ভুতের গল্প – নাঈমুর রহমান নাহিদ
শহরের মানুষ ঘুমের রাজ্যে হারিয়েছে বেশ খানিকক্ষণ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে কোন রিক্সা বা সিএনজি চোখে পড়লনা। এক দুটো লোকাল বাস যা-ও চলছে সব ফাঁকা। আজকাল বাসে মেয়েদের সাথে যেভাবে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে, একটু সাবধান না হলে মানুষের এই জগতে সেফ ভাবে চলাফেরা করা একেবারেই কঠিন হয়ে পড়ে।
কোন উপায়ন্তর না দেখে হেঁটেই মেসে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার রুমমেট সাবিহাকে বলেছিলাম রাতে ফিরছি আমি। কিন্তু জ্যামের কারণে যে এতটা রাত হয়ে যাবে কে জানত? কে জানে এখনো জেগে আছে কিনা মেয়েটা!
সুটকেসের হাতল ধরে টেনে নিয়ে সামনে এগুচ্ছি। পিচের রাস্তায় সুটকেসের চাকার খুটখুট শব্দটা যেন রাতের নিস্তব্ধতার কথা বারবার মনে করিয়ে দিতে চাইছে। আমি সেদিকে তোয়াক্কা না করে দ্রুত হেঁটে চলেছি মেসের দিকে।
বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পর কোনরকম বাধা বিপত্তি ছাড়াই এলাকার ভিতর প্রবেশ করলাম। এলাকায় ঢুকতেই ভিতরটা কেমন প্রশান্তিতে ভরে গেল। অবশেষে পৌঁছে গেলাম তাহলে। রাস্তার পাশের ফ্লাডলাইটগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রাতের অন্ধকার গিলে খাচ্ছে। পুরো এলাকা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। দুয়েকটা বাসার জানালা এখনো লাইটের আলো দেখা যাচ্ছে।
আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি বাসার দিকে। সুটকেসের চাকার খুটখুট শব্দকে ছাপিয়ে হঠাতই একটা শব্দ কানে আসল। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। শব্দটা আবার শুনতে পেলাম। সিঁটির আওয়াজ। পেছন ঘুরে তাকাতেই রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। এলাকার কুখ্যাত বখাটে ছেলেগুলো ঠিক আমার থেকে কয়েক পা সামনে দাঁড়িয়ে। তিনজনের গ্যাং এরা। সারাদিন মোড়ে দাঁড়িয়ে নেশা করা আর আসতে যেতে থাকা মেয়েদের উত্যক্ত করাই এদের একমাত্র কাজ। এলাকার পাতি গুণ্ডা হওয়ায় কেউ এদের কিছু বলারও সাহস পায়না। রাতেও যে এদের কুকাজ বন্ধ হয়না জানা ছিলনা।
আমি দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারছি ছেলেগুলো আমার পিছে পিছেই আসছে। সেদিকে তোয়াক্কা না করে বাসার দিকে দ্রুত পা চালাচ্ছি আমি। আচমকাই ঘটল ঘটনাটা। ছেলেগুলোর একজন হঠাতই খপ করে এসে আমার হাতটা ধরে ফেলল। আমি চিৎকার করতে যাব ঠিল সেই সময় আরেকজন এসে সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল। শত চেষ্টার পরেও মুখ দিয়ে টু শব্দ বের করতে পারলামনা। এর মধ্যে তৃতীয়জন আমার পা ধরে ফেলল। তারপর তিনজনে ধরাধরি করে একটা ঘিঞ্চি গলির ভিতর নিয়ে গেল আমায়। শত চেষ্টা করেও তাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হলাম। সবার গায়ে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠেছে জলজ্যান্ত পিশাচের প্রতিচ্ছবি। দু’জন বখাটে আমার দুই হাত ও পা শক্ত করে ধরে রেখেছে। অপরজন আমার মুখ চেপে ধরে ধীরে ধীরে উঠে আসছে আমার উপর। তার দু’চোখের দৃষ্টিতে পৈশাচিক উত্তেজনা স্পষ্ট। ধীরে ধীরে তার গলা ঠিক আমার নাকের সামনে চলে এল। তার গলার শিরা দিয়ে বয়ে যাওয়া রক্তের গন্ধ নাকে যেতেই পুরনো নেশাটা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। যেই নেশাটা আমি এই মানুষের জগতে আসার পর ছেড়ে দিয়েছিলাম। ছেলেটির শিরায় বয়ে যাওয়া রক্তের গন্ধ যেন মাতাল করে ফেলল আমায়। আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ যেন কাবু করে ফেলল সেই গন্ধ। আমি আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলামনা। বাসায় ঢুকার আগে ওড়না দিয়ে নিজের মুখটা পেঁচিয়ে নিলেই হবে।
পরদিন সকালে বেশ বেলা করেই ঘুম ভাঙলো আমার। নাস্তা সেরে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম ঠিক তখনি হুরমুর করে ঘরে ঢুকল সামিহা। কোনরকম ভুমিকা ছাড়াই চেয়ার টেনে আমার সামনে বসতে বসতে বলল, ‘তোকে বলেছিলাম না, এলাকার তিনটা ছেলে বেশকিছুদিন ধরে ভীষণ ডিস্টার্ব করছিল আমাকে। কালরাতে কারা যেন ওদের খুন করে দিয়েছে। আমি মাত্র গিয়ে দেখে আসলাম। বেশ অদ্ভুতভাবে খুন হয়েছে ওরা জানিস? গলার ঠিক ডান পাশে ছোট্ট দু’টি ছিদ্র। যেন কেউ দাঁত বসিয়ে কামড় দিয়েছে। সেই ছিদ্র দিয়েই নাকি শরীরের সব রক্ত বের করে নিয়েছে কেউ। কিছু মানুষতো বলছিল পিশাচ নাকি ওদের রক্ত শুষে নিয়েছে। এই দেখ, একটা অনলাইন নিউজে তো খবরও বেরিয়েছে। “রাতের পিশাচের হাতে খুন তিন যুবক।”
আমি চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিড়বিড় করে বললাম, ‘খবরটাকে অন্যভাবেও বলা যায়। “রাতের পিশাচের হাতে খুন নগর পিশাচ।”
সামিহা আমার কথা শুনতে পেল কিনা জানিনা। ও এখনো মনোযোগ দিয়ে নিউজের লেখাগুলো পড়ছে। ওর চোখেমুখে খুশির ঝলকটা স্পষ্ট।
ইসলামনগর,মাতুয়াল,ঢাকা