আজকে ভাবতে বসলে রূপকথার মত মনে হয়, বেশি নয়, একশো ষাট-সত্তর বছর আগের ঘটনা৷ বাংলার ঘরে ঘরে বহু শিশু, কিশোরী, যুবতী সাদা থানে মুন্ডিতমস্তক ঢেকে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া অনুশাসন মেনে জীবন কাটাতো৷ আজকের এই আধুনিক, গতিময়, রঙিন জীবনে সেই সব সাদাকালো ছবি রূপকথা ছাড়া আর কি মনে হবে! সেই অনুশাসন এতই কঠোর এবং নিশ্ছিদ্র ছিল যে বাড়ির লোকেরাও কষ্ট চেপে মন শক্ত করে সেই বালিকা-শিশুগুলিকে বাধ্য করতো অমানবিক নিয়মকানুন মেনে চলতে৷ রক্ষণশীল সমাজের ভ্রুকুটি, পারিবারিক সম্মান এবং পারিবারিক সম্পত্তির কথা ভেবে উচ্চ-বর্ণবাদী হিন্দুজাতি এই অসহায় বিধবাদের মুক্তির কথা ভাবেনি বা ভাবার প্রয়োজন বোধ করেনি৷ কিন্তু যুগে যুগে পৃথিবীতে অবতারের আবির্ভাব ঘটেছে যারা আর্তদের রক্ষা করে সমাজকে কলুষমুক্ত করেছেন৷ ঈশ্রচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন তেমনই এক অবতার-মহাপুরুষ৷ এই মহামানবেরা সমাজ বা তথাকথিত আইনের রক্তচক্ষুতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মানবধর্মের সঠিক প্রক্ষেপণের লক্ষ্যে গড্ডলিকা প্রবাহের বিপরীতে সাঁতার কেটেছেন৷ বিদ্যাসাগরমশাইও জীবনের অনেকটা সময় এই অসহায়া বিধবাদের মুক্তির জন্য সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন৷ শুধু বিধবা-বিবাহ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করেই ক্ষান্ত থাকেননি, এই সমস্যার মূলচ্ছেদ করতে বহুবিবাহ রদ এবং বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্যেও জীবনভর লড়াই চালিয়ে গেছেন৷
বাইরে থেকে মানুষটিকে ইস্পাতকঠিন মনে হলেও বিধবাদের দূর্দশা তাঁকে যারপরনাই ব্যথিত করেছিল৷ তাঁর জীবনীকার বিহারিলাল সরকারের লেখা থেকে জানা যায়, শৈশবে বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগরের এক খেলার সাথী ছিল-রাইমণি৷ তার খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয়, বিয়ের কয়েকবছরের মধ্যে বিধবা হয়ে ছেলে গোপালকে নিয়ে বাপেরবাড়ি ফিরে আসে৷ একদিন বন্ধুর বাড়ি গিয়ে বি্দ্যাসাগর দেখলেন রাইমনি বড়ির বাইরে করুণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে৷ কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন- সেদিন তার একাদশী আর একাদশীর দিন বিধবাদের খাবার তো দুরস্হান, এক গ্লাস জল পর্যন্ত খাওয়া শাস্ত্রের বারণ৷ ঘটনাটির বিপ্রতীপ সংঘাত বিদাসাগরকে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করেছিল-একদিকে বন্ধুর জন্য কষ্ট আর অন্যদিকে সমাজবিধির নামে বিধবাদের ওপর অমানুষিক জুলুম তাঁর বুকে আগুন জ্বেলে দিয়েছিল৷
তাঁর ভাই চন্ডীচরণের স্মৃতিচারণে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়: সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি৷ বীরসিংহের বাড়িতে বসে ঠাকুরদাসের সঙ্গে গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন বিদ্যাসাগর, এমন সময় মা ভগবতীদেবী কাঁদতে কাঁদতে পরিচিত এক শিশুকন্যার সদ্য বৈধব্যের খবর দিলেন৷ ছেলের দিকে তাকিয়ে জলভেজা চোখে প্রশ্ন করলেন, “ তুই তো এত শাস্ত্র পড়িস, কোথাও কি অসহায় বিধবাদের মুক্তির কথা এক কলমও লেখা নেই?” বাবা ঠাকুরদাসের চোখে-মুখেও একই প্রশ্ন ভেসে উঠলো৷ বিদ্যাসাগর কিছুক্ষন মাথা নিচু করে বসে রইলেন, তারপর জানালেন- নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু রক্ষণশীল সমাজের কথা ভেবে ব্যাপারটা নিয়ে এগোতে দ্বিধাবোধ করছেন৷ ঠাকুরদাস এবং ভগবতীদেবী দুজনেই সমাজের আপত্তির কথা ভুলে এই অনাথা বিধবাদের কথা ভেবে নিজ লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে বললেন৷
শুরু হল শাস্ত্রান্বেষণ৷ শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা থেকে জানা যায়, সেসময় বিদ্যাসাগর সারাদিন
সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরীতে পড়ে থাকতেন৷ রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, একদিন তাঁর সামনেই বিদ্যাসাগর আর্কিমিডিসের মতো দুহাত তুলে ‘পেয়েছি, পেয়েছি’ বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন৷ খুঁজে পেয়েছেন ‘পরাশর সংহিতা’-য় দু লাইনের এক শ্লোক- “ নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে, ক্লীবে চ পতিতে পতৌ৷” অর্থাৎ স্বামী নিখোঁজ হলে বা তাঁর মৃত্যু হলে, নপুংসক আর পতিত হলে তাঁর স্ত্রী পুনরায় বিয়ে করতে পারেন৷ এই আবিষ্কারের পর তিনি বিধবাবিবাহের সপক্ষে একের পর এক প্রবন্ধ ও বই লিখতে শুরু করলেন৷ ১৮৫৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা!’ শীর্ষক নিবন্ধ৷ এই লেখা প্রকাশিত হবার পর সারা দেশে আলোড়ন পড়ে গেল৷ এরপর ১৮৫৫ সালের জানুয়ারীতে প্রকাশিত হল তাঁর লেখা বই, ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’৷ লেখালিখির পাশাপশি তিনি এই বিয়ের পক্ষে একদিকে জনমত গঠনের চেষ্টা শুরু করলেন আর অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষনে সচেষ্ট হলেন; পাশে পেলেন বাংলা ভাষার প্রথম অভিধান রচয়িতা এবং ব্রাহ্মসমাজের প্রথম আচার্য রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ মহাশয়কে৷ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে ‘হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ, বহুবিবাহ রোধ এবং বাল্যবিবাহ বর্জন’ সংক্রান্ত কিশোরীচাঁদ মিত্রের প্রস্তাব এবং অক্ষয় কুমার দত্তের সমর্থনে এক প্রতিলিপি জমা পড়লো ‘ব্রিটিশ লিগ্যাল কাউন্সিলে’৷ আইনের মাধ্যমে বিধবাবিবাহকে বৈধতা দানের আবেদন জানিয়ে ৯৮৭ জনের দস্তখত স্বাক্ষরিত দরখাস্ত জমা পড়লো ভারত সরকারের দপ্তরে৷ সারাদেশ জুড়ে তুমুল প্রতিবাদ শুরু হলো৷ কলকাতার রক্ষণশীল সমাজের মাথা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ৩৬,৭৬৩ জনের সই সংগ্রহ করে প্রতিবাদপত্র জমা পড়লো একই দপ্তরে৷
১৮৫৫ সালে বর্ধমান থেকেও বিধবাবিবাহের সমর্থনে এক আবেদনত্র জমা পড়লো যেখানে তৎকালীন বর্ধমানের মহারাজা মহতাব চাঁদের সই ছিল৷ এছাড়া প্যারীচরণ সরকার, রাজনরায়ণ বসু, প্যারীচাঁদ মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, কিশোরীচাঁদ মিত্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বিদ্যাসাগরের পাশে থেকে বিধবাবিবাহকে সমর্থন করে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন৷ পুনরায় সেই আবেদনের বিরোধিতা করে দরখাস্ত জমা পড়ল কয়েকশো গুণ বেশি৷ শুধুমাত্র ত্রিপুরা, পুণে, বোম্বে, উত্তরভারত আর নবদ্বীপ থেকেই প্রায় ৩০০০০ প্রতিবাদপত্র সরকারের দপ্তরে জমা পড়েছিল৷ প্রাথমিকভাবে বড়লাটের অফিসও দ্বিধান্বিত ছিল৷ ব্রিটিশ সরকারও উপলব্ধি করেছিল শাস্ত্রে উল্লেখ ব্যতীত এই আইন প্রয়োগ সমগ্র দেশে ধর্মদ্রোহের সূচনা ঘটাতে পারে৷ অবশ্য বিদ্যাসাগরমশাই উপযুক্ত প্রমাণ দাখিল করার পর গ্রান্ট সাহেব আর দ্বিরুক্তি করেননি, ১৮৫৬ সালের ২৬শে জুলাই বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়ে গেল৷
অসহায় বিধবাদের সামাজিক উত্তরণে পাশে থাকায় বহু ব্যঙ্গোক্তি, কটুক্তি সহ্য করতে হয়েছে৷ সব থেকে বেশি কঠিন ছিল তদানীন্তন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরোধিতা৷ রাধাকান্ত দেব তো ছিলেনই, তার সাথে যোগ দিলেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত এবং সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ তাঁকে ব্যঙ্গ করে ‘সমাচার সুধাবর্ষণ’ পত্রিকায় ছড়া লেখা হল, “…….সাজ গো বিধবাগণ ফুটিয়াছে ফুল, তোমাদের সৌভাগ্য ঈশ্বর অনুকূল৷” বঙ্কিমচন্দ্র ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে সূর্যমুখীকে দিয়ে বলালেন, “ যে বিধবাবিবাহের ব্যবস্হা করে, সে যদি পণ্ডিত হয়, তবে মূর্খ কে?” বলাই বাহুল্য এইসব ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ কাজের প্রতি তাঁর জেদ ও নিষ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছিল৷
আইন তো হলো, কিন্তু বিধবাকে বিয়ে করবে কে! বিদ্যাসাগর তাঁর ছেলেবেলার মাস্টারমশাই প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশকে কথা প্রসঙ্গে বললেন, “ বিধবার বিয়ে হবে, আমিই দেব৷” অবশেষে এলো সেই কাঙ্খিত দিনটি৷ ১৮৫৬ সালের ৭ই ডিসেম্বর, সময়-মধ্যরাত, সুকিয়া স্ট্রিটের রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে পাত্র শীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সাথে পলাশডাঙার দশ বছরের বিধবা কন্যা কালীমতির বিবাহকর্ম সুসম্পন্ন হল৷ সমাজের বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির সাথে এই বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্হিত ছিলেন তদানীন্তন বাংলার লাটসাহেব ফ্রেডরিক হ্যালিডে৷ এরপর নিজ উদ্দ্যোগে এবং খরচে বহু বিধবা কন্যার বিয়ে দিয়েছেন, এক বিধবা কন্যাকে একমাত্র পু্ত্রবধু হিসাবে গ্রহন করেছেন৷ বাংলায় তথা ভারতবর্ষে নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়৷ তিনি বিধবাদের সতীদাহের জ্বলন্ত যন্ত্রনা থেকে রক্ষা করেছিলেন, বিদ্যাসাগর সার্থক উত্তরসুরীর মতো সেই জাগরনের ধ্বজা উড়িয়ে বিধবাদের বৈধব্য যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন৷
তাঁর মতো একজন পন্ডিত মানুষ শিক্ষার জগতে বিচরণ করেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু অন্তরে তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক৷ তৎকালীন সমাজব্যবস্হায় নারীদের প্রতি অপমান, অবমাননা, অত্যাচার তাঁকে ব্যথিত, উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল৷ মহিলাদের বাদ দিয়ে একটা জাতি কখনোই উন্নতি করতে পারেনা, মানুষকে সেই সত্যটা বোঝাতে গিয়ে সারাজীবন ব্যয় করছেন৷ মেয়েদের জন্যে উপযুক্ত শিক্ষাই একমাত্র সেই অভিশাপ থেকে একটা জাতীকে উদ্ধার করতে পারে৷ সেই উপলব্ধি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য না পেয়ে নিজের খরচে একসময় তিনি একুশটি মেয়েদের স্কুল চালাতেন৷ বিদ্যাসাগর নিজে স্বীকার করেছেন ‘বিধবাবিবাহ প্রচলন’ই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ৷ সারাজীবন সেই শিশুকন্যাটির সকরুন দৃষ্টি তাঁকে তাড়া করে বেড়াত- সালটা ছিল ১৮৫৩, বর্ধমানের দশঘরায় সম্পন্ন এক ব্যক্তির ডাকে উপস্হিত হয়েছেন৷ উদ্দেশ্য কুসংস্কারে জর্জরিত স্হানীয় মানুষগুলোকে এলাকায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাজি করাতে হবে৷ সবাই উপস্হিত, অতিথিদের জনে লুচি, ছোলার ডাল এবং একাধিক মিষ্টান্ন সহযোগে জলযোগের ব্যবস্হা হয়েছে৷ খাওয়া-দাওয়ার পর আলোচনা শুরু হবে-এমন সময় ভিতর বাড়ি থেকে ৬-৭ বছরের সাদা থান পরিহিতা একটি মেয়ে এসে গৃহস্বামীকে অভিযোগ জানালো, “ বাবা বাবা, মাকে বলোনা, আমার খুব খিদে পেয়েছে৷ দাদারা লুচি খাচ্ছে, আর আমি চাইলেই মা বলছে-ছিঃ, আজ একাদশী না! খাবার কথা বলতে নেই মা-কিন্তু বাবা আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি৷ তুমি,মা,দাদারা কেউ একাদশী করোনা, আমায় কেন করতে হবে! আমার বুঝি খিদে পায়না৷” সমাজের মাথা সেই বাবা মেয়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি, পারেননি বিদ্যাসাগর নিজেও৷ বাবার কথায় ভিতরে যেতে যেতে বাচ্ছাটির করুণ চোখে পরমান্ন সাজানো থালাগুলির দিকে তাকিয়ে থাকার দৃশ্য বহুদিন তাঁর স্বপ্নে আসা-যাওয়া করতো৷
বজ্রের মত কঠিন এবং শিশুর মত সরল মানুষটির এই বছর দ্বিশত জন্মবার্ষিকী৷ একসময়ের ঘুণধরা সমাজকে নিজের বলিষ্ঠ দুকাঁধে বহন করে বহু দূর্গম পথ অতিক্রম করে একটা অপেক্ষাকৃত বাসযোগ্য পৃথিবীতে পৌঁছে দিয়েছিলেন৷ আজ যখন খবরের কাগজে বা টিভির পর্দায় বালবিবাহ, কন্যাভ্রুণ হত্যা, গৃহবধু হত্যা বা নারীধর্ষণের মত খবর চোখে পড়ে, তখন মনে হয় এইসব মহামানবদের মৃত্যুর পর আমাদের সভ্যতা একপাও এগোয়নি, এগোতে পারেনা- সে আমাদের মাথাপিছু জাতীয় আয় , ভোগবিলাস যতই বাড়ুকনা কেন৷
অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর,অর্থনীতি বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজ
কলকাতা,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত ।