্যাশনাল ক্লাবের সংগীত সন্ধ্যার টিকেট বিক্রির নিউজটা চোখে পড়েছে। সেখানে প্রকাশিত নাম্বারে কল করে শেষ টিকেটটা কিনেছি। সংগীতে আমার সেভাবে কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু এই একক সংগীত সন্ধ্যায় বিখ্যাত গায়ক মাশুক আলী গাইবে বলে আমি টিকেট কিনে সে একক সংগীত সন্ধ্যার দর্শক হতে রাজী হয়েছি।
আজকের এই যে স্বনামধন্য গায়ক মাশুক আলী, দেশ জোড়া যার কোটি ভক্ত, অসংখ্য পুরষ্কারে ভূষিত, বছরের বেশিরভাগ সময় যার বিদেশ শো তে সময় কাটে, সে আমার শুধু প্রিয় শিল্পীই নয়, আমার বাল্যবন্ধুও। একই নিভৃত পল্লীতে আমাদের বেড়ে উঠা।ক্লাসে আমরা পাশাপাশি বসতাম। পড়ায় সেভাবে মেধাবী না হলেও মাশুক গান করত দুর্দান্ত। গানের জন্য সারা স্কুল জুড়ে তার সুনাম। যে কোন সংগীত অনুষ্ঠানে মাশুকের ডাক ছিল বাধ্যতামূলক। আমাদের স্কুলের সত্যবাবু স্যার বলতেন ‘ও আমার দেশের মাটি গানটার সুর ধরতো..।’ মাশুক তখন তার দরাজ গলা ছাড়লেই পুরো ক্লাস নিরব হয়ে যেত।
সখ্যতাটা আমার সাথে বেশী ছিল বলে অনেকে আমাদেরকে ‘মানিক জোড়’ বলত। আর্থিক দিক থেকে মাশুকের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না বলে আমি মাঝে মধ্যে তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতাম। লজ্জায় টাকা নিতে চাইতো না বলে আমি জোর করে তার হাতে টাকা ভরে দিতাম।
সে বছর পাড়ার এক গানের অনুষ্ঠানে মাশুকের অপূর্ব গলাটা কানে লেগেছিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত এক চিত্রপরিচালকের। মাশুককে তিনি ঢাকায় নিয়ে গেলেন এবং তার একটি সিনেমায় গাওয়ার সুযোগ দিলেন। গান রিলিজ হওয়ার পর রাতারাতি হিট মাশুক।
অনায়াসে সংগীত ভুবনের একজন হয়ে উঠে সে। বদলে যায় তার পুরো পরিবারের জীবন ধারা। শহরবাসী হয়ে উঠে মাশুকের পরিবার। গ্রামের সাথে জন্মন্তরের বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়।
মাশুককে মিস করতে থাকলাম আমি। ব্যস্ততা তাকে এতই গ্রাস করে রাখে যে গ্রামে আসার সুযোগই পায় না। রোজ রেডিওতে তার গান শুনতাম। টেলিভিশনেও দেখতাম একান্ত টক শো তে। তাকে দেখে বোঝা যেত সে এখন আর অভাবে নেই। লাখ টাকার মালিক হয়েছে। সমাজে পরিচিতি পেয়েছে একজন গায়ক হিসেবে।
২.
দর্শক সারিতে আমি বসে আছি। এক্ষুণি শুরু হবে মাশুক আলীর একক পরিবেশনা। মঞ্চে তার আসার অপেক্ষায় দর্শক ¯্রােতা। অপেক্ষায় আছে মিউজিশিয়ানরা।
নীল পাঞ্জাবী পরে মাশুক আলী মঞ্চে উঠতেই করতালি পড়ে গেল। এতটা বছর পর স্বয়ং মাশুক আমার সামনে। বুক খাঁ খাঁ করে উঠল। একবার খুব ইচ্ছে হল দর্শক সারি থেকে উঠে গিয়ে মাশুককে জড়িয়ে ধরে বলি ‘দোস্ত আমি তোর গান শুনতে নয়, তোকে দেখতে এসেছি। পনের শ টাকা দিয়ে টিকেট কিনেছি।’
সুরের জলসায় মেতে উঠল মাশুক। একে একে তার জনপ্রিয় গানগুলি সব গেয়ে যাচ্ছে। আমার বার বার চোখ ভিজে আসে। আমার বন্ধুর গলায় এক আশ্চর্য সুর দিয়েছেন ¯্রষ্টা। এই যে সবার পছন্দের গায়ক মাশুক আলী, সে আমার বাল্য বন্ধু। কি ভাগ্য আমার।
৩.
আয়োজন শেষের দিকে। মাশুক মঞ্চ থেকে নামতে চেয়েও নামতে পারছে না। ভক্তরা তাকে ঘিরে ধরেছে। নানান প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ভক্তদের ক্যামেরার ফ্লাশ লাইটে পোজ দেয়ার এলাহী কান্ড বেশ চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আমার। উপচে পড়া ভিড় ঠেলে আমার সারা মন মাশুকের সমুখে যাবার তাড়নায় পাগল পারা। না, কোনভাবেই তার মুখোমুখি হওয়া যাচ্ছে না। এত এত ভক্তের ঢল। বিজলীর মত ক্যামেরার আলো ঝলসে উঠে সেকেন্ডে সেকেন্ডে।
অবশেষে অনেক সাধনার পর কাঙ্খিত মানুষটার মুখোমুখি হবার সুযোগ পেলাম। কণ্ঠে রাজ্যের ব্যাকুলতা এনে বললাম ‘দোস্ত, আমি বাবু। চিনতে পেরেছিস?’ চেহারায় চিন্তার ভাঁজ এনে সে বলল ‘কোন বাবু জানি?’ উৎফুল্ল গলায় বললাম ‘তোর বাল্য বন্ধু। ওই যে বারাহী নগর গ্রামে আমরা বেড়ে উঠেছি।’ খুব স্বাভাবিক গলায় মাশুক বলল ‘ও আচ্ছা। একটু একটু মনে আছে। ছবি তুলবেন? আসেন পাশে দাঁড়ান। আমার খুব তাড়া। অন্য একটা প্রোগ্রাম করতে হবে।’ আমি নিথর গলায় বললাম ‘ইয়ে মানে…।’
ধাক্কার মত খেলাম মাশুকের কথায়। এত বছর পর আমাকে দেখে সে কোন আগ্রহী ভাব দেখালো না। লজ্জায় মুখ লুকাতে চাইলাম। আমি তার সাথে ছবি তুলতে আসিনি। এসেছি অনেক দিনের লালিত মানুষটাকে দেখতে। যার সাথে এক সময় আমরা বন্ধুত্ব ছিল।
গানের জলসা শেষে সবাই যার যার গন্তেব্যে ধাবিত। আমার চোখের সামনে দিয়ে দামী গাড়িতে করে চলে গেল মাশুক, যে অতীত ভুলতে বসেছে, অথবা ভুলে যাবার ভান ধরেছে।
সে এখন আমার বাল্য বন্ধু মাশুক নয়। গায়ক মাশুক আলী। শিল্পী জীবনের প্রাচুর্য, খ্যাতি আর আবিজাত্যে বাস করতে করতে অতীত ভুলে যাওয়া একজন গায়ক মাশুক আলী।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।