কে যেন দরজায় কড়া নাড়ছে । ঠক ঠক ঠক ঠক । বেশ ধৈর্য্য ধরে মৃদু মৃদু আঘাতে কড়া নাড়ছে । মজার ঘুমটা অবেলায় ভেঙে গেল । ফজরের নামাজ পড়ে ভাপা পিঠা খেয়ে ঘুমিয়েছি । গ্রামে আসার পর এই বদঅভ্যেসটা রপ্ত হয়ে গেছে । ফজরের নামাজ পড়ে দশটা এগারোটা নাগাদ সানি ঘুম অর্থাৎ দ্বিতীয় নিদ্রা ৷ অবেলায় ঘুম ভেঙে যাওয়াতে একটা ভোঁতা যন্ত্রণায় মাথাটা টিমটিম করছে । লেপের নিচ থেকে মাথাটা বের করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি এখনো নয়টাই বাজেনি । ওদিকে সমানে কড়া নেড়ে চলেছে কে যেন । অগত্যা আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলি । দরজার সামনে মাঙ্কি ক্যাপ ও জ্যাকেট পরা কে যেন দাঁড়িয়ে আছে । আধো ঘুম আধো জাগরণে চিনতে বেশ কষ্ট হচ্ছে, হাতের তালু দিয়ে চোখ কচলে মানুষটাকে চেনার চেষ্টা করলাম । আররে, সাদেক ভাই ! এত সকালে কোথা থেকে আসলে । কি আশ্চর্য ! তোর কি অবস্থা অটোম্যান, এত বেলা করে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিস ।
সাধে কি তোর আটোম্যান নামটা দিয়েছি । থাক নামের শানে নুযূল বয়ান করতে হবে না । এত সকালে কেমনে আসলে, কি করে সম্ভব ? সম্ভব নয় কেন বল । সকাল সাতটায় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা দিনাজপুর হয়ে আন্তঃনগর এক্সপ্রেসে চড়ে চলে এলাম ৷ আমি তো আর তোর মত ঢাকায় থাকি না যে আসতে দশ-বারো ঘন্টা সময় লাগবে । তুই তো দেখতে নাদুসনুদুস হয়ে গেছিস । ফার্মের মুরগির মতো । কি করবো, লকডাউন যে । বাইরে বের হওয়ার জো নেই । শুয়ে বসে থাকতে থাকতে তাই একটু মোটা হয়ে গেছি আরকি । একগাল হেসে সাদেক ভাই বলেন– আবার এইচএসসিতে করলি আটো পাশ । তোদেরই কপালরে । আর আমাদের হচ্ছে কোদাল । এ্যাসাইনমেন্ট করতে করতে দম যায় অবস্থা । এই অবস্থায় আবার ফিফথ সেমিস্টারের রুটিন হয়েছে । সাদেক ভাইয়ের সাথে এমন ধারা আলাপ করতে করতে ঘুমটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল । তোর তো দেখি গোঁফ গজিয়েছেরে । ফাজলামো হাসি হাসে সাদেক ভাই । এই এক বদভ্যাস তার যখন তখন খোঁচানো । নে এক্ষুণি তৈরি হয়ে আয় । একটা জরুরি কাজ আছে । শীঘ্রই বের হতে হবে । উত্তরবঙ্গে শীত জেঁকে আসে আগেভাগেই যায়ও দেরি করে । সকালবেলা কুয়াশা পড়ে বেশুমার । শীতের তীব্রতায় গা টকটক করে কাঁপে । ভাগ্যিস আসার সময় নিউমার্কেট থেকে সস্তায় একটা আলখাল্লা ধরনের জ্যাকেট কিনে এনেছিলাম । তাই বাঁচোয়া । সাদেক ভাইয়ের কাজের কি কোন আগামাথা আছে । বাড়ি আসার পর সাদেক ভাইকে কতবার ম্যাসেঞ্জারে নক দিয়েছি, ফোন করেছি গ্রামের এসে আমাকে সঙ্গ দিতে । কিন্তু আসেনি । আজ হঠাত সকালবেলা উদয় হয়েই বেমক্কা ফরমায়েশ । উপায় নেই জামা কাপড় পরে বের হতে হল । ইট বিছানো রাস্তায় হেঁটে চলেছি আমি আর সাদেক ভাই । আবহাওয়াটা কেমন যেন মরা মরা । সাদেক ভাই, আমরা যাচ্ছি কোথায় ? অধমকে কী যাত্রার উদ্দেশ্য বলা যাবে ? একদম পাকামো করবি না, চুপচাপ পা চালা । কোন কথা না । এমন সময় মসজিদের মাইকে গলা খাঁকারি দিয়ে মুয়াজ্জিনের ঘোষণা শোনা গেল—
কুল্লি নাফসিন জায়েকাতুল মাউত !
একটি শোক সংবাদ ! একটি শোক সংবাদ !! দক্ষিনপাড়া নিবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম আজ বাদ ফজর বার্ধক্যজনিত কারণে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেছেন । ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন…।
মরহুমের জানাজার নামাজ আজ দুপুর দুইটায় বিদ্যানন্দ হাই স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হবে । জানাজা শেষে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে । উক্ত জানাজার নামাজে মরহুমের আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীসহ সকলকে অংশগ্রহণ করার অনুরোধ করা হল ।
এতক্ষণে বিষয়টি আমার বোধগম্য হয় । ইট বিছানো পথ ছেড়ে ধানখেতের আইল ধরে এগোচ্ছি । মজে যাওয়া সরু কাইছা নদীর উপরে বাঁশের সাঁকো । সাঁকোর উপরে উঠতেই কুয়াশার আড়াল থেকে সালাম চাচার বাড়িটা চোখে পড়ে । পাশাপাশি চারটি একই রকমের টিনের বাড়ি । সবুজ টিনের বাড়ি অন্য কোথায় দেখিনি আগে । আব্বা বলেছিল সরকারি গুচ্ছ গ্রামের বাড়িগুলো এরকমই হয় । এদিকটায় এখনো তেমনভাবে কেউ বসবাস শুরু করেনি । ভূমিহীন কয়েকটা পরিবারকে উপজেলার পরিষদ ও এসিল্যাণ্ডের অর্থায়নে বছর চারেক আগে এই বাড়িগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে । বাড়িতে প্রবেশ করতেই মহিলা কণ্ঠের উচ্চ নিনাদ কানে আসে ৷ ভাবতেই অবাক লাগে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সালাম চাচার মেয়ে-জামাই ছাড়া আর কেউ নেই ! তাও মেয়েকে ত্যাগ করেছেন ছয় বছর হল ৷ তার মেয়ে খাদেজা বাবাকে না জানিয়ে, মতের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী সলিমকে বিয়ে করে । সংসার পাতে বাপকে তোয়াক্কা না করেই । বাকি জীবন আর মেয়েকে ক্ষমা করেননি । আজ সে মেয়েই মৃত বাবার জন্য আছাড়িবিছাড়ি আহাজারি করছে । তারস্বরে তার পাঁচ বছরের মেয়েটাও কাঁদছে মায়ের দেখাদেখি । স্বামী সলিম মোল্লা কর্মঠ গৃহস্থ । স্বাচ্ছন্দ্যে চলে তাদের সংসার । সেই সলিম মিয়াও তার শ্বশুরের অন্তিম আনুষ্ঠিতার জন্য বেশ পেরেশান । পাড়া প্রতিবেশীরা জড়ো হতে শুরু করছে । ঘরে গিয়ে দেখি সালাম চাচার হাতে এখনো তাসবিহ মুঠো করে ধরা । ফজরের নামাজ পড়তে পড়তে জায়নামাজেই ইন্তেকাল করেছেন । একজন সূর্যসন্তান আব্দুস সালাম । বড় মর্যাদার মৃত্যু বটে । আঁটোসাঁটো একটা ঘর । আসবাব তেমন নেই বললেই চলে । আলনায় কয়েকটা বিবর্ণ লুঙ্গি পাঞ্জাবি । দেয়ালে ঝোলানো রওজা শরীফের ছবি । টেবিলে ফাজায়েলে আমল, রেহেল, একটা কলিকাতা ছাপা নূরানী কুরআন শরীফ । সাদেক ভাই বেশ করিৎকর্মা মানুষ ৷ আলিম পাশ করে পড়ছেন হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে । তাই দাফন-কাফনের যাবতীয় কাজ তার নখদর্পনে ৷ কাফনের কাপড় কিনে এনেছেন দিনাজপুর থেকে । কবর খোড়ার লোকও পাঠানো হয়েছে । গোসল করালেন নিজ হাতে । কর্মব্যস্ত সাদেক ভাইকে দেখে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা যেন বেড়ে গেল । জানাযার নামাজ হল নির্ধারিত সময়েই । কিন্তু বাঁধ সাধলো গার্ড অব অনার নিয়ে । থানার ইউএনও ওসি দুজনেরই বিভাগীয় কমিশনারের অফিসে মিটিং । মিটিং শেষ করে আসতে বেশ সময় লাগবে । তাই গার্ড অব অনারসহ যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা বিলম্ব হচ্ছে । আমার কোচিংয়ের অনলাইন ক্লাস ছিল । তাই বাড়ি চলে এসেছি । সাদেক ভাই কিন্তু এখনো ফিরে আসেনি । আব্বু ট্রেনের টিকেট পাঠিয়েছে । কাল সকালেই রওনা দিতে হবে ঢাকার উদ্দেশে । গ্রাম ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই মনটা কেমন বিষাদে ভরে গেল । দিগন্ত জুড়ে হেমন্তের অপরূপ চিত্রপট এখন । মনোলোভা প্রকৃতি চারপাশে । সরিষা খেত, খেজুর গাছ, মেঠোপথ, ধানখেত,সবুজ মাঠ, বাঁশঝাড়, ঝিঁঝির ডাক, মুরগের কুউক রু কু ডাক খুব মিশ করবো ! কালকেই ফিরতে হবে । করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে । আব্বু-আম্মু চিন্তিত । এটা ওটা বুঝিয়ে আর কালক্ষেপণ সম্ভব নয় । রাতের খাবার শেষ করে খড়কুটো দিয়ে গোল করে আগুন জ্বালানো হল । সবাই এটাকে বলে পোড় । পোড়ের চারপাশ ঘিরে একে একে বাড়ির সব সদস্য এসে বসে । নিয়ম করে বসে এই পারিবারিক আড্ডা । তীব্র ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া হাত-পা সেঁকে পোড়ের আগুনে । ছোট চাচি প্রতিদিন নিয়ম করে মিষ্টি আলু পুড়তে দেয় । পুড়ে সিদ্ধ মিষ্টি আলুর খোসা ছাড়িয়ে খেতে দারুণ লাগে । দাদুর কাশিটা যেন আজ বেড়েছে । চোখও ঢুকে গেছে । দাদু সালাম চাচার দাফন-কাফনে শরীক হতে পারেননি । তাই তারা আফসোসের অন্ত নেই । সারাদিন জায়নামাজে বসে চোখের পানি ফেলেছেন আর সালাম চাচার জন্য দোয়া-দরুদ পড়েছেন । দাদুর বয়স আশি ছুঁইছুঁই ৷ কিন্তু শ্বাসকষ্ট ও কোমরের ব্যথা ছাড়া তেমন মহার্ঘ অসুখ তার শরীরে বাসা বাঁধেনি । দাদুকে আজ বেশ অস্থির উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছে । অন্যদিনের মত গল্পের আসর জমেবে না বোধহয় ।
দাদু, তুমি সালাম চাচাকে এত খাতির করতে কেন ? বাড়িতে ভালো-মন্দ কিছু রান্না করলে সালাম চাচাকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে । তাকে সাহায্যও করতে দেদারসে । এর পিছনে কি কোন কারণ আছে দাদু ? আমি হঠাত এরকম একটা প্রশ্ন করে বসলাম কেন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই । তবে আশাও করিনি যে দাদু আমার এই ছেলেমানুষি প্রশ্নের উত্তর দেবেন । লাঠিটা শক্ত করে ধরে দাদু ৷ ডান হাত দিয়ে দাড়িতে হাত বুলান । তার শান্ত চোখজোড়া নিষ্পলক নিস্পৃহ । পোড়ের আগুণের আলো দাদুর ওপর পড়ে ।
সাদা পাঞ্জাবি সাদা দাড়িতে দাদুকে রূপকথার গল্প দাদুর মত মনে হয় । ভুলুটা দীর্ঘ একটা হাই তোলে । মিনিটা মেওও করে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে ৷ বড়ই গাছ থেকে কয়েকটা বাদুড় ডানা ঝাপটিয় উড়ে যায় ।
হ্যাঁ, কারণ তো অবশ্যই আছে রে দাদু ভাই ! সবাই উৎকর্ণ হয়ে নড়েচড়ে বসে । এই গল্প কখনও তোদেরকে শোনানো হয়নি । জীবনের এই অন্তিমক্ষণে তোদের বলে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করছি । এই কাহিনী সালামও কোনদিন মুখ ফুটে কাউকে বলেনি । এমন স্পর্শকাতর ছিল তার আত্মমর্যাদাবোধ । তবে শোন সেই গল্প — আজ থেকে প্রায় ৬০ বছর আগের কথা ৷ তখন রুহিয়া মেলার হাটবারে চার পাঁচটা গরু গাড়িতে করে ধান বিক্রি করতে নিয়ে যেতাম । মোমবার ছিল হাটবার । মেলায় ভিড়ভাট্টা হতো খুব । ধান বিক্রি করতে গিয়ে দু একদিন থাকা লাগত । একবার ধান বিক্রি করে ফেরার পথে শুনি শেষের গাড়িতে বস্তার স্তুপের নিচে একটা পাঁচ ছয় বছরের ছেলে ঘুমিয়ে আছে । গিয়ে দেখি ছেলেটা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে । তাকে ডেকে তোলা হল । নিজের নামটা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারে না।
অনেক খোঁজ খবর করেও বাবা-মা বংশ পরিচয়ের কূলকিনারা করতে পারলাম না । অগত্যা তাকে সঙ্গে নিয়েই ফিরতে হল । তখন বাড়িতে বছর ওয়ারী তিন চারজন কাজের লোক থাকতই । তাকে মানুষ করার দায়িত্বটা কুলসুমের মা’ই সানন্দে গ্রহণ করে । এভাবে নাম পরিচয়হীন একজন শিশু বড় হতে থাকে আমাদের স্নেহ ছায়ায় ।
আমি উসখুস করতে লাগলাম । এই গল্প তো আগেও শুনেছি অনেকবার… । দাদুর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে , পকেট থেকে বের করে ইনহেলার নিলেন । একটু দম নিয়ে আবার আরম্ভ করলেন —
তারপর সেই পরিচয়হীন শিশুই হয়ে উঠল আমার নিত্যদিনের সহচর । তাকে ছাড়া আমার একটা দিনও চলত না । হাটে-মাঠে সে হল আমার বিশ্বস্ত সহযোগী । বাড়ির নানারকম ফুটফরমায়েশ খাটত । কিন্তু আর আট-দশ জন কাজের লোকের মত ছিল না সে ।
তার ছিল প্রচণ্ড রকমের মর্যদাবোধ । আমার ছাড়া কারোর কথাই সে তেমন গ্রাহ্য করত না । আমিই উদ্যোগ নিয়ে কুলসুমের সাথে তার বিয়ে দিয়েছিলাম । এভাবে সে পরিবারের একজন হয়ে উঠেছিল । ততদিনে তার ঘর আলো করে একটা মেয়ে এসেছে । দিন ভালোই কাটছিল । কিন্তু হটাত সারাদেশে ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হয়ে গেল । পাকিস্তানিদের সাথে রেষারেষিটা তখন অগ্নিমূর্তির রূপ নিয়েছে । মিলিটারিরা ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরস্ত্র নিরীহ বাঙ্গালিদের উপর । ২৪ এপ্রিল ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন জায়গায় হন্তারক পাক সেনারা হত্যাযজ্ঞ চালায় । তখনো তারা আমার দিকে আসতে শুরু করেনি । তাছাড়া আমাদের গ্রামের পথ ছিল দুর্গম । তাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকার সুবিধা করতে পারেনি । তবে রাজাকারদের উৎপাত ছিল চোখে পড়ার মতো । এপ্রিলের শেষ দিকে পাশের গ্রামের কয়েকজনকে ধরে নিয়ে কাইছা নদীর ধারে গুলি করে মেরে ফেলে । পার্শ্ববর্তী হিন্দু গ্রাম নারায়ণপুরে আগুন জ্বালিয়ে দেয় । মিলিটারিদের এই ধরনের জুলুম মোটেও সহ্য করার মত ছিল না । ভিতর থেকে দেশকে শত্রুমুক্ত করার একটা দূর্বার তাড়না অনুভব করলাম । যুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি । সালমানকে নিয়ে বুড়িমারী সীমান্ত পার হয়ে চলে যাই শিলিগুড়ি । সেখানে ঠাকুরগাঁও মহকুমার আরো অনেক চেনাজানা মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছিল । তিন সপ্তাহ ট্রেনিং শেষ করে আমরা বাংলাবান্ধা দিয়ে দেশে ঢুকি । আমাদের ইউনিটের টার্গেট ছিল আটোয়ারীর আশেপাশের কয়েকটা গ্রাম । টুকটাক অপারেশন শুরু হয় আমাদের । সালাম তখনো আমার একই ইউনিটের সহযোদ্ধা । এদিকটায় শত্রুদের উৎপাত তেমন তীব্র ছিল না । আমাদের অপারেশন খুব বেশি জোরালোও হতো না । একদিন চিঠি পেলাম তোর বাবার জন্ম হয়েছে । আমরা তখন পঞ্চগড়ের মির্জাপুরে । খবরটা শুনে এত ভালে লাগল যে রাতেই ছুটি নিয়ে রওনা হলাম । কমান্ডারের কাছ থেকে অস্ত্রসহ বাড়ি আসার অনুমতি পেয়েছিলাম । শেষরাতে বাড়িতে এসে শুনি তোর দাদি আর কুলসুম ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই । আমার অছাটা চুল দাড়ি দেখে তোর দাদি তো আমাকে চিনতেই পারেনি তখন ৷ তিথী ইস বলে টিপ্পনী কাটল ! তারপর , তারপর ! বলে বাকি গল্প বলার জন্য তাগদা দিলাম আমি । দাদুকে বেশ এনার্জেটিক মনে হল ।
তারপর তোর বাবার মুখ দেখে খুশিতে আমি ডগোমগো । দিনটা ভালই কাটল । খুশির আতিশয্যে আমি ভুলেই গেলাম যে শত্রুপক্ষ ওত পেতে আছে । পরদিন দুপুরের খাবার খেয়ে ভাত ঘুমে গা এলিয়েছি । বাইরে চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে আমার । দরজা খুলেই অপ্রত্যাশিত একটা চিত্র চোখে পড়ে । চারজন পাকিস্তানি মিলিটারির বন্দুক উঁচিয়ে রেখেছে আমার দিকে । এমন অভাবনীয় দৃশ্য ঘটবে কস্মিনকালেও ভাবিনি । রাস্তা ঘাটের শোচনীয় অবস্থার কারণে যে গ্রামটাকে নিরাপদ ভেবেছিলাম তা যেন মহা বোকামি ছিল । ধন্দে পড়ে গেলাম । মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রমাদ গোনতে লাগলাম । নিঃশ্বাস ভারি হতে লাগল আমার । অকস্মাৎ হেই হেই করতে করতে তেড়ে আসতে লাগল কুলসুম । তার হাতে ঝা চকচকে বটি ! ক্ষিপ্র গতিতে এসে এক ঘা লাগিয়ে দেয় একটা মিলিটারির কাঁধে । ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল । ঘটনাটা ঘটল চোখের পলকেই । চারজন পাক সেনা যমদূতের মত কুলসুমের সারা শরীর ঝাঁঝরা করে দিল ! মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েছিল মাত্র । নিস্তব্ধ লাশের ওপর চারজন মিলে সরোষে বেয়নেট চার্জ করে এফোড় ওফোড় করে ফেলে । কি যে বিভৎস সে দৃশ্য । রাগ ঝেড়ে তারা আবার আমার দিকে রাইফেল তাক করে ।
এই শুয়ার কা বাচ্চা ! বাতাও বাকি মুক্তি কাঁহা হ্যায়? বাতাও সালাম কাঁহা হ্যাঁয়, মালেক মাস্টার কাঁহা হ্যাঁয় ? শুয়োর কা বাচ্চা । ইন্ডিয়া কা এজেন্ট …।
আমি মৃত্যুর প্রস্তুতি হিসেবে বিড়বিড় করে কালেমায় শাহদাত পড়ছি । আচানক রান্নাঘর থেকে ফায়ারিং শুরু হল । দড়াম দড়াম করে একটার পর একটা পাক সেনা ভূপাতিত হতে লাগল ! মুহূর্তেই সবকটি পাক সেনা মারা পড়ল । একে ফোরটিসেভেন হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো সালাম । কুলসুমের লাশটা ডেকে দিল তার গায়ের শাল চাদরটা দিয়ে । এই ঘটনার প্রতক্ষদর্শী আর কেউ ছিল না । তোর দাদি আর কুলসুম বাদে বাকি সবাই ইন্ডিয়ায় আমার বড় বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল । অনেক বড় মনের মানুষ ছিল সালাম । করোনায় মহামারিতে খেয়ে না খেয়ে একা একা থেকেছে। তবুও তার মেয়ের কাছে যায়নি । আমি ঢাকায় ছিলাম বলে এখানেও আসেনি । মুক্তিযোদ্ধা ভাতা নেতারা উঠিয়ে খেয়েছে তার নাম করে । তবুও কারো কাছে এতটু অভিযোগ আবদার জানাইনি কখনো ।
আল্লাহ তাকে জান্নাত দিয়ো মাবুদ । দাদু দু’হাত তুলে সালাম চাচার জন্য আবার দোয়া করলেন ।
পোড়ের চারপাশে পিনপতন নীরবতা । কখন যে সাদেক ভাই এসে বসেছে খেয়াল করিনি । টাস টাস করে অনেকগুলো গুলির আওয়াজ আর পো পো ধ্বনি শোনা গেল । তিথী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই বললাম — তোপধ্বনি ।