জীবনের গল্প – দহন

জীবনের গল্প - দহন

শামস মাহবুব

নবজাতক শিশুর মতো চেচিয়ে চেচিয়ে কাঁদছে আকাশ। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকায়, বাজ পড়ে। মেঘের দৃষ্টি ছিঁড়ে চারদিকে বয়ে গেছে জলপ্রপাত। সারারাত মেঘ জমা ছিলো, সকাল থেকেই উড়ুম ঘুড়ুম বৃষ্টি হচ্ছে। মেঘের গর্জনে ভেতরে প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করে। আকাশের মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে সবুরআলীর। নিরব নিস্তব্ধ প্রহর। মেঘলাদিনে একাকিত্ব কেমন ক্ষীপ্র হয়ে ওঠে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে চিনতে কষ্ট হয়। গ্লানি টানতে টানতে শরীরের কী করুন দশা। নিজেকে অচেনা লাগে। একসময় বৃষ্টি থামে, থামে না মনের বিষন্নতা। খণ্ডখণ্ড মেঘ তুলোর মতো উড়ছে। রোদের আড়ালে এখনো ঝড়ের আবাস।

সবুরআলী একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে মাঝারি পদে চাকরি করেন। কোম্পানিটা গাদার মতো খাটায়। পারিশ্রমিক দিতে এমন একটা ভাব যেনো অনুদান দিচ্ছে। ম্যানাজার আলাউদ্দিন খান লুইচ্চা প্রকৃতির লোক। মহিলা কর্মীদের সাথে মিষ্টিসুরে কথা বলেন। পুরুষ কর্মীদের রাখেন ধমকের ওপর । পান থেকে চুন খসলেই বেতন বোনাসের খোঁটা দেন। এমন লোকের অধীনে কাজ করা মুশকিল। সম্মান স্বাধীনতা না থাকলে কি কাজে সুখ মিলে? 

সবুরআলীও যে খুব উত্তম স্বভাবের লোক ঠিক তা না। চূড়ান্ত ফাঁকিবাজ। খচখচে স্বভাবের। মেজাজটা সসবসময় তেতো থাকে। স্বার্থ ক্ষুন্ন হলেই কুকড়া চুলের মতো বেঁকে বসেন। একগুয়েমী স্বভাবের জন্য সবুরআলীর সংসার বেশিদিন টিকেনি। 

সবুরআলী কাল রাত ঘুমাতে পারেননি। এলোমেলো ভাবনা এবং কালো অতীত তাকে বারবার আহত করেছে। তার ওপর কোম্পানি দুর্বল কর্মীদের ছাটাই করছে। যখন-তখন সে নিজেও ছাটাই হয়ে যেতে পারে। সবুরআলী জানেন তার কর্মদক্ষতা ও আচরণ সন্তোষজনক নয়। তিনি জানেন বস কিবা সহকর্মী কেউ তাকে পছন্দ করে না। এসব ভেবে তিনি নিজের ভেতর হারিয়ে যাওয়া ভালো মানুষটির সন্ধানে রাত অতিক্রম করেছেন।

আকাশ এতক্ষণে ফর্সা হয়ে উঠেছে। দমধরা স্তব্ধতা গলিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। প্রকৃতি শান্ত সুবোধ-বালকের মতো, স্তির। মেঘের তন্ময়তা ভেঙে আলোর হলুদ রেখা প্রবেশ করছে ঘরে। জানালার পর্দায় খেলা করছে সকালের সতেজ রোদ। বারান্দায় মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে সবুরআলী মেঘ ও রোদকে পরখ করতে চান। ভাবুক চেতনায় চোখা দৃষ্টিতে তাকান আকাশের দিকে। সেই দৃষ্টি কোথায় গিয়ে ছিটকে পড়ে তিনি জানেন না, জানতেও চান না। মেঝেতে নিজের ছায়া পড়েছে। ছায়ার লোকটাকেই বেশি সুখী মনে হয়। বউয়ের চলে যাওয়া, চাকরি হারানোর ভয় এবং একাকিত্ব তাকে বিষন্ন থেকে বিবস করে তুলেছে। নিজের রূঢ় আচরণের প্রতি রাগ হয়। বারান্দায় তিনি ঝিমধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এভাবেই তিনি দাঁড়িয়ে থাকতে চান একজীবন, শতাব্দীর পর শতাব্দী।

সকাল ন’টা। ঝাঁঝাল রোদে মনে হচ্ছে ভরা দুপুর। গাড়ির ধোঁয়া আর হর্ণে প্রবল হয়ে ওঠেছে শহর। হুইশেল বাজিয়ে একটা এম্বুলেন্স দ্রুত গতিতে ছুটছে। শহরের মানুষ বেরিয়ে পড়েছে যার যার কাজে। সবুরআলী বুকের তলদেশ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ঝেড়ে বের হন অফিসে। তার আগে সকালের নাস্তাটা গপাগপ গিলে নেন। সামনের চৌরাস্তার মোড়েই অফিস। চাইলেই হেঁটে যাওয়া যায়। রাস্তায় থমথমে জল। আজ হাঁটার ইচ্ছে নেই। ইশারায় একটা রিক্সাকে ডাকা হলো। সবুরআলী তার উপর উদাস মনে ঝেঁকে বসেন। রাস্তার দু ধারে আবর্জনার স্তুপ। ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা। এ পথে চলতে গা ঘিনঘিন করে। তবুও মানুষ চলছে নির্বিঘ্নে। কয়েকজন নারীশ্রমিক হেঁটে যাচ্ছে, মুখে বুলি নেই। পিছনের মহিলাটা একদলা পানের পিক ফেলে দেয়ালটা আরো নোংরা করে গেলো। দেয়ালটা দেখলে মুখভরে থুথু আসে। থাক, থুথু ফেলে পৃথিবীর কলঙ্কের দাগ আর বাড়াতে চাই না।

অফিসে পৌঁছাতেই পিয়ন এসে জানায় তিনি ছাটাই হয়েছেন। পিয়নের কন্ঠে তাচ্ছিল্যের সুর, ঠোঁটে প্রতিশোধের হাসি। চাকরিচ্যুতের খবরটা শুনে জলীয়বাষ্পে ভরে গেলো সবুর আলীর চোখ। দুঃখ খুব সহজে তাকে স্পর্শ করে না। আজও নিশ্চয়ই করেনি, নিথর নিশ্চল একখণ্ড পাথর হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
রফিকুল নাজিম এর দুটি কবিতা

রফিকুল নাজিম এর দুটি কবিতা

রফিকুল নাজিম   স্বীকৃতি তোমাকে ছাড়া আমাকে অস্বীকার করে তোমার শহর আমাকে অস্বীকার করে কাঁটাবনের ছোট্ট ক্যাফে ঘর পিচঢালা রাস্তা, বাদুড় ঝুলা বাস, যাদুঘর- পার্ক ...
মারা গেলেন বিশ্বের শেষ ‘গুহা মানব’

মারা গেলেন বিশ্বের শেষ ‘গুহা মানব’

ছাইলিপি.কম /৩০.০৮.২০২২ আদিমসভ্যতার শুরুর দিকে নিজেকে অন্য জন্তুর থেকে সাবধানে রাখার জন্য মানুষ গুহায় বসবাস করতো। শতাব্দির পর শতাব্দিতে মানুষের বসবাসে এক আমূল পরিবর্তন এসেছে। ...
তারা ও জোনাক পোকা

তারা ও জোনাক পোকা

বিরহের কবিতা – কাজী সামসুল আলম    সবাই মিলে সন্ধ্যা বেলা সেদিন মাঠে বসে পড়ল দেখি আকাশ থেকে একটি তারা খসে, আকাশ জুড়ে হৈ হুল্লোড় ...
লেখা পাঠান ছাইলিপিতে

লেখা পাঠান ছাইলিপিতে

সম্পাদকের কথা  লেখালিখি ও সৃজনশীল সাহিত্য রচনার চেষ্ঠা খুবই সহজাত এবং আবেগের দুর্নিবার আকর্ষণ নিজের গভীরে কাজ করে।পাশাপাশি সম্পাদনা ও প্রকাশনার জন্য বিশেষ তাগিদে অনুভব ...
কবিতা- নারী

কবিতা- নারী

 সেগুফতা আনসারী   জন্ম জন্মান্তরে, যুগ যুগান্তরে যে নারী করিছে পুরুষের আরতি, সে নয় ত কোন ভোগের পন্য সে যে একসাথে চলার সারথি।   পুরুষের ...
ভ্রান্ত প্রেম-শাহান আলম লিমন

ভ্রান্ত প্রেম-শাহান আলম লিমন

 শাহান আলম লিমন  নিষ্ঠুর তব মন হে প্রিয়া প্রণয়িনী নিষ্ঠুর তব দু’আখি হে ছলনাময়ী- তব প্রেম মাখা হাত বিষ প্রদায়িনী, মিথ্যা মায়া ম্লান মুখ দেবী ...