বিজয়ের আনন্দে অশ্রুর ফোঁটাগুলি

বিজয়ের আনন্দে অশ্রুর ফোঁটাগুলি

লুনা রাহনুমা

মেয়েটি দৌড়াচ্ছে।
ফুলের মতো কোমল মেয়েটির পা দুটি
কোথা থেকে এতো শক্তি পেলো –
ভাববার অবকাশ পায় না মেয়েটা।
তার শরীরের নিচ থেকে হাঁটু দুটি




গাড়ির চাকার মতো বিরামহীন ভাঙছে
আর দমাদম মাটিতে পড়ছে পায়ের পাতাদুটি
আর মাটি থেকে একহাত উপরে উঠে ঘুরে
আবার তারা মাটিতেই পড়ছে।
মেয়েটির হাতদুটি পাখির ডানার মতো
দুইপাশে শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে
মেয়েটিকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।





মেয়েটির পায়ের পাতা, আঙ্গুল, নখ ফেটে রক্ত ঝরছে,
ক্ষত-বিক্ষত পায়ের তলায়
ইটের গুঁড়ো- সুরকি, বালি-পাথরকণারা ঢুকে যাচ্ছে –
কিন্তু মেয়েটির কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
শরীরের কষ্ট মোটেই ক্লেশ দেয় না মেয়েটাকে আজ।





বুকের ভেতর ভাসছে কেবল হাঁপিয়ে উঠা একটিই হাহাকার-
ছয়মাসের দুধের বাচ্চাটিকে ফেলে আসতে হয়েছে তার।
ওরা সবাই বলছিলো: পালা – পালা – পালা !!!
কান ঝালাপালা করা সেই আর্তনাদে
সবাই আবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে: সব ফেলে পালা – পালা !!
সময় কম, পালা !





গভীর জঙ্গলে ক্ষুধার্ত বাঘের মুখের সামনে থেকে
নিরুপায় মানুষ যেমন শেষ চেষ্টা করতে দৌড়ে পালায়,
সুজনতলী গায়ের নানা বয়সী নারীও তেমনি দৌড়াচ্ছে।
পালাতে চাইছে মানুষের মতো দেখতে ওই রাক্ষস দানবগুলোর
হিংস্র ছোবল থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে।

মাইলের পর মাইল,
মাঠের পর মাঠ,
ফসলের জমি,
আগাছা ভরা স্যাঁতসেঁতে ডোবা,
শক্ত মাটির রুক্ষ ধুলোমাখা পথ –
সবখানে নিজের পায়ের অদৃশ্য চিহ্ন ফেলে ফেলে মেয়েটি দৌড়ায়।





কিন্তু মেয়েটি একা না।
তার সাথে দৌড়াচ্ছে আরো কিছু যুবতী। তরুণী।
পাটকাঠির মতো পাতলা শরীরের কিশোরীও ছুটছে।
সন্তানের জন্ম দেয়া মধ্যবয়সী নারীরা আছে এই দলে।
জীবনের ভার বইতে বইতে ক্লান্ত যে প্রৌঢ়া
একটি পাও বেশি ফেলতে খিন্ন বোধ করতো এতদিন –
আজ সেও দৌড়াচ্ছে অনি:শেষ শক্তিতে।





দৌড়ে প্রথম হবার প্রতিযোগিতার খেলার মতো
ওরা সবাই ছুটছে জীবন বাজি রেখে –
বাঁচতে হলে – পালাতে হবে।
গ্রামের সবচেয়ে উঁচু টিলাটির উপরে লাল পতাকা উড়ছে।
মিলিটারি আসছে। পাকিস্তানী মিলিটারিরা আসছে ওদেরকে গিলে খেতে।
তাই ওরা দৌড়ে পালাতে চাইছে।



পেছনে ধেয়ে আসা হানাদার বাহিনী আর
স্বদেশী রাজাকার নামের জিভ ঝোলানো কুকুরগুলো ভাবছে-
মেয়েগুলোকে আজ ধরে নিতে পারলে
ক্যাম্পে কয়েকরাতের ভোজ হয়ে যাবে।
চোখের সামনে পলায়নরত হরিণের বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে
লোভে জিভ থেকে লালা পড়ছে যেন হিংস্র জানোয়ারগুলোর।
বাতাসের গতিতে ছুঁটে চলা মেয়েদের সামনে কিচ্ছু দেখা যায় না-
না আকাশ, না গাছ, না নদী, না নর্দমা, না জংলা ঝোঁপের কাঁটা !



ওদের চোখে ভাসছে কেবল জন্ম থেকে বেড়ে উঠা
খড়ের ঘরে জ্বলতে থাকা দাউদাউ আগুন;
ওদের কানে বাজছে কেবল উঠোনে ফেলে আসা বৃদ্ধা মায়ের বিলাপের সুর;
ওদের মনে প্রতিশোধের তীব্র আক্রোশ একবার বলে:
দাঁড়া- রুখে দাঁড়া – শয়তানগুলোর চোখ খুলেনে নখের আঁচড়ে,
দাঁতে কামড়ে ছিঁড়েনে ওদের কণ্ঠনালী!
কিন্তু লাঞ্চিত হবার ভয়ে ওরা সম্ভ্রম নিয়ে দৌড়াতে থাকে…
দৌড়াতে থাকে …
দৌড়াতেই থাকে …



ওরা সবাই একটা জঙ্গল খুঁজছে। খুব গভীর জঙ্গল চাই।
সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না এমন জঙ্গল হলেই ভালো।
পাকিস্তানী মিলিটারির পাশবিক বর্বরতার ক্রীড়নক হবার চেয়ে
বনের পশুর খাদ্য হওয়া শ্রেয় মনে করে তারা।
যদিও বনের জন্তু মানুষ ছোঁয় না

যতক্ষণ না তাদের জৈবিক তাড়না নির্দেশ করে।
পশুবৎ পাকিস্তানীগুলোর লাম্পট্যের ক্ষুধা
প্রয়োজন অপ্রয়োজন মানে না,
বিকৃত হ্লোদে ছিঁড়ে খুঁড়ে রক্তাক্ত করে
বাঙালী মেয়েদের কৃশ ভঙ্গুর ললিত পাপড়িগুলোকে।



এরপর,
মাসের পর মাস যুদ্ধ গড়ায়।
সুজনতলী নামের গ্রামটির নিখোঁজ হওয়া মেয়েগুলো
আর ফিরে আসেনি গ্রামে। হয়তো ওদের –
সাপে কেটেছে,
বাঘে খেয়েছে,
কুমির টেনে নিয়ে গেছে জলের আরো ভিতরে,
হয়তো ওরা মরেছে ক্ষুধার জ্বালায়,
হয়তো পথ হারিয়ে আর ফিরতে পারেনি ফেলে যাওয়া বসত ভিটায়-
কিংবা কে জানে, হয়তো ওরা দল বেঁধে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো স্বেচ্ছায় প্রাণ দিতে! ওরা ফিরে আসেনি আর।

অনেক প্রাণের বিনিময়ে এসেছে দেশের স্বাধীনতা –
বাংলার সবুজ জমিনে লেপ্টে আছে ওদেরই রক্ত –
বিলিয়ে দেয়া ঘাম- ঘুম- স্বপ্ন- ও বিভ্রম।

মাথা উঁচু করে উড়তে থাকা অহংকারী পতাকার বুক
বাতাসে ঝুঁকে আজো শ্রদ্ধা জানায় সকল শহীদ বীরকে।
একাত্তরের যুদ্ধের বীভৎস অভিজ্ঞতায় বাঙালি জেনেছে-



যুদ্ধ বাঁধলে, শিশুর অন্ন কেড়ে নেয়া যায়
যুদ্ধ বাঁধলে, নারীর বস্ত্র হরণ করা যায়
যুদ্ধ বাঁধলে, মুক্তিযোদ্ধাদের সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে
ট্যার ট্যার গুলিতে সব্বাইকে মেরে ফেলা যায়
যুদ্ধ বাঁধলে, নারীর আঁচলের মতো একটানে



একটি দেশের মানচিত্র ছিঁড়ে ফেলা যায়
যুদ্ধ বাঁধলে প্রেমিকার নাকছাবিটি বুকে নিয়ে
হাসতে হাসতে পাগল ছেলেটি মরতে যায়।

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর।
উনপঞ্চাশ বছর আগে —
সেই মেয়েটির আঁচলে টান পড়েছিল বলেই আজ আমি বাংলায় লিখি।
সেই ছেলেটি যুদ্ধে গিয়েছিলো বলেই তো আজ আমি বাংলায় কথা বলি।

বিনম্র সালাম সকল শহীদ প্রাণ।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [প্রথম পর্ব]

ভালোবাসার দ্বিতীয় প্রহর [প্রথম পর্ব]

লেখক- পার্থসারথি পড়ন্ত বিকেল। ছায়া ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। রোদের প্রখরতা সরে গেছে অনেকক্ষণ। পাখিদের উড়াউড়ি আকাশের সীমানায় বেড়ে গেছে। মৃদু শান্ত হাওয়া নবপল্লবের চূড়ায় নেচে ...
হাবুসু : সাপ থেকে তৈরী হয় যে পানীয়

হাবুসু : সাপ থেকে তৈরী হয় যে পানীয়

“সাপ” শব্দটির নাম শুনলেই আতংকে বুকধড়ফড় শুরু হয়। সাপের সাথে আমাদের সখ্যতা- ভয়ের রাজ্যে পৃথিবী সর্পময় এর অনুরূপ। ছোটবেলা থেকে কর্ডাটা পর্বের এই সরীসৃপের সাথে ...
7 Answers to the Most Frequently Asked Questions About Automobile

7 Answers to the Most Frequently Asked Questions About Automobile

Cursus iaculis etiam in In nullam donec sem sed consequat scelerisque nibh amet, massa egestas risus, gravida vel amet, imperdiet volutpat rutrum sociis quis velit, ...
হাসির গল্প - পঙ্কু দাদু

হাসির গল্প – পঙ্কু দাদু

সাকিব হোসেন নাঈম এলাকার দশজন ধনী ব্যক্তির তালিকা করলে দু তিন নাম্বারে আসে পঙ্কু দাদুর নাম। তার প্রকৃত নাম কেউই জানেনা কারণ তার ‘পঙ্কু দাদু’ ...
রফিকুল নাজিমের কয়েকটি কবিতা

রফিকুল নাজিমের কয়েকটি কবিতা

প্রেম কেবলই বেদনার নাম রফিকুল নাজিম একদিন এক গণক ঠাকুর আমাকে বলেছিল, যেদিন আমি তোমার ভেতর ঠিকঠাক পৌঁছে যাবো যেদিন আমি নিরঙ্কুশভাবে তোমাকে অধিকারে নেবো ...
ঈদুল আজহার দুটি ছড়া 

ঈদুল আজহার দুটি ছড়া 

ইমতিয়াজ সুলতান ইমরান  কোরবানি দাও মনের পশু কোরবানি দাও ভালো কথা একটু দেখো ভেবে মোটা তাজা কিনবে পশু কিসের টাকা জেবে? ঘুষের টাকায় পশু কিনে ...