জোবায়ের রাজু
সকাল বেলায় মায়ের বানানো চিতই পিঠা ভক্ষণের রমরমা আড্ডায় যখন আমি, বড়দা আর শ্যামা পুরোপুরি নিবেদিত, তখনই গোয়ালা এলো দুধ নিয়ে। দুই লিটার বোতলের মধ্যে দুধ ভরে এনে তিনি দুয়ারে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন। মা চোখ বড় বড় করে বললেনÑ‘কি চাই?’ মাকে থামিয়ে দিয়ে বড়দা নিচু গলায় বলল‘মা, হোসেন কাকা আজ থেকে রোজ আমাদের দুধ দিয়ে যাবে। আমিই বলেছি।’ বড়দার কথা শুনে মায়ের চোখ ছলছল করে উঠল।
বড়দা চাকরি জীবনে যাবার পর অভাব নামের পরশ পাথরটি গলতে গলতে আমাদের চিরকালের টানাপোঁড়নের সংসারে সুখের সূর্য দিনে দিনে আলো ছড়াতে শুরু করেছে। সে আলোয় আলোকিত হয়েছি আমি, শ্যামা আর আমাদের নিত্যকালের অভাবের অন্ধকারে চুপচাপ তলিয়ে থাকা জনমদুঃখী মা। এক বছর আগের কোন এক পড়ন্ত বিকেলে বড়দা সারা বাড়িময় হৈ চৈ ফেলে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বললÑ‘আমার চাকরি হয়েছে মা। আমরা আর অভাবে দিন কাটাব না।’
বড়দার চাকরি হবার পর আশ্চর্যজনক ভাবে আমাদের সংসার থেকে অভাব দূর হতে সময় লাগেনি। কুঁড়েঘর থেকে আমাদের আস্তানা হল টিনের ঘরে। তিনবেলা আমরা পেট পুরে ভাত খাই। ছিঁড়ে যাওয়া জামাটি সেলাই করতে মরিয়া হয়ে উঠি না। পেয়ে যাই নতুন জামা। তলা ক্ষয়ে যাওয়া জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলে নতুন ফিতা কেনার জন্য মাকে তাগিদ দিই না। পেয়ে যাই নতুন জুতা। বিদ্যুৎ বিল বাড়বে বলে সন্ধ্যায় মা টিউব লাইট বন্ধ করে পাঁচ টাকার মোম জ্বালিয়ে আমাদের পড়াতে বসে না। এ ঘর ও ঘর জ্বলে থাকে টিউব লাইট। পুকুর ঘাট থেকে বিনা পয়সায় কলমি শাখ তুলে এনে মা নিরামিষ রাঁধেন না। পাতিলে বসানো হয় অভিজাত সব পুষ্টিকর খাবার।
বড়দা বদলে দিয়েছে আমাদের ভাগ্যরেখা। দুই দিন পর পর বাজার থেকে ব্যাগ ভর্তি বড় বড় মাছ আনে। আমাকে আর শ্যামাকে সেদিন মার্কেটে নিয়ে কিনে দিয়েছে দামি দামি জামা, মায়ের জন্য ছয়টি শাড়ি। যে শাড়ি দেখে মা আবেগে আপ্লুত হয়ে ঘরের কোনে বসে নিরিবিলি কাঁদলেন। হয়তো সংসার জীবনে স্বামীটি তাকে কোনদিন একখানা ভালো শাড়ি কিনে দিতে পারেনি বলে।
বাবা বাণিজ্যে গিয়ে সেই যে আবর সাগরে নিরুদ্দেশ হলেন, আজো তার হদিস মেলেনি। মা গভীর রাতে তার নিজের মানুষটির অপেক্ষায় দুয়ারে বসে থাকেন। তার ধারণা বাবা কোন এক নিশুতি রাতে ধীরে হেঁটে মায়ের কাছে এসে বলবেÑ‘মরিয়ম, রাত হয়েছে অনেক। এখনো ঘুমাওনি?’ কিন্তু মা জানেন না তার স্বামীটি এ জীবনে আর কখনো ফিরবেন না। এতদিনে হয়তো সমুদ্রের কোন ভয়ংকর জন্তুর আক্রমনে আমাদের সারা জীবনের পরিশ্রমী বাবা চিরতরে নিঃশেষ হয়ে গেছেন।
বাবাকে হারাবার পর থেকে আমাদের দুর্দশা চরমে পৌঁছে যায়। স্বামীহীন সমাজে একজন সুন্দরী নারীর প্রতিটি মুহুর্ত পার করা কতখানি কষ্টের, সেটাও ততদিনে হাড়ে হাড়ে টের পেলেন মা। অভাবের সংসারে ডুব সাঁতার খেলতে খেলতে মা ডুবে যেতেন প্রতিনিয়ত, কিন্তু তলিয়ে যেতেন না। আমাদের সেসব দুর্বিষহ দিন ছিল একেকটি কষ্টের পরিক্রমা। স্বামী হারাবার গোপন শোক নিয়ে মা তার তিন সন্তানকে আগলে রেখেছেন। আমাকে, বড়দাকে আর শ্যামাকে। অভাব আর টানাপোঁড়নের সাথে নিত্য যুদ্ধ করতে করতে আমাদের সংগ্রামী মা আমাদেরকে ভালো খাবারগুলি সেভাবে খাওয়াতে পারেননি।
শ্যামা যখন খুব ছোট, দুধের প্রতি ছিল তার একনিষ্ঠ লোভ। সে তার বিস্মিত চোখে প্রতিদিন দেখতো পাশের ঘরের সুমাদেরকে রোজ সকালে গোয়ালা দুধ দিয়ে যাচ্ছে। সুমা দুয়ারে বসে কাপে করে রোজ গরম গরম দুধে ফুঁ দিতে দিতে খেত। শ্যামা দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে দুধের লোভে মরিয়া হয়ে উঠতে উঠতে মাকে দুধের জন্য আবদার করতো। কিন্তু আমাদের তখন সে সুদিন ছিল না। একদিন সুমাদের রসইঘর থেকে দুধের সর চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়ে শ্যামা। সুমার হিংসুটে মা শ্যামার গালে সজোরে কষে এক চড় বসালেন যে তার হাতের পাঁচ আঙুলের দাগ শ্যামার মুখে বসে গেছে।
রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল শ্যামার। অঘোরে কাঁদতে কাঁদতে মা শ্যামার মাথায় রাতভর পানি ঢাললেন। এ ঘটনায় সব চেয়ে বেশি কষ্ট পেল বড়দা। বড়দাকে জীবনে কখনো কাঁদতে দেখিনি। সেই রাতে বড়দা চুপি চুপি কাঁদতে গিয়ে আমার চোখে ধরা পড়ে গেল। চোখ মুছতে মুছতে বললÑ‘দেখিসরে, আমাদের এই দুখের দিন থাকবে না।’
কালের আবর্তে আমরাও এখন সুমাদের মত দুধ খাই। গোয়ালা রোজ সকালে আমাদেরকে দুধ দিয়ে যায়। মা চুলোয় দুধের হাঁড়ি বসান। দুধ ঠান্ডা হতে হতে তাতে সর বসে। শ্যামা মহানন্দে দুধের সর খায়। বড়দা কাতর চোখে শ্যামার সে দুধ খাওয়ার দৃশ্য দেখে অতীত কল্পনা করে কিনা কে জানে।
রাতে ভাত খাওয়া শেষে মা আয়োজন করে দুধের হাঁড়ি আনেন। আমাকে আর শ্যামাকে এক কাপ করে দেন। বড়দাকে পুরো এক গøাস। শ্যামা মাকে বলেÑ‘বড়দাকে এক গøাস করে দাও। আর আমাদেরকে কাপে করে। তাও ছোট্ট কাপ।’ মা শাসনের সুরে বলেনÑ‘চুপ কর। তোরা রোজগার করিস না।’
দুধ বিলিয়ে দিয়ে মা চলে যান। বড়দা তার গøাস থেকে আমাদের ছোট্ট কাপে দুধ ঢালতে ঢালতে বলেÑ‘খেয়ে পেল। মা দেখবে। শ্যামা, এই নে। আমার দুধের সবগুলি সর তুই খা।’ বলতে বলতে বড়দার গলা জড়িয়ে আসে। আমি বড়দাকে বলিÑ‘দাদা একটা কথা বলি?’ বড়দা শোনার আগ্রহ নিয়ে বলেÑ‘কি?’ আমি চুপচাপ বলিÑ‘তোমাকে বড্ড ভালোবাসি।’ বড়দা ¤øান হাসে। জানালার ফাঁক দিয়ে রাতের আশ্চর্য জোছনার আলো এসে বড়দার সেই ¤øান হাসির মুখেতে পড়ে। তখন সময়ের এই বদলে যাওয়া পর্বে এসে মনে হয় আজ আমরা কত সুখি। সুখ এসে আমাদের এই সংসারে ভর করেছে।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।