দিগন্তরেখায় ডুবে যাচ্ছে আমার সমগ্র। আমার অতীত, বর্তমান ও চুক্তিবদ্ধ ভবিষ্যতের একাংশ। দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখেছি। মৃত্যু ও হাহাকার। গাঁ-গজ্ঞের বাঁকে বাঁকে অশোভন নৃত্যগীতের ইন্দ্রের নাচমহল মধ্যরাতে। নেতার মিথ্যামদির ভাষণ। প্রেমিকার অনন্যোপায় রাস্তাবদল। প্রেম পরকীয়া। পৃথগন্নের সীমারেখায় কাঁটাতারের আশাতীত উপস্থিতি ও আস্ফালন। কৃষক হত্যা। কত শত ছবি পড়ে আছে আমার দশ দিগন্তে। আমাদের সামনে পেছনে। আমার মাথার ভেতর। রক্তের প্রতি কণায় স্পন্দনে উচ্চারিত হতে থাকে। অভেদ্য নিরাপত্তাহীন অনিশ্চয়তার ভেতরও কিছু শস্য অঙ্কুরিত হয়। পত্রকুসুম ? সে অনেক পরের অধ্যায়, কথা। এই দুরাশা সম্ভাবনার জন্যই হয়ত কলমসঙ্গ আমাকে পেয়েছে। গতজন্মে না বলা কত কথাই তো বলে আসা হয়ে ওঠেনি। বিষাদমুগ্ধ আলো। সম্ভগোধিক নিশ্চল নীরবতা। প্রতিবাদ, আলো ও খাদ্যের কিংবা মাটি ও বরাদ্দকৃত শস্যের জন্য আমার কলমদেব মহাকালের প্রত্যাশায় জাগারুক, তার সঙ্গে একান্তই আমি ও আমার সমগ্র বৈভব।
প্রতিটি সম্পর্ক অপরিণত অসমাপ্ত। এই অসম্পূর্ণ আকাঙ্ক্ষার জন্য পৃথিবীর সব কিছুই এখনো চলমান। চৌরাস্তায় দাঁড়ালে দৃষ্টিতে সংগ্রহ হতে থাকে —–সিভিক ভল্যান্টিয়ারের হাতের ইশারা, হাঁটাপথে অচেনা পথচারী, চলন্ত চাকার ব্যস্ততা। কেবল বিজ্ঞাপন পোস্টার ফেস্টুনের ফ্যাশন সজ্জায় স্ট্রিট লাইট স্তম্বগুলো ঘোলাটে বিষণ্ণতায় অপেক্ষমাণ। সবই অসম্পূর্ণ বাক্য, পৃথিবীর আরো কতকিছু, আমার ইচ্ছে আমার পাওয়া না-পাওয়ার মতো।
আট দশবার আত্মহত্যা থেকে সরে এসেছি। ভেতর থেকে কোন এক স্বর্গীয়মুখ বারণ করেছে। তার কুয়াশা জড়ানো হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করেছে আমার প্রসারিত হাতের রেখাবন। সেই বর্ণনাতীত অনির্বচনীয় আকার যে রাষ্ট্র দেশ আলাভোলা গ্রাম চিনিয়েছে। আমি, আমরা যেখানে বসবাস করে আছি তার সঙ্গে কিছুতেই মেলাতে পারলাম না। তার পরিমিত কথার অতল ঐশ্বর্যে না জানি পণ করে ফেলেছি, আমার, আমাদের মাটিতে সেই স্বপ্নভূম চাষ করা যায় কিনা। সম্পূর্ণ ফসল ফলবে কে বলেছে ? তবুও ভরসা সাজাই। চেষ্টার তীক্ষ্ণ শ্রমমুদ্রা ফেলতে তো ক্ষতি নেই।
পার্থিব যা কিছুই থাকনা কেন এসবের মধ্যেই থাকে, পাশাপাশি হাঁটে এবং ঘরসংসার পেতে বসে থাকে নিপাতন কিছু ভালোলাগা সম্পর্ক, ও সম্পর্কের মানুষ। যাকে অবজ্ঞা অস্বীকার করার উপায় কারো আছে কিনা আমার প্রগাঢ় সন্দেহ । সতর্কতায় না জানি এই অসুখের শরিক, লালন করে চলি। সেই তো গোচরে অগোচরে আমাদের বহু কিছু অসাধ্য সাধন করিয়ে নেয়। তার এই অন্তর্লীন উপস্থিতিকে কীভাবে উদাসীনতা দেখাই ? অকৃতজ্ঞ হতে পারবো না। সারাদিন সারারাত্রি নানান ব্যস্ততার মধ্যেও সে কোজাগরী আমার ভেতর। তার সঙ্গে প্রহর পুড়ি, খরচ করি পরমায়ুর শতেক সাদাকালো ছায়াজড়ুল। কথামোহর ছড়িয়ে যায়। ফুল ফোটে। ফলপ্রস্তাবে আগ্রহী হয়ে ওঠে মুখ ফেরানো বনবাদাড়। রক্তহীন স্নায়ুহীন ভাবনাঘরে বসবাস, আমার তীব্র অন্তরায়। তাই তাকে ডাকি। ডাকতে বেশ লাগে। পরাবাস্তববাদ আলোছায়ায় তার দীর্ঘযাপন আমাকে মোক্ষবোধে উন্নীত করে। আমি এই প্রহর থেকে ফিরেই রচনায় বসে পড়ি। কিন্তু আমাদের জগৎ তার জগৎ আকাশজমিন তফাৎ তা আগেই বলেছি। তবুও অপার দায়বোধে পথ হাঁটি, পথ হাঁটছেন নিরন্তর আমার মতো অনেকেই স্বরচিত স্বপ্ন-সংলাপের আকার আঁকতে। পৃথিবীর জীব জড় উপাদানের প্রত্যেকের ভাষাই আলাদা। তাদের অভিব্যক্তি অভিযোজন কারো মতো কেউ না। এই ভাষার গতিপ্রকৃতি, আকার আয়তন, তাপহিম, কঠিন কোমল স্পন্দনের পাশাপাশি থাকাও এক অনন্যোপ্রাপ্তি। নিকটে থাকি। নিকটে থাকতে ইচ্ছে হয়। বসবাসের মাটি ও বরাদ্দ শস্যের জন্য আমার ঘুম শরীরও একদা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
এত লক্ষ্যহীন সূর্য সম্ভাবনা দশ দিগন্তেই ছড়িয়ে আছে, যা পরিচর্যার অভাবে ক্রমশ নিভে যেতে বসেছে। নাহ্য অধিকার চাই। নাহ্য অধিকার দিতে হবেই। না জানি এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে তারুণ্য সূর্যহীনতায় অটল ছায়ায় আমাদের খাবি খেতে হবে। অভিশপ্ত অতীত ইতিহাস ফিরে ফিরে আসছে। আমরা সব জেনে সব বুঝেও ভালো মানুষটি সেজে পাঁকের খুঁটার মতো সামলে নিচ্ছি স্বৈরতন্ত্রের অসাংবিধানিক দৌরাত্ম্য। প্রতিদিনের মনখারাপের সাতকাহন। অনর্থক ভেতরে জমে ওঠা মৃত্যু সারসচাঁদ পুড়িয়ে খায়। অন্ধকার রাত্রির রাক্ষসী তীক্ষ্ণতা আমার আনন্দ বিঘ্নিত করে। আমি এসব সহ্য করি কীভাবে ? তাই আমার লেখার টেবিল পাণ্ডুলিপি কলম, যিনি দুবেলা রান্না ও যত্ন করে খেতে দেন মাথায় রাখেন সংসারি হাততীর্থের স্নিগ্ধতা তার কাছে আমার অগাধ ঋণ। আমার প্রত্যাশা,যে যার মতো স্বাভাবিক সুস্হ নিজস্ব পৃথিবীর সন্ধানে অনুৎপাতে ফিরুক। আমি ও আমার কবিতা, আমি ও আমার কলম আমৃত্যু শ্বাসে স্নায়ুতে নতুন দিনের তর্পণ লিখে রাখি।