[মুখবন্ধ: করোনা কবলিত বদ্ধ জীবনে কিছুটা একঘেয়েমি কাটানোর জন্যেই এই গল্প গল্প খেলাটি আমার প্রিয় দিদি-সহকর্মী পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায়ের সাথে শুরু করেছিলাম৷ দিদির আন্তরিক আগ্রহ ও সহযোগিতায় লেখাটি বেশ কয়েক পর্ব চালাতে পেরেছিলাম৷ ছাইলিপি-র সম্মাননীয় সম্পাদকের সৌজন্যে লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হওয়ার অনুমোদন পেয়েছে ৷ সম্পাদকমন্ডলীকে আমাদের দুজনের পক্ষ থেকে অজস্র ধন্যবাদ। আমরা যে যে অংশটি লিখেছি লেখার শুরুতে তার নাম উল্লেখ করা আছে ৷]
প্রথম পর্ব:
(গৌতম সরকার)
ট্রেনটা স্টেশন ছাড়ল ২২শে মার্চ ঠিক সকাল সাতটায় ৷ আমাদের গন্তব্য অনিশ্চিতপুর ৷ এবারের এই ভ্রমনযাত্রা একটু অন্যরকম। আমার জীবনে এইধরণের ভ্রমণের সুযোগ এই প্রথম ৷ এর আগে সব জায়গায় যাওয়ার আগে পত্রিকা আর গুগলবাবার দৌলতে জায়গাটির হালহকিকত, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, জলবায়ু-বৃষ্টিপাত, নারী-পুরুষের অনুপাত, বিশ্বসুন্দরী-পৃথ্বীসুন্দরীর ইতিহাসে জায়গাটির অবস্থান দেখে ঠিক করতাম জায়গাটি আদৌ আমার মতো উঠতি আঁতেলের পক্ষে ভ্রমণের যোগ্য কিনা ৷ সত্যি কথা বলতে কি এবারের বেড়ানোটা যেন কেউ আফিম খাইয়ে আমাকে দিয়ে করিয়ে নিল ৷ কোনো এক প্রতিজ্ঞাপত্রে সই করিয়ে আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিল–তোমাকে যেতে হবে সেই দেশে…… যেখানে আকাশ রঙের নেশায় গোলাপি মাতাল, হলুদ ছোপানো ভোরের আকাশে সূর্যোদয় হয় তাবড় শিশুদের সম্মিলিত হাঁসির আওয়াজে, সারাদিন কাটে তামাম মরদের কষ্টিপাথরে কোদাল হেনে, যেখানে সবাই সবাইকে ভালোবাসে, আর শেষ বিকেলের কামরাঙা সূর্য আকাশ-বাতাস, দিক-চক্রবাল ভরিয়ে তোলে আগমনী আজান গানে হিন্দু-মুসলিম-জৈন-খ্রিষ্টানের আন্তরিক যৌথ নিমন্ত্রনে ৷ তাই চলেছি সেই প্রিয়-ভালোবাসা জারানো অনিশ্চিতপুরের সন্ধানে ৷ দেখতে দেখতে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল ৷
(পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায়)
কামরায় দেখলাম আমার মতোই অদভুতুরেদের ভিড়। অজানা দিকশূন্যপুরের (নীললোহিতের নয়) উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছে অনেকে। স্বপ্ন ফিরি করছে এক হকার। দিকদর্শনের দিশা দিচ্ছেন কেউ, কারো গন্তব্য কিন্তু এখনো স্থির হয়নি। ইতিমধ্যে ঘটিগরম ওয়ালার প্রবেশ। সে বেশ টাটকা গরম মুখরোচক সরেস খবরাখবর রাখে। সে বলল , এইমাত্র আগের ট্রেনেই কিছু অনিশ্চিত পুরের যাত্রীর কাছ থেকে গরমাগরম হালহকিকৎ জেনেছে সে। সবাই মিলে ঘিরে ধরল তাকে। হঠাৎ একজন ঝালমুড়ির ঠোঙায় আবিষ্কার করে ফেললো পথনির্দেশ। সামনেই অজানা গাঙ পেরিয়ে যেতে হবে নিরুদ্দেশের, সব পেয়েছির দেশে। পোটলা পুটলি লোটাকম্বল যার যেটুকু সম্বল সব নিয়ে চলল প্রস্তুতিপর্ব। ট্রেন থামতেই ছুট্ ছুট্ । সেখানে পোঁছোবার তাগিদতো সবারই। শুণ্ডিও নয় হুণ্ডিও নয় একেবারে ভালবাসার সন্ধানে অনিশ্চিতপুরে যাত্রা। সত্যিই ভালবাসা বা ভাল বাসা দুটোইতো অনিশ্চিত। কত দুরূহ পথ পর হয়ে তার নাগাল কেউ পায় কেউ পায়না।
(গৌতম সরকার)
অনিশ্চিতপুরের সব কিছুই অন্য রকমের। মানুষজন হাসিখুশি, কিন্তু কম কথা বলে। আমাদের কটেজে দেখাশোনা করার জন্যে একটা অল্পবয়সী বউ আছে, নাম শকুন্তলা। কালিদাসের শকুন্তলার মতোই মাথায় জড়িয়েছে বেলফুলের মেলা। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে প্রশস্ত উঠোনে বসে দিকচক্রবালকে সাক্ষী রেখে মেয়েটির সাথে গল্প শুরু করলাম। মেয়েটির বাড়িতে একটি ছোট বাচ্চা আর স্বামী আছে। স্বামীর ফুলের চাষ। বাড়ির সামনে দু-চার বিঘা জমিতে তারা স্বপ্ন রং দিয়ে ফুল ফোটায়। ভোরের কুয়াশা প্রতিটি ফুল ধুয়ে-মুছে পবিত্র করে, তারপর সেগুলো দিয়ে দুজনে মালা গাঁথে । মালা গাঁথতে গাঁথতে তাদের চোখের সামনে প্রতিদিন আরোও একটা মিষ্টি ফুল ফুটে ওঠে- দেড় বছরের বাচ্ছা সকালে চোখ মেলে সামনে বাবা-মাকে দেখে সারা মুখ এক স্বর্গীয় হাঁসিতে ভরিয়ে তোলে। তারপর তার স্বামী সেই সব মালা নিয়ে ভালোবাসা ফেরি করতে বেরিয়ে যায় দূরের হাটে। আর সংসারের টুকটাক কাজ সেরে ছেলেটাকে নিয়ে মেয়েটি চলে আসে এই কটেজের কাজে। এই কাজটা সে কদিন আগেই পেয়েছে, এই কটেজের মালকিন নীলা মাসি খুব ভালো মানুষ। তিনি এই এলাকার উন্নতির জন্য বিশেষ করে এলাকার মেয়েদের উন্নতির জন্য দিনরাত খেটে চলেছেন। এই কটেজেই মেয়েদের হাতের কাজ শেখার এক পাঠশালা আছে। কটেজের ফাইফরমাশ সেরে শকুন্তলা সেখানে পাটের ব্যাগ তৈরির কাজ শেখে। বিকেলটা শকুন্তলার সঙ্গে গল্প করে সুন্দর কেটে গেল। যতক্ষণ গল্প চলল শকুন্তলার ফুলের মতো শিশুটি সারা উঠোন জুড়ে খেলে বেড়ালো। যেন মনে হলো প্রকৃতি মায়ের বুকে ঘুরে ঘুরে সে আদর ভালোবাসার আলপনা দিচ্ছে।
সূর্যাস্ত যে এত গভীর হতে পারে আগে জানতামনা। সারা আকাশ লাল রঙের আবিরে ছেয়ে গেল, আর তার মধ্যে কামরাঙা হলুদ সূর্য সেই লাল প্রেক্ষিতের বুকে ধীরে ধীরে নিজেকে মিলিয়ে দিল। আশ্বর্য এক মনখারাপ ছেয়ে গেল বহুদূর নিজ ঘর, পরিবার-পরিজন ফেলে আসা মানুষ গুলোকে। সবাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদের সবাইয়ের চোখে জল , টলটল চোখে দুহাত তুলে অসীম প্রকৃতির অযুত শক্তিকে তারা একযোগে প্রণাম জানাচ্ছে।
(পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায়)
মনে পড়ল অচিন গাঙের নাইয়াকে, যে এই সুন্দর অচিনপুরে পৌঁছে দিল অনিশ্চিতপুরের যাত্রীদের। আচ্ছা ওরও কি ইচ্ছে হয় একঘেয়েমির দাঁড় বাওয়া ছেড়ে অনিশ্চিতপুরে পাড়ি জমাতে? হয়তো বা! কিন্তু বৈঠা দাঁড় তাকে ছাড়তে চায় না যে। সেই যে ছোট্টবেলায় দোহারের মতো ভাটিয়ালির সুরে গলা মিলিয়েছিল বাপঠাকুর্দার সাথে সেই সুর মনে গেঁথে আছে তার,মন খারাপের অভ্যাস তার নেই , আছে শুধু দিনযাপনের উজান ঠেলে এগিয়ে যাওয়া। আর সর্বক্ষণের সঙ্গিনী ঐ নদী ? কখনো উচ্ছল কখনো প্লাবন কখনো বা জল শুকিয়ে নাব্যতায় ক্ষরা, ঠিক জীবনের মতো। পেছনে ফেলে আসা কল্লোলিনীকে মনে পড়ে গেল হঠাৎ। তার ধূসর আকাশে যদি রামধনু রঙের হতো নিত্য আনাগোনা তবে কি খুঁজতে হতো অনিশ্চিতপুর? আর ঐ যে শকুন্তলা সেও কি অবহেলার অন্ধকারে নির্বাসিত নয়? ওর দুষ্মন্ত স্বামীটি… সে কি শহরে ভালবাসার ফুলমালা বেচতে গিয়ে কোন মদিরেক্ষণার আঁখিপল্লবের ডাকে সাড়া দেয়নি কখনো? এইসব শহুরে জটিলতা খেলে যায় মনে।
দেবশিশুর মতো শকুন্তলার ছেলেটি, থুড়ি সর্বদমন মন জয় করে নিয়েছে সবার। আপাতত সবাই তাকে নিয়েই ব্যস্ত। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামছে এই অনিশ্চিতপুরে। এই সময়টা বড়ই মনখারাপের। কোন ফেলে আসা প্রত্যন্ত ছেলেবেলা উঁকিঝুঁকি মারে মনের আঙিনায়। কাজলা দিদি, গল্পবুড়ি ঠাকুমা, দিদিমারা হাতছানি দিয়ে ডাকে। আলো আঁধারির খেলা চলে মনে আর কোণে। সেই সাঁকো পেরিয়ে যদি পোঁছে যেতুম সেখানে, আবার কি ভাল লাগতো সেই রূপকথায় মোহাবিষ্ট হয়ে থাকা? দুয়োরাণীর দুঃখে কি এখনো কি চোখ জলে ভরে যেতো? পক্ষীরাজ ঘোড়ার সওয়ার হয়ে অচিনপুরে যেতে পারতাম? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নীলা মাসির সঙ্গে দেখা। কেজো ব্যস্ততায় ক্ষমা চেয়ে নিয়ে জানালেন এখানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা নেই তাই মেপেজুপে আলো দেওয়া হয় । সন্ধ্যায় জোনাকির আলোই ভরসা। এ সময়ে শুক্লপক্ষে অপর্যাপ্ত চাঁদের আলো আর কৃষ্ণপক্ষে তারার আলোই সম্বল। রাতে শুধুমাত্র প্রাত্যহিক কাজে আলোর ব্যবহার সীমিত। আমার আবার রাতের তারাহীন আকাশ দেখলেই গা ছমছম করে। দেখা যাক কি হয়! অনিশ্চিতপুরকে চিনতে জানতে আত্মস্থ করতে হবে যে। “এতদিন যে বসেছিলেম পথ চেয়ে আর কাল গুণে…।”
পরের সকালে সূর্যের রক্তিম আভায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচলাম , কেন তা বলি – গতকাল রাতে এক দূরাগত আর্ত চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল, সেই ছোটবেলায় তিস্তার বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর একজন চিৎকার করে সতর্ক করে দিতে দিতে জল ভেঙে চলে গিয়েছিল অনেকটা গভীরে সেই স্মৃতিকেই যেন উস্কে দিল ঐ তীক্ষ্ণ আর্তস্বর। বলাবাহুল্য সেই প্রবল স্রোতে লোকটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মনটা তখন থেকেই বিষণ্ণতায় ভরে আছে। ছেলেবেলার সব স্মৃতিই কি মধুর হয়? না বোধ হয়। এক সরস্বতীপুজোয় দলে দলে সাজগোজ করা মানুষ ছুটছে, গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে সদ্য যৌবনে উপনীত ক্লাস টেনে পড়া এক অভিজাত পরিবারের ছেলে, দ্রষ্টব্য জানালা দিয়ে দৃশ্যমান সেই ঝুলন্ত দেহ। এখনো শিউরে উঠে গায়ে কাঁটা দেয় সেই স্মৃতি। যাক, গতকাল রাতের ঘটনার প্রতিক্রিয়া কারুর মধ্যেই দেখলামনা। কৌশলে জানবার চেষ্টা করলাম। না কোন বিরূপ অভিজ্ঞতার কথাতো কেউ বললেন না। আমারই মনের ভুল হয়তো। আসলে নিঃসঙ্গতায় অতীতের অশরীরীরা জাঁকিয়ে বসে মনের ভেতর। সেই গানটা – একটা অনুষ্ঠানে যে ছোট্ট মেয়েটি গেয়ে মন জয় করেছিল আরেকটি ছোট্ট মুগ্ধ শ্রোতার সেই গানটি এখনো বিষণ্ণতার গান শোনায় ষাটোত্তীর্ণ এক মহিলাকে কারণ সেই শ্রোতা মেয়েটি গভীর বিষাদে ডুবে গিয়েছিল ছোট্ট গায়িকাটির মৃত্যু সংবাদে। কেন এসব কথা মনে হচ্ছে আজ? অনিশ্চিতপুরের সুখের আবহে দুঃখবিলাস নয়তো? তিলোত্তমার সুখের বিপননেও তো আগ্রহ নেই এতগুলো মানুষের। তবে অনিশ্চিতপুর কি দুঃখবিলাসীদের আশ্রয়?