জোবায়ের রাজু
সুমির মৃত্যু সংবাদটা প্রথমে লিটনের কাছেই শুনি। আমাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত কাঁদলো লিটন। সুমির ক্যান্সার ছিলো। ওর মৃত্যুর জন্যে আমরা আগেই প্রস্তুত ছিলাম। তাই হয়তো বোনের এই মৃত্যু আমাকে সেভাবে শোকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। কিন্তু আমার খারাপ লাগতে শুরু করলো সুমির চার বছরের ছেলে মেহেরাজের জন্যে। কি হবে এই অবুঝ শিশুটার! এসব যতই ভাবছি, ততই আমার বুকের ভেতর ভাঙছে।
২.
আজ সুমির মৃত্যুর সাতদিন। সন্ধ্যায় লিটন মেহেরাজকে আমার সামনে এনে বলল, ‘ভাইজান, ওকে আপনার কাছে রাখেন। মায়ের জন্যে খুব জ্বালাচ্ছে। আপনি সুন্দর সুন্দর গল্প পারেন। মেহেরাজ সেসব গল্প শুনে মায়ের কথা ভুলে যাবে।’ বলেই লিটন অঘোরে কাঁদতে লাগলো।
আমার বলা ভূতের গল্প শুনলে মেহেরাজের চোখে মুখে ভয় জেগে উঠে। শিশুদের ভয় দেখানো ঠিক নয়। তবুও এই বাচ্চাকে আমার এখন ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে ওর মানসপট থেকে মায়ের স্মৃতি মুছে ফেলতে হবে। স্বর্গ থেকে সুমি দেখছে আমি ওর সন্তানকে ওর সমস্ত স্মৃতি মুছে ফেলার আয়োজনে মেতেছি। সেজন্যে নিশ্চয়ই ভাইয়ের প্রতি ওর অনেক অভিমান!
সামিয়া চায় না মেহেরাজ এখানে থাকুক। অভিযোগের সুরে সামিয়া বলে, ‘ওকে ওর বাপের কাছেই রেখে আসো। মায়া জন্মে গেলে ও এখান থেকে যেতে চাইবে না।’ আমি বললাম, ‘যেতে না চাইলে যাবে না। থাকুক না এখানে। আমাদেরতো কোনো সন্তান নেই। বিয়ের দশ বছরেও তো মা হতে পারলে না। সুমির ছেলেকে নিজের সন্তান হিসেবে ভেবে নাও।’ সামিয়া তাচ্ছিল্যে বলে, ‘দরকার নেই। বড় হয়ে ও যে আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে!’ আসলে এসব সামিয়ার অজুহাত মাত্র। ও চায় না মেহেরাজ এখানে থাকুক। মা হারা সন্তানদের এই এক সমস্যা। কেউ ওদের বুঝতে চায় না। আচ্ছা লিটন যখন আবার বিয়ে করবে, লিটনের সেই বউ কি মেহেরাজকে বুকে আগলে নেবে! নাকি সামিয়ার মত অবহেলার চোখে দেখবে!
৩.
লিটন আগে সপ্তাহে একদিন করে এখানে এসে ছেলেকে দেখে যেতো। এই মাসে একবারও আসেনি। আস্তে আস্তে পুত্রের সাথে লিটনের দূরত্ব বাড়ছে না তো! কিন্তু দূরত্ব বাড়লে মেহেরাজের কি হবে! দুর্ভাগ্যক্রমে মাকে না হয় হারালো, বাবাকেও হারালে ওর মত অভাগা পৃথিবীতে আর কেউ রবে না।
আজকাল মেহেরাজের দিকে তাকালে আমার পিতৃত্ববোধ জেগে উঠে। সামিয়ার সাথে দশ বছরের সংসার আমার। এখনো আমরা সন্তানের মুখ দেখিনি। ডাক্তার অবশ্য বলেছেন কারো কোনো সমস্যা নেই। আমার বিশ্বাস সামিয়া কোনো এক মন খারাপের দিনে লাজুক কণ্ঠে সুখবর জানিয়ে আমাকে আনন্দ ¯্রােতে ভাসিয়ে দেবে।
৪.
সুমির মৃত্যুর ছয়মাস চলছে এখন। আজ সন্ধ্যায় শোনা একটি সংবাদ আমাকে ভাবিয়ে তুললো। লিটন নাকি আবার বিয়ে করেছে। আশ্চর্য, আমাকে একবারও জানানো দরকার মনে করেনি। আমি নিশ্চয়ই ওর বিয়েতে বাধা দিতাম না।
মেহেরাজকে নিয়ে সন্ধ্যার পর লিটনের বাড়িতে গিয়ে দেখি ঘটনা সত্য। লিটন তিনদিন আগে বিয়ে করেছে ওর মামাতো বোন নাহিদাকে। এতদিন পর পুত্রকে দেখে লিটনের কোনো ভাবান্তর হলো না। আমি ভেবেছি লিটনের নতুন বউ মেহেরাজ এসেছে জেনে ভেতর থেকে ছুটে আসবে। অথচ তেমন কিছুই ঘটলো না। লিটন বলল, ‘ভাইজান, আমার ছেলেটা আপনার কাছেই থাকুক। আমি প্রতি মাসে ওর খরচের জন্যে আপনাকে পাঁচ হাজার টাকা করে পাঠাবো।’ লিটনের কথা শুনে ইচ্ছে হলো ওর গালে কষে এক চড় মারি। পিতার ¯েœহকে সে টাকা দিয়ে মাপছে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেহেরাজকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম লিটনের বাড়ি থেকে। মেহেরাজকে আর কখনো এখানে আসতে দেবো না। ও আমার কাছেই থাকবে।
মেহেরাজ আমার হাত ধরে হাঁটছে। রাতের নিরব পরিবেশ। আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র ফুটেছে। মেহেরাজ প্রশ্ন করে, ‘আসমানে ওগুলি কি জ্বলছে মামা?’ আমি বললাম, ‘নক্ষত্র।’ মেহেরাজ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘নক্ষত্র কি মামা?’ আমি কোনো কথা না বলে মনে মনে বলিÑনক্ষত্র মানে তারা। তুমি যখন বড় হবে, তখন অনেক অনেক শব্দের অর্থ শিখবে। অনেক কিছু জানবে। কে তোমাকে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে কতর্ব্য পালনের দায় থেকে মুক্তির ফন্দি খুঁজেছে, আর কে তোমাকে আশ্রয় দিয়েছে, সব জানবে। এখন তুমি কিছুই জানবে না। তুমি এখন ছোট।
সামিয়া সমস্ত ঘটনা শুনে নিরব হয়ে গেলো। তারপর আমাকে অবাক করিয়ে দিয়ে সে মেহেরাজকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। মেহেরাজ চুপচাপ সামিয়ার কোলে মাথা গুজে বসে রইলো।
গভীর রাতে সামিয়া আমাকে একটা সুখবর জানালো। লাজুক কণ্ঠে বলল, ‘তুমি বাবা হবে।’ খুশিতে আমার চিৎকার আসতে শুরু করলো। জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি চাঁদের আলোয় উঠোন ভেসে যাচ্ছে। আকাশে মিটি মিটি জ্বলছে নক্ষত্র। আজ নক্ষত্রের রাত।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।