দাম্পত্য জীবন

দাম্পত্য জীবন

জোবায়ের রাজু

শিখার আজ বাসর রাত। সে চুপচাপ বাসর ঘরে বসে আছে। এখন রাত প্রায় বারটা। তার বর বাদল বারান্দায় কার সাথে যেন লম্বা আলাপ জুড়ে দিয়েছে। নতুন বউর দিকে তার খেয়াল নেই। বাদলের এহেন কান্ডে শিখার কিছু যায় আসে না। কারন এই বিয়েতে তার মত ছিল না। বাবা মা জোর করে তাকে এখানে বিয়ে দিয়েছে। এ বিয়েতে শিখার মত না থাকার কারন হচ্ছে বাদলের কুৎসিত চেহারা। কথাটা বললে ভুল হবে। কারন বাদলের চেহারাকে শিখা যতটা কুৎসিত ভাবছে, আসলে সে ততটা সেরকম না। চেহারায় মায়া ভাব কম এবং পুরো অবয়বে বসন্তের বিদঘুটে দাগ আর গায়ের রং কালো। শিখার বাবা মা বাদলের এই সব সমস্যা মেনে নিয়ে মেয়েকে এখানে প্রাত্রস্থ করেছেন। কারন বাদলের অগাধ সম্পদ আর ঢাকা শহরে নিজের টাকায় নির্মিত দু দুটো বাড়ির মোহ শিখার বাবা মাকে অন্ধ করে দিয়েছে। তাই এই বিয়ের সম্বন্ধ আসার এক বাক্যেই তারা মেয়েকে বাদলের ঘরে পাঠাবেন বলে রাজি হয়েছেন।
কিন্তু শিখা কখনো এই বিয়েতে রাজি ছিল না। কারন এতে বাদলের মন্দ চেহারা যেমন একদিকে দায়ী, তেমনি হিল্লোলকে মন উজাড় করে ভালোবাসাও একটা কারণ। তবুও বাবা মা’র প্রবল অনুরোধের কাছে নিজেকে অনেকটা বলি দিয়ে শিখা এ বিয়েতে রাজি হয়েছে। কিন্তু তার মন পড়ে আছে হিল্লোলের কাছে।
জীবনের এই একটা গুরুত্বপূর্ণ রাত জেনেও বাদল নব বধূকে সঙ্গ না দিয়ে কার সাথে যেন বারান্দায় ফোনে কথা বলছে। নতুন শাড়ির ঘোমটায় তন্দ্রাচ্ছন্ন শিখার মনে পড়তে লাগল হিল্লোলকে।



মোটামুটি পয়সাওয়ালার ছেলে হিল্লোল। দেখতেও বেশ ভালো। মেয়েরা প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ে যাবার মত একটা চেহারা আছে হিল্লোলের। যেদিন প্রথম শিখা হিল্লোলের প্রেম প্রস্তাব পায়, আনন্দে সে তো আটখানা। তাই তো সাত পাঁচ না ভেবে হিল্লোলের আবেদনে সাড়া দিতে বিলম্ব করেনি শিখা।
দুজনের প্রেমের ঘন্টা বাজতে থাকল দিনের পর দিন। মধ্য রাত অব্দি দুজনে ফোন কলে নিজেদেরকে ব্যস্ত রেখেছে। বিশেষ দিনে দূরে কোথাও ঘুরে আসার ঘটনাও বেশ ক’বার ঘটেছে। সফলভাবে চলতে থেকেছে দুজনের গোপন প্রেম পর্ব। কিন্তু বাদলের সাথে হুট করে বিয়ে হওয়াতে সে প্রেমে বিঘ্ন ঘটেছে।
এই বিয়ে হওয়ার ব্যাপারে হিল্লোলের যতটা প্রতিবাদ করার বা বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার কথা ছিল, সে এসবের কোন দায়িত্ব পালন না করে নিরব ভুমিকা পালন করেছে। যদিও এ ব্যাপারে শিখা সেভাবে ভেবে দেখেনি।



২. বাদল ফোনে কথা বলা শেষ করে বাসর ঘরে এল। শিখা ঘোমটায় মাথা নত করে বসে আছে। বাদল যেন অনেকদিন ধরে শিখাকে চিনত, এমন ভঙ্গিমায় বলল-‘শিখা, বিয়ের আগে আমি তোমার সব খবর নিয়েছি। আমাকে তোমার পছন্দ না, তাই না? শুধু তোমার কেন, আমার পরিবার আমার বিয়ের ব্যাপারে যতগুলি সম্বন্ধ নিয়ে পাত্রীর বাড়ি গেছে, কোন পাত্রীই আমাকে পছন্দ করেনি। বদসুরত আমার। আল্লাহ আমাকে ভালো একটা চেহারা দেননি বটে, তবে ভালো একটা মন দিয়েছেন। আমার সাথে মিশালে তুমি সেটা বুঝতে পারবে। আর আমার সাথে মেশার জন্য তোমাকে কখনো জোরাজোরি করব না। সংসারের সকল স্বাধীনতা তোমায় দিলাম শিখা। আমি জানি আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি, কিন্তু এর আগে বিয়ের জন্য যতগুলি মেয়ে দেখেছি, একমাত্র তোমাকেই আমার ভালো লেগেছে বলে জোর করে হরেও বিয়ে করেছি। অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো। যেদিন তুমি নিজের থেকে বলবে তুমি আমাকে ভালোবাসো, সেদিনই আমি কেবল তোমাকে স্পর্শ করব। তার আগে নয়।’
বাদলের কথা শোনে শিখার তেমন ভাবান্তর হল না। বরং বাদলের কথাগুলিকে একটা অবহেলার ভাব দেখাতে চেয়েছে, কিন্তু বাদল সেটা লক্ষ্য না করে বিছানায় গা হেলিয়ে দিয়েছে। মুহুর্তেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেল সে। কিন্তু শিখার মনে তখনো একটাই নামÑহিল্লোল।
এভাবে শিখা আর বাদলের দিনের পর দিন কাটতে থাকল। দুজনের মধ্যে একটা দূরত্ব সব সময়, কিন্তু বাদল সে দূরত্বের ধার না ধেরে শিখাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে।
রাজপ্রাসাদের মত বিশাল বাড়িটাও লিখে দিয়েছে শিখার নামে। মার্কেটের সব ভালো দামী শাড়িগুলি কখনো কখনো নিয়ে আসতো শিখার জন্যে। বিনিময়ে চেয়েছে কেবল শিখার একটু ভালোবাসা। কিন্তু শিখা নিজেই হিল্লোলের ঘোর কাটতে পারেনি বলে বাদলের ভালোবাসার গুরুত্ব বোঝতো না। ফোনে দিনের চব্বিশ ঘন্টা কল দিত হিল্লোলকে। কিন্তু হিল্লোল সেসব কল রিসিভ করতো না দেখে মনে মনে এক গোপন দহনে জ্বলে মরতো শিখা। হিল্লোল সেটা বুঝত না কেন? রাগ? অন্যত্র বিয়ে করেছে বলে শিখার উপর হিল্লোলের এত রাগ? এসব হাবিজাবি প্রশ্ন এসে মাথায় ভর করে শিখার।
এদিকে স্বামীর প্রতি কোন গুরুত্ব না থাকার পরও শিখার প্রতি বাদলের কোন অভিযোগ নেই। কারণ বাদলের কেন জানি মন বলছে শিখা একদিন তাকে টেনে নিবেই। সেই টেনে নেয়া এতই প্রবল হবে যে সেখানে বাদলের গায়ের রং কিংবা বদসুরত গৌণ হয়ে উঠবে। সেই দিনের অপেক্ষায় বাদল। এইভাবেই তাদের দাম্পত্য জীবন কাটে।
নিজের কাপড়টাও নিজে ধুয়ে নেয় বাদল। নিজেই ভাত বেড়ে খায়। অফিস থেকে ফিরতে রাত গভীর হলেও শিখা বাদলের প্রতীক্ষায় বসে থাকে না। সে সারাক্ষণ মোবাইল হাতে নিয়ে হিল্লোলের অবস্থান নির্ণয় করে। কখনো আবার ম্যাসেস পাঠায়। ‘আমি তোর কাছে চলে আসতে চাই। তুমি কি আমাকে গ্রহন করবে?’ শিখার এমন অনেক আকুতিময় ম্যাসেসের রিপ্লাই আসে না হিল্লোলের নাম্বার থেকে। এজন্য শিখা নিজে নিজে গুমরে মরে। এই ছাড়া আর উপায় কিও বা আছে।



৩. এই বাড়িটা বাদল শিখার নামে লিখে দিয়েছে। কিন্তু এই বাড়ির প্রতি কোন লোভ না রেখে একদিন সকালে বাদল অফিসে যাবার পর শিখা এ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায হিল্লোলের কাছে।
হিল্লোলের বাড়ি গিয়ে শিখা জানতে পারে এক ঘৃণ্য বাস্তব সত্য। হিল্লোলদের এক প্রতিবেশীর মুখে শিখা জানতে পারল হিল্লোল নাকি তাদেরই গ্রামের এক মেয়েকে জোর পূর্বক দর্শন করেছে। মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে উঠলে সে হিল্লোলকে বিয়ের তাগিদ দেয়। কিন্তু হিল্লোল তাকে বিয়ে করতে রাজী না হলে মেয়েটি মামলা করে হিল্লোলের নামে। পরে পুলিশ এসে হাজতে নিয়ে যায় হিল্লোলকে। ছেলের এমন কান্ডে সমাজে চোখ দেখাতে না পেরে হিল্লোলের বাবা মা দুজনে সুইসাইড করে।
এমন ঘটনা শোনে হতাশ হয় শিখা। তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে হিল্লোল নামের এক চরিত্রহীনকে সে এতদিন ভালোবেসেছে। এতটাই নিখাদভাবে বিশ্বাস করেছে যে সে কখনোই বুঝতেই পারেনি হিল্লোলের ভিতরে একটা পশু বাস করে। ভাগ্য ভালো সে পশু শিখার দিকে কুনজর দেয়নি।
হিল্লোলের বাড়ি থেকে নিরাশ হয়ে শিখা আবার ফিরে আসে বাদলের বিশাল বাড়িতে। হিল্লোলের কথা ভাবতেই তার এখন ঘৃণা হচ্ছে।
দেয়ালে ঝুলানো বাদলের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে শিখা। ছবির ভিতরের ওই বাদলের জন্য তার কেমন কেমন যেন লাগছে। কিন্তু কি সেই ‘কেমন কেমন’ লাগা, বুঝতে পারছে না। হঠাৎ খেয়াল করল তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। ছবির ওই বাদলের জন্য তার এখন মায়া হচ্ছে। এমন তো আগে হয়নি কখনো। এখন এমন লাগছে কেন?
শিখা ক্রমেই বুঝতে পারছে বাদলের প্রতি তার এই মায়া ক্রমশ ভালোবাসায় পরিণত হচ্ছে। বাদলের ওই অসুন্দর চেহারা নয়, তার বুকের অতলে জমে থাকা একখন্ড নিষ্পাপ ভালোবাসার মূল্যবোধটা বুঝতে পারছে শিখা। বিয়ের পর থেকে সে কখনো বাদলকে বোঝেনি। কিন্তু এতে বাদলের একবিন্দুও ভ্রুক্ষেপ ছিল না। সে ইচ্ছে করলেই পারতো তার এই অভিজাত বাড়ি থেকে শিখাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে। কিন্তু বাদল তা করেনি। বরং এই বিশাল বাড়ি একাই শিখার নামে লিখে দিয়েছে। এটা তো সম্ভব হয়েছে কেবল ভালোবাসার জোরেই। কিন্তু সে ভালোবাসার দাম দেয়নি শিখা। তাই আজ এক বিষাদে ঘেরা অনুশোচনায় অনুতপ্ত সে। দিন রাত কেবল হিল্লোলের মত এক চরিত্রহীণকে নিয়ে মিথ্যে সখ্যের জাল বুনে গেছে।
আজ আর হিল্লোলের জন্যে নয়, বাদলের জন্যে সে মনে মনে স্বপ্নের পার তোলা নৌকা বাইছে। আজ বাদল অফিস থেকে এলে ক্ষমা চাইবে শিখা।
এখন অনেক রাত। বাদল একটু পর ফিরবে। শিখা তার জন্যে পথ চেয়ে আছে। একটু পর
কলবেল বাজবে। শিখা সে কলবেল শোনার আশায় কান পেতে বসে আছে।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

এবার মরু: চতুর্থ পর্ব

গৌতম সরকার আজ এলাম সাম বালিয়াড়ি থেকে জয়সলমের হয়ে যোধপুর। এটাই আমাদের শেষ গন্তব্য। কয়েকদিন ধরেই বিপ্রতীপে পথ চলা শুরু হয়ে গেছে। ট্যুর শেষ হতে ...
ভাষাতত্ত্ব কে সাহিত্যের সাথের যুক্ত করে-শৈলীবিদ্যা বা স্টাইলিসটিক্স

ভাষাতত্ত্ব কে সাহিত্যের সাথের যুক্ত করে-শৈলীবিদ্যা বা স্টাইলিসটিক্স

ড. শিবাশিস মুখোপাধ্যায় শৈলীবিদ্যা হল ভাষাগত দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ্যের অধ্যয়ন এবং ব্যাখ্যা। একটি শৃঙ্খলা হিসাবে এটি সাহিত্য সমালোচনা এবং ভাষাতত্ত্বকে সংযুক্ত করে, কিন্তু এর নিজস্ব ...
 শহরের আর্তনাদ | কবিতা

 শহরের আর্তনাদ | কবিতা

|নাঈমুর রহমান নাহিদ   থালার মত চাঁদ গিলে খাচ্ছে রাতের আধার পুরো শহর নিস্তব্ধ, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নির্ঘুম চোখে, নীরব রাতে নিস্তব্দধ পথে হেঁটে চলেছি ...
পর্নোগ্রাফি কিংবা হস্তমৈথুন থেকে মুক্তি চাইছেন?

পর্নোগ্রাফি কিংবা হস্তমৈথুন থেকে মুক্তি চাইছেন?

দ্যা ডেপথ অব পর্নোগ্রাফি দ্যা ডেপথ অফ পর্ণগ্রাফি, বাংলায় বললে এ এক মৃত্যু কূপের নাম। বর্তমান সময়ে আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যেখানে বাস্তবিক ...
Why Stock Market Affects Men and Women Differently

Why Stock Market Affects Men and Women Differently

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [পর্ব-০৪]

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [পর্ব-০৪]

পার্থসারথি সৈকত স্নান শেষে তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করে। রুমের ভেতর কয়েক কদম ফেলতেই হঠাৎ চোখ পড়ে পারমিতা ও রুচিরার ওপর। সৈকত আর্শ্চয ...