সারাদিন ধরে বাতাসের কোনো ছিঁটে-ফোঁটা নেই। মাঝ রাতে একটু বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এই ভর দুপুরে সেই স্মৃতি মলিন হয়ে গেছে। তীব্র কাঠফাটা রোদে শরীরের লোমকূপগুলো যেনো বড্ড ব্যস্ত সময় পার করছে। এক কথায় আজকের পরিবেশটা বেশ বৈরী। এই বৈরী পরিবেশেও দবির মিয়া রাস্তায় বের হয়েছে। সাথে চিরচেনা সঙ্গী, তার রিকশা। দবির মিয়া ভেবেছিল সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাইরে পা রাখতে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। দবির মিয়ার শরীরটা ক’দিন ধরেই কথা শুনছে না। পরিশ্রম করতে যেন তার বড়ই আপত্তি। তাই ইদানীং ঘুম ভাঙতে বেলা দশটা বেজে যায়। ঘুমের এরূপ আধিক্যতা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেলে তো মহাবিপদ। এসব অভ্যাস মানায় হলো লাট সাহেবদের। এভাবে আরাম আয়েশে জীবন কাটালে পেটে ভাত যাবে না সেকথা দবির মিয়া জানে। তার কাছে আরাম আয়েশের অপর নাম হলো অসুখ। এই অসুখ বাঁধানো নিষেধ। পুরোপুরি নিষেধ।
ক’দিন ধরেই বাড়ির ছোট মেয়েটা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। সে যে অভিমান করেছে তা প্রতিনিয়ত তার কথা বা কার্যকলাপে প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি দবির মিয়াও মেয়ের রাগের উত্তাপ হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করতে পারছেন। এই গতকালের কথাই ধরা যাক। দবির মিয়া বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে হাঁক ছেড়ে ডাক দিয়ে বলল,
– “মুন্নী, কই রে মা মুন্নী।”
– “কি হইছে? ডাকো ক্যান?”
কর্কশ কন্ঠে মেয়ের কাছ থেকে জবাব আসে। দবির মিয়া প্রতিত্তুরে বলেন,
– “গামছাটা একটু দিয়া যা তো মা। গোসলডা সাইড়া আসি।”
– “আমি পারুম না। তুমি নিয়া যাও। সব গামছা হারায় গেছে গা।”
উত্তর শুনে দবির মিয়া চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। তার ছোট মেয়েটা হয়েছে একটু জেদি। মেয়েটার ইচ্ছে অনুযায়ী কোন চাওয়া পূরণ না হলেই এরকম বিরূপ মনোভাবের দেখা মেলে। এবারের মন খারাপের পেছনে কারণ হলো সামনের ইদ। বেশ কিছুদিন আগে মুন্নী বলেছিল এবার ইদে সে নিজে মার্কেটে গিয়ে জামা কিনবে। দবির মিয়া তখন না করে নি। ভেবেছে, ইচ্ছে যখন হয়েছে যাবে। কিন্তু এই ইচ্ছে পূরণ করতেই এখন হিমশিম খাচ্ছে দবির মিয়া। মেয়েটাকেও আজ না কাল, কাল না পরশু বলে সে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। এভাবে পাশ কাটিয়ে যেতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই। দেশে লকডাউন চলছে। মানুষ জনের যাতায়াত বন্ধ। দবির মিয়ার আয়ের উৎস বলতে ওই এক রিকশা। রিকশার যাত্রী পাওয়া না গেলে, টাকা আসবে কোত্থেকে?
এদিকে ইদের আগে দোকানদার সব টাকার জন্য মুখিয়ে বসে থাকে। বাকি পরিশোধ করতে হয়। বড় মেয়ে রুশনির বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক হলো। মেয়ের জামাইকে ইদ উপলক্ষে কিছু না দিতে পারলে বাঁধবে মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি। মেয়েরও কম কথা শুনতে হবে না। শ্বশুর বাড়ির কিছু লোক, থাকেই নতুন বউয়ের ভুল ধরার তালে। বাবা হয়ে সে বড় মেয়েটাকে কটু কথার মুখে কীভাবে ফেলে রাখবে? দবির মিয়া চিন্তায় ডুবে যায়। জীবনটাকে দুর্বোধ্য মনে হয়। তবে চিন্তার বৃক্ষ ডালপালা মেলবার আগেই তার ঘোর কেটে । সুফিরার কণ্ঠ কানে ভেসে আসে। সে ডেকে বলে,
– “দাঁড়ায় আছেন ক্যান? গোসল করবেন না? বেলা পইড়া যাইতাছে।”
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দবির মিয়া লক্ষ্য করে সুফিরা একটা গামছা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে হয়তো মুন্নীর কথা শুনতে পেয়েছিল। তাই মেয়ের উপর ভরসা না করে নিজেই গামছা নিয়ে এসেছে। দবির মিয়া আর দেরি করে না। সে পা বাড়ায় পুকুর পাড়ের দিকে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে সুফিরার কথা। বিয়ের পর থেকে সুফিরা মুখ ফুটে কখনো কিছুই চায় নি। তারও নিশ্চয়ই কোন না কোন শখ আছে। কিন্তু সেগুলো আলোর মুখ দেখে না। আহারে! কী কষ্ট! নিজেকে দবির মিয়ার সম্পূর্ণ ব্যর্থ মানুষ মনে হয়। সে ভাবে, গোসল করলে যেমন শরীরের ময়লা ধুয়ে মুছে চলে যায়, তেমনি কোনভাবে কি জীবনের না পাওয়ার কষ্ট গুলোকে ধুয়ে ফেলা যায়? উত্তর অজানা।
বিকেল সন্ধ্যায় বিলীন হবে হবে ভাব। এমন সময়ে দাবির মিয়া রিকশা নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। সেই দুপুর থেকে এ পর্যন্ত বাইরে থেকেও খুব একটা লাভ হয় নি। লোকজনই যদি না থাকে রিকশায় উঠবে টা কে? মোটে মিলে আয় হয়েছে দেড়শো টাকা। এই টাকা দিয়ে আজকাল কী হয়? কিছুই হয় না।
রিকশা এখন নির্জন রাস্তায় ঢুকেছে। সামনেই বিশাল একটা মাঠ। মাঠ পার হতেই বাম দিকে পড়বে একটা প্রকাণ্ড আম গাছ। আম গাছ পার হয়ে ডান দিকে মোর নিতে হবে। দৃশ্যপট সবই জানা দবির মিয়ার। তাই সে নির্লিপ্ত মনে রিকশা চালিয়ে যায়। তবে এই নির্লিপ্ততা বেশিক্ষণ টিকে থাকে না। রিকশাটা আম গাছের পাশে আসা মাত্রই দবির মিয়া রিকশার ব্রেক কষে দাঁড়ায়। সে কিছু একটা দেখেছে। জিনিসটা আম গাছের গোড়ায় পড়ে আছে। কী ওটা? দবির মিয়ার কৌতূহল হয়। সে কৌতূহল মেটাতে রিকশা থামিয়ে আম গাছের কাছে চলে আসে। কাছে আসতেই তার চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে যায়। একি! এখানে বেশ কিছু টাকা পড়ে আছে। সে একবার আশেপাশে তাকায়। নাহ লোকজন নেই এদিকে। দবির মিয়া ইতস্তত ভঙ্গিতে টাকাগুলো তুলে নেয়। গুনতে গিয়ে বুঝতে পারে দশটা পাঁচশো টাকার নোট অর্থাৎ পাঁচ হাজার টাকা। এই টাকাগুলো কার? এখানে এলো কী করে? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায় তার মনে। তবে সব ছাপিয়ে যে প্রশ্নটার গুরুত্ব বেড়ে যায় তা হলো, এই টাকাগুলো কি দবির মিয়া নেবে নাকি নেবে না? তার মনে দোটানা জেঁকে বসে। সে বেশ খানিকটা সময় স্থির দাঁড়িয়ে থাকে আম গাছের নিচে। একটা সত্তা বলছে এই অভাবের সংসারে টাকাগুলো খুব প্রয়োজন। কিন্তু আরেকটি অদৃশ্য সত্তা চরমভাবে বাঁধা দিচ্ছে টাকাগুলো নেওয়ার ব্যাপারে। এ এক অদ্ভুত অচেনা অনূভুতি। মনটা পুরোদস্তুর দোদুল্যমান অবস্থায় আটকে থাকে। এই দ্বন্দ অবসান হতে বেশ কিছুটা সময় কেটে যায়। একটা পর্যায়ে তথাকথিত ভালো সত্তার জয় হয়। দবির মিয়া টাকাগুলো যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দেয়। ভাবে, টাকাগুলো নিশ্চয়ই অন্য কারো হবে। থাকুক। অন্য কারো টাকা নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে কোন সার্থকতা নেই। কপালে যা আছে তাই হবে। দবির মিয়া পরক্ষণেই টাকার নোট রেখে রিকশায় চেপে বসে। যদিও টাকাগুলো তাকে টানছে, তবুও সে বদ্ধপরিকর। এই টাকা সে নেবে না। দবির মিয়া প্যাডেল করে রিকশাটাকে এগিয়ে নিয়ে যায় বাড়ির দিকে। তার শরীরে এবং মনে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করে। সে জানে না আর কতদিন এভাবে ব্যর্থ স্বামী, ব্যর্থ বাবা হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। সত্যিই জানে না।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। দবির মিয়া তার নিজ ঘরের বিছানায় শুয়ে আছে। এমন সময় সুফিরা ঘরে ঢুকল। সে বিছানার একপাশে বসে বলল,
– “মাইয়াটারে নিয়া যাবেন না? ইদ তো আইসা পড়ল।”
– “তুমিও এই কথা কও? জানো না সংসারের অবস্থা?”
এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উত্তর দেয় দবির মিয়া। তবে সেদিকে আজ বিশেষ খেয়াল নেই সুফিরার। সে মুচকি হেসে বলে,
– “এতো চিন্তা কইরেন না। ব্যবস্থা একটা হইবো। মাইয়াটারে নিয়া যান।”
– “শুধু নিয়া গেলেই হইবো? টাকা ছাড়া কিইন্যা দিমু কী? মনে যা আসে তাই কইতাছো। মাথা গরম করাইও না কইলাম।”
– “আজকেও টাকার কথা কইবেন? আমি তো ভাবছি..”
সুফিরা কথা শেষ করতে পারে না। দবির মিয়া রাগান্বিত স্বরে বলে,
– “কি ভাবছো? আইজ টাকার বৃষ্টি হইবো? নাকি জ্বিনের বাদশা আইসা টাকা দিয়া যাইবো?”
এ ধরণের আক্রমণাত্মক কথা শুনে সুফিরার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। এরপর খুব অপ্রস্তুত ভাবে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তার আর কথা বলার ইচ্ছা নেই। সে অন্য ঘরের দিকে পা বাড়ানোর পূর্বে দবির মিয়াকে উদ্দেশ্য করে শুধু বলে,
– “এই যে নেন, এগুলো আপনার জামার পকেটে পাইছি।”
কথা শুনে দবির মিয়া চোখ মেলে তাকায়। সে দেখতে পায় সুফিরা কিছু একটা বিছানার উপর রেখে চলে গেছে। ভালো করে লক্ষ্য করতেই দবির মিয়া বড়সড় একটা ধাক্কা খায়। বিছানার উপর টাকার একটা বান্ডিল পড়ে আছে। দবির মিয়া নোট গুলো হাতে তুলে নেয়। টাকা অংকটা গুনে দেখে। এখানে পাঁচশো টাকার মোট দশটি নোট আছে। অর্থাৎ মোট পাঁচ হাজার টাকা। এই টাকার নোট গুলো তার খুব পরিচিত। সে আজ বিকালের দিকেই আম গাছের গোড়ায় টাকাগুলো কুড়িয়ে পেয়েছিল। কিন্তু এই টাকা তার পকেটে এলো কী করে? প্রশ্নটা মনে উদয় হতেই তার ভ্রু কুঁচকে যায়। তার স্পষ্ট মনে আছে যে সে টাকার নোট সেখানেই রেখে এসেছিল। এতে কোন ভুল হতেই পারে না। তবুও টাকার তোড়া বাড়িতে কী করে চলে এলো? দবির মিয়া বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ভাবে। ভেবেও কোন কূল কিনারা করতে পারে না। ঠিক এই মুহূর্তে তার কেন যেন নিজেকে আরও বেশি অসহায় মনে হয়। ভাগ্যের এই আলো আঁধারের খেলায় দবির মিয়া শুধুই নিষ্ক্রিয় দর্শক। কখনো অযাচিত আলো এসে সুখের জোয়ারে ভাসাবে। আবার কখনো আঁধার এসে অতলে ডুবিয়ে দিয়ে যাবে। আর সে শুধু হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। এই কি তবে জীবন? কে জানে! ভাগ্যের ধুপ ছায়ার স্রোত কি দবির মিয়ার সংসারে তবে সুখের জোয়ার নিয়ে এলো? এতো ভেবে লাভ নেই। সে নিতান্তই ক্ষুদ্র মানুষ। তার জন্য আপন মানুষদের নিয়ে ভাবনাটাই মুখ্য। তাদের ভালো থাকা টুকুই প্রত্যাশা।
দবির মিয়া কল্পনার জগত থেকে ফিরে আসে। অনেক কাজ বাকি। কাল রুশনির শ্বশুর বাড়িতে কিছু জামা কাপড় কিনে পাঠাতে হবে। ছোট মেয়ে রাগ করে আছে। রাগ করেছে সুফিরাও। তাদের রাগ ভাঙতে হবে। দবির মিয়া আর দেরি করে না। হাঁক ছেড়ে ডাকে। ডেকে বলে,
– “মুন্নী, কই রে মা মুন্নী।
– “কও শুনতাছি।”
গা ছাড়া ভাবে উত্তর আসে। দবির মিয়া প্রতিত্তুরে বলে,
– “জলদি কইরা তৈরি হইয়া নে। আর বাপের উপর মন খারাপ কইরা থাকা লাগবো না। চল তোরে মার্কেটে নিয়া যাই।”
– “সত্যি?”
চাপা উত্তেজনায় জিজ্ঞেস করে মুন্নী। তার কণ্ঠে কিছুটা অবিশ্বাসের ছাপ। কিন্তু দবির মিয়া অবিশ্বাসকে বিশ্বাসে রূপ দিতে আবার সজোরে ডেকে বলে,
– “হ রে মা, আর দেরি করিস না।”
একথা শুনে মুন্নী একরকম লাফিয়ে ওঠে। উচ্ছাস নিয়ে তৈরি হতে থাকে। আর এই ফাঁকে দবির মিয়া আরেকবার হাঁক ছেড়ে ডেকে বলে,
– “তোর মায়েরেও সাথে নিয়া নে। আমি বাইরে গিয়া দাঁড়াইলাম।”