শুভ্র শোভন রায় অর্ক
ভাদ্রের শুরু থেকে বর্ষা ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়। মাঝে মাঝে এলোমেলো ঝড়ো বৃষ্টি যদিও ধুয়ে মুঝে দেয় প্রকৃতির ক্লান্তি, গাছের পাতার ধুলো মুছে সবুজাব প্রাণ ফিরে পায়, বৃষ্টি শেষে গরম ভাব বাস্প হয়ে উড়তে থাকে আকাশের দিকে, মাঝে মাঝেই ভীষন বজ্রপাত তবুও সব কিছু ছেড়ে হঠাৎই স্তবিরতা চলে আসে চারপাশজুড়ে….
একটু থমকে যাওয়া, একটু ক্লান্তি, হতাশা, নিরাশা, স্যাতস্যাতে কখনো বা রুক্ষতা যেনো সব কিছুতে। যদিও সেটা ক্ষনিকের। নতুন শুরু সময় ডাক দেয়, উৎসবের ভোরের আভাস দ্রুতই চলে আসে। খুব ভোরে বেরিয়ে পড়া কর্মজীবিরা দেখতে পারে মিঠে ভোরের আলো, চারদিকের ক্ষেত, মাঠজুড়ে বেড়ে ওঠা ছোট উদ্ভিদ, ঘাস, শস্যের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির কনা। ধূসর কালো পিচগলা রাস্তার দুধারের সুবিশাল কড়াই গাছে অসংখ্য রক্তলাল ছোটছোট ফুল, লাউগাছগুলোতে অনিন্দ্য সাদাফুল, কুমড়া গাছে হলুদ কুমড়ার ফুল । কলাগাছগুলোর হঠাৎ বেড়ে ওঠা নতুন টিয়েরঙা পাতায় পাতায় বাঁক , বুনো ঘাসের দলের সমাহার। যতদূর চোখ যায় সুফলা ধানের ডগা বাতাসে দুলতে থাকে, আপনাই বেড়ে ওঠা কচুগাছের সমাহার দেখা যায়। দোয়েল, শালিক, ঘুঘু, চড়ুই, বাবুই, কাটঠোঁকড়ারা কলকাকলিতে জানান দেয় বৃহৎ উৎসবের।
বাঙালীরা জেগে ওঠে আনন্দে। পাঁচদিনের উৎসবের জন্য তিনশো পঁয়ষট্টি দিন হিসেবগোনা আমরা আরাধ্য সেই মায়ের আগমনের উলুধ্বনি শুনতে পারি। শস্য-শ্যামলা বাংলার ঘরে ঘরে মহাআনন্দের সুর বয়ে চলে।
পুজোর প্রথম ঢেউ রঙ তোলে গণেশ চতুর্থীতে।
সিদ্ধিদাতা বাবা গণেশ একাই ঘুরে যান মর্ত্য থেকে, সকল শুভ কাজের প্রারম্ভ করে দিয়ে যান আর্শিবাদে। উপমহাদেশ সমারোহে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, রঙ খেলে উৎসবের ঢেউয়ে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে।
থালি ভরা লাড্ডু, নারু, মোয়া, পায়েশ, লুচি, সন্দেশ, মিষ্টি, হরেক রকম ফল ; আমরা প্রসাদ পেয়ে ধন্য হই । ।
পুজো দেখতে আসা মায়ের হাত ধরে থাকা ছোট্ট শিশু প্রশ্ন করে ” মা, দুর্গা পূজো তো পাঁচদিন হয় ; গনেশ পুজো তাহলে একদিন যে? ”
মা হাসে, বলে ” ক’দিন পড়েই যে আবার আসবে তাই ওকে মা দুর্গা বলে দিয়ছে একদিন থেকেই চলে যেতে ; দেখেছিস গনেশ মায়ের কথা কেমন শোনে ”
“তাহলে তুমি আমাকে আরো দুটো লাড্ডু দাও, আমিও তোমার কথা শুনবো ”
ওর মা হেসে ওঠেন ছোট্ট সোনার কথায়। হেসে ওঠে এই ধরনী….
ক’দিন পেরোতেই কৃষ্ণপক্ষের ঝড়ঝাপ্টায় জন্মাষ্টমী উৎসবের পালে আরো দোলা দেয়। কৃষ্ণনামের সুর বিমোহিত করে তোলে স্বর্গ-মর্ত্যে-পাতাল ত্রিলোক৷ এদিন মায়ের বেদির কাঠাম দিয়ে দুর্গাপূজার তোড়জোড় শুরু হয়। জেগে ওঠে মালিপাড়াগুলো। পূজার যে মাত্র মাস দুয়েক বাকী আর৷ তালের পিঠা, তালের বড়া, খেজুরের রসের সুস্বাদ শেষ না হতেই শুরু হয় নারকোলের নারুর কারুকাজ। গৃহস্ত বাড়িতে মুড়ি-মুড়কির খই ফোটে, তিল ঘোষে রোদে শুকিয়ে জ্বাল দেয়া হয় খেজুরের গুড়ে, সেই মিষ্টি সুগন্ধ দিক-বেদিক ছুটতে থাকে আশ্বিনকে ছুঁয়ে দিতে…
ভাদ্র শেষের দিকে প্রকৃতি দ্রুত বদলাতে থাকে যেনো। সন্ধ্যের পর হালকা হালকা কুয়াশা উড়ে বেড়ায়। চারদিকে নতুন ফুলের সুবাস, শুধু নতুনের গান, জলাশয়ে হৃদয়াকৃতি গাঢ় সবুজ পাতার মাঝে সাদা, লাল, গোলাপী শাপলা ফুলের সমাহার। শিশুদের দলের লম্ফঝম্পে ডোরাকাটা ঢ্যোড়া সাপেরা এঁকে বেকে পালিয়ে যায়। শাপলাফুল তোলা চলে৷ বিলগুলোতে শুভ্র পদ্মফুল আর বিশাল পাতায় ছেয়ে যায়, সেখানে হাঁসেরা দল বেঁধে জলকেলী করে, সাদা বকেরা হেঁটে বেড়ায়, ছোট ছোট শিশিরের ফোঁটা পদ্মের পাপড়ি চুয়ে পড়ে। থরে থরে বেগুনী পানাফুল চোখের দৃষ্টিকে বিশ্রাম দেয়। মন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, শরতের প্রথম সূর্যস্নানে আলোর বেণু মুছে দেয় অশুভ সকল চিন্তা৷
চারদিকে কি সুখ, কি সুখ। এত মধু, এত মায়া, এত তার রঙরস। ওপার বাংলায় ছমাস আগে থেকেই যদিও পুজোর রঙ লেগে যায়, বিশাল বিশাল পুজোমন্ডবের কাজ শুরু হয়ে যায়, কতশত মানুষের কর্ম জোগান হয়, নতুন নতুন চিন্তা, শিল্পকর্ম, নতুন কারুকাজ, ভিন্নতা, আদিমের সাথে বর্তমান, পুজোর মাধ্যমে সমাজে কল্যানময় বিশেষ কিছু বার্তা পৌছে দেয়া। মৃৎশিল্পের সম্ভাবনার প্রকাশে সহায়তা, দুর্দান্ত সব প্রতিমা। পুজো উপলক্ষ্যে কতশত বই প্রকাশ, সিনেমা, গান, নাটক, রং বেরঙের চিত্রকলা কি নেই৷
এপাড়ে আমরা একটু ধীরস্হিরে উৎসবের সানাই বাজাই। শরতের আগমনের সাথে সাথে আমাদের উচ্ছ্বাস বেড়ে চলে। একদিকে প্রতিমার কাজ চলে তো অন্যদিকে প্যান্ডেলের কাজ। মফস্বল শহরগুলোতে একটু কম বাজেটে বেশি আনন্দের চেষ্টা চলে, ছোট শহরে চেনামুখ-প্রিয়মুখ বেশি তাই উৎসবে সকলের সম্মিলিত একাত্মতাও হয়ত বেশি। উৎসব তো একা হয়না, যত মানুষ তত খুশি বাড়ে, সেটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বিশাল আবেগে রূপ নেয়, আরাধনায় রুপান্তরিত হয়। মাতৃ আরাধনা মানেই মঙ্গলের জন্য ব্রতী হওয়া। মন্দির, প্যান্ডেল করে পাড়ায় পাড়ায় চলে মহামায়ার স্তুতির প্রস্তুতি।
সনাতন পাড়ায়ও ঋতু পরিবর্তনের সাথে দুর্গাপুজোর দিনক্ষন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। ছেলেপেলেরা বারবার ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টিয়ে হিসেব কষে। প্রতিবারের মতই সবার টেনশন কাজ করে “পুজো হবেতো “, অনেকে বলে” আলবাৎ হবে”, ‘কেনো হবেনা’, অনেকে বলে দেখা যাক কি হয়…
মুখে মুখে কথা ঘোরে ” দেশের যে অবস্হা , অামাদের নিরাপত্তা দিবে কে ”
কেউ বলে ” আগে শরৎ বুঝিয়ে দিতো পুজোর আগমন, আর এখন বোঝা যায় সারাদেশে প্রতিমা ভাঙচুরের খবর পেয়ে,;সমাজ এখন সভ্যতার বিপরীতে বর্বরতায় ফিরে চলছে বুঝি!”
হ্যাঁ সকলে চিন্তায় থাকে, অস্তিত্বহীনতার ভয় গ্রাস করে বৈকি।
ছেলেপেলেরা বহু চাপে থাকে, ওদের তো নিজেদের মন্দির নেই, প্যান্ডেল করে পুজো। সার্বিক অবস্হা বিবেচনায় পুজো বন্ধ রাখলে কষ্টের সীমা রইবে না। একদিকে নিরাপত্তা আরেকদিকে আর্থিক দৈন্যদশা। দ্রব্যের উর্ধ্বগতি এতই বাড়ন্ত নম: নম: করেও পুজোর খরচ তোলা বিশাল চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু যে আবেগ, অনুভুতি, বিশ্বাস, ভালোবাসা জড়িত শারদ নিয়ে, মায়ের আরাধনার জন্য সব বাঁধা কাটিয়ে উঠতে দ্বিধা কেটে যায় দ্রুত৷
অনেকের মনে পড়ে এক যুগ আগের কথা। তখন পাড়ায় হতোনা দুর্গা পুজো। দিনরাত বিভিন্ন মন্দিরে ঘুরে বেড়াতো ওরা, কখনোবা নিজ জেলা ছাড়িয়ে অন্য জেলায়, ধুনুচি নাচে মতোয়ারাও হতো তবুও কেনো যেনো একটা অপূর্নতা রয়ে যেতো!
তারপর ওরা চিন্তাভাবনা করে কয়েকজন মিলে উদ্দ্যোগ নিলো পাড়াসুদ্ধ সকলের গনজোয়ার তুলতে। প্রথম বছর হয়ে হয়েও হলোনা তবে বড়দের সম্পৃক্ততা বাড়লো । ছোট্টপাড়ার এ দু:সাহস অবশ্য দ্রুত দোলা দিতে লাগলো সকলের মনে। কে চায় না মায়ের পুজো করতে। ধীরে ধীরে বছর ঘুরতেই বুড়ো থেকে শিশু সকলের বহু মতে-অমতে পূর্নতা পেলোই ইচ্ছেটা। ভালো কাজ কখনো ঠেকে থাকে না, আর স্বয়ং মায়ের ইচ্ছে ছাড়া তো এটা সম্ভবও না। বিশ্বাস হলো লৌকিক-অলৌকিকের একটা সম্মিলিত মিশ্রন যা নদীর স্রোতের মতই এগিয়ে চলে। প্রকৃতি ভালো বিশ্বাসে যেমন দুহাত ভরে ঢেলে দেয় তেমনি মন্দ চিন্তায় সবকিছু কেড়েও নেয়।
সনাতন পাড়ায় পুজোর মিটিংয়ে বরাবরের মতই সকলের সায় মিললে উলুধ্বনি দেয় মা-কাকিমারা, সকলে জয় মা বলে ধ্বনি দেয়। হইহুল্লোর লেগে যায়।
মালিকে ডেকে প্রতিমার অর্ডার দেয়া হয়। দ্রুত ডেকারেশন, লাইটিং, ঢাকি, পুরহিতের খোঁজ শুরু হয়। সাউন্ড সিস্টেম, বাজনা, ব্যানার, ফেস্টুন, নিমন্ত্রন পত্র, ইত্যাদির দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়। স্বেচ্ছাসেবকদের দল গঠন চলে।
পুজোর কত খরচ। হিসেব কষে কষে চাঁদা কালেকশন, এটা আনো ওটা আনো বারোআরি পুজোর এইতো মজা। সারাবছরের নিজেদের ঝগড়া বিবাদ মনোমালিন্য দ্রুত দূর হয়ে যায়, সম্পর্কের জোড়া লাগে, মায়া-মমতা বাড়ে। পুজো মানেই শুধু পাওয়া।
বিশ্বকর্মা পুজো এসে যায়, হইচই পড়ে দ্বিগুন । কন্যা সংক্রান্তির দিন মহাধুমধামে প্রতিষ্ঠান, বাড়ি, দোকানে, বিশেষ করে যানবাহন ব্যবসায়ী বা অন্যান্য ব্যবসায়ীরা মহাসমারোহে পুজো পালন করে । ধুয়ে মুছে চকচকা ঝকঝকা সব কিছু, মহালয়ার বাকী থাকে আর তো মাত্র দিন দশেক । প্যান্ডেলও প্রায় রেডি হয়ে যায়। সনাতন পাড়ার ছেলেপেলেরা হিসেব কষে উৎসবটা জাক জমক করার, নতুনত্বের খোঁজ চলে, যথারীতি মন্ত্র প্রতিযোগীতার আয়োজন হবে সপ্তমীতে, আট থেকে আশি সকলেই স্বতস্ফুর্ত ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। সন্ধ্যা থেকে আরতি প্রতিযোগীতা চলতে থাকবে। অষ্টমীর সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হবে ছোটদের ” মহিষাসুর বধ ” নাটক। তারপর গান, নৃত্য পরিবেশনা। নবমীতে হবে শুধুই ধুনুচি নাচ, আরতি, বাঁধভাঙা উল্লাস।
আচ্ছা আর?
ওরা একে অপরের দিকে তাকায়। আর কি?
কিছু সময় বয়ে যায়। ওদের বহুদিনের একটা শখের ইচ্ছেটা এবারো জেগে ওঠে। সাহস করে ওরা।
” সবাইকে বললেই কিন্তু সাহায্য করবে ”
” কারো কাছে এ ব্যাপারে সাহায্য না নিলে কেমন হয় ”
“মন্দ হয়না”
” ধরো নিজেরাই যা পারি দিয়ে করি এবার , এটা হোকনা শুধু আমাদের মাধ্যমেই ”
” হ্যাঁ হয়ত কম দিতে পারবো, দু’ একজনকে দিতে পারবো, করিনা, হোক একবার ”
“কিন্তু শর্ত একটাই, কোন ছবি তোলা, লোক দেখানো চলবে না ”
“সেটাই হোক ”
পুজোর রঙ কিভাবে যে প্রকৃতি ছড়িয়ে দেয় সেটা স্বয়ং ওই ঈশ্বরই জানেন। ডানপিঠে ছেলেপেলেরা ভিতর থেকে বড় হয়ে ওঠে। পুজো ছেলেমানুষ থেকে আমাদের মানুষ করে গড়ে তোলে । মহালয়ার ভোরে প্রতিটা বাঙালী জেগে ওঠেন, রেডিও-টিভি-অনলাইনে বেঁজে চলা বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠের বলিষ্ঠ মন্ত্রোচ্চারন আধকুড়েকেও বিছানা ছাড়তে বাধ্য করে। আমাদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় অবশেষে। আমরা পিতৃপক্ষ থেকে দেবীপক্ষে প্রবেশ করি। এদিন সকাল সকাল প্রতিমা আনায়ন হয়, তারপর চলে রঙের কারুকাজ।
মহালয়ার সকালে পূর্বপুরুষদের এবং ইহলোক থেকে গত হওয়া পৃথিবীর সকলের আত্মার শান্তির উদ্দেশ্যে পার্বন শ্রাদ্ধ করা হয়, তর্পন চলে৷
ছেলেপেলের দল কাজ ফাঁকি দিয়ে নদীর ধার ধরে এগিয়ে চলে। নদীর দুধার ধরে কাশফুলে ছেয়ে গেছে। সুবিশাল নীলাকাশে তুলোর মত শুভ্র মেঘ। মেঘগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে৷ শরতের আকাশ কতই নির্মল, সুন্দর। দূরে থেকে ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসে । ওরা কাশবনের মাঝ দিয়ে এলোমেলো দৌড়ে চলে। নদীর ধীরস্রোতে তর্পনের বেলপাতা,ফুল, নৈবেদ্য আর প্রদীপ ভেসে যায়।
ওরা জনবহুল জীবনে ফিরে আসে, খুঁজে ফিরে কিছু মুখ । আর, শরতের সকালে শিউলীর সুবাসে দেবীপক্ষ চলতে থাকে নতুন নতুন গল্পের সূচনায় ঢাকের তালে তালে ।
গল্পকার
থানাপাড়া, লালমনিরহাট