জোবায়ের রাজু
পারিবারিক ভাবে রোমানার সাথে মামুনের বিয়েটা হয়েছিল। বিয়ের আগে অবশ্য রাহাতের সাথে রোমানার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। বাবা মা সে সম্পর্ক কখনো সাপোর্ট করেননি। বলা যায় অনেকটা জোর করে তারা মেয়েকে মামুনের মত বিত্তবান সুÑপাত্রের হাতে তুলে দিয়েছেন।
বিয়ের পর মামুন জানতে পারে তার স্ত্রী রোমানার সাথে রাহাতের সম্পর্কের কথা। বিষয়টা খুব একটা আমলে নেয়নি মামুন। একটা সুন্দরী মেয়ে বিয়ের আগে কারো সাথে সম্পর্কে জড়াতেই পারে। এটা দোষ নয়, বাঙালী মেয়েদের চিরায়াত একটি নিয়ম।
বিয়ের পর পরই স্ত্রীকে নিয়ে শহরে চলে আসে মামুন। এখানে তার চোখ ধাঁধানো আলিশান বাড়ি। বাড়ির নাম ‘আপন নিবাস।’ সেই আপন নিবাসের রাণী হয়ে উঠে সদ্য গ্রাম থেকে আসা মামুনের সুন্দরী বধূ রোমানা।
সংসারে সুখের কোন অভাব ছিল না। তবু মনে সুখ ছিল না রোমানার। মামুনের মত সুপুরুষ স্বামী থাকার পরও রাহাতকে বড় মনে পড়তো তার। মামুন যদিও তার স্ত্রীকে প্রাপ্য মর্যাদা দিতে কোন কার্পন্য করেনি। তবুও রোমানার মনে হত রাহাতের মত তাকে আর কেউ কখনো ভালোবাসতে পারবে না। অবশ্য এসব ছিল রোমানার আবেগের ভাবনা। মামুন তার সুখের জন্য কি করেনি! সব করেছে। সংসার করার প্রয়োজনে আপন নিবাসে দুজন স্বামী স্ত্রী বাস করলেও রোমানার মনে কখনো জায়গা পায়নি মামুন। তারপরও দায়িত্বের খাতিরে মামুনের সাথে দিন রাত সংসার করে গেছে সে।
এক সময় কন্যা সন্তানের মা হয় রোমানা। মেয়ের নাম রাখে ফারিয়া। ফুলের মত মেয়ে জন্মেছে। বাবা হতে পেরে মামুনের মনে হয়েছে তার সারা দুনিয়া এক দিকে তো মেয়ে আরেক দিকে।
মামুনের সাথে দিন দিন সম্পর্কে ফাটল ধরে রোমানার। দুজনের বনিবনা হয় না বলে দূরত্বটা বাড়তে থাকে কেবল। রোমানার ক্রমেই মনে হতে থাকে সে একা হয়ে যাচ্ছে। আপন নিবাসের মত আলিশান বাড়িতে থেকেও নিজেকে একা ভাবতে ভাবতে রোমানা এক সময় সিদ্ধান্ত নেয় সে এই সংসার, সন্তান ফেলে রাহাতের কাছে চলে যাবে। একদিন ভোরে মামুন যখন ঘুমন্ত ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন রোমানা আপন নিবাস থেকে বেরিয়ে যায় রাহাতের উদ্দেশ্যে।
ঘুম ভেঙে মামুন দেখতে পায় তার বালিশের পাশে ছোট্ট একটা চিঠি। রোমানা তাকে লিখেছেÑ‘তোমার সংসারে থাকতে পারলাম না বলে ক্ষমা করবে। আমি আমার এক সময়ের ভালোবাসার মানুষের কাছে চলে গেলাম। মেয়েটাকে দেখে রেখো।’ লাইনগুলি পড়ে মামুনের মনে হল তার পায়ের তলার মাটিগুলি সরে গেছে।
যে আশা নিয়ে রাহাতের আছে এসেছে রোমানা, তার সে আশা দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল। রাহাতের বাড়ি এসে সে জানতে পারে রাহাত দুই মাস আগে বিয়ে করে সংসার পেতেছে।
মা বাবার সংসারে ফিরে আসে রোমানা। সংসার পরিত্যক্ত মেয়ের আচরণ শুনে বাবা মা রোমানার উপর ক্ষুব্ধ হয়। মামুনের সংসারে আবার ফিরে যেতে তারা মেয়েকে তাগিদ দেয়। কিন্তু রোমানা দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয় সে এই মুখ আর মামুনকে দেখাবে না কখনো। এই নিয়ে বাবা মায়ের সাথে কথা কাটাকাটি চলে তার।
২. এভাবে কয়েক বছর কেটে গেল। বাবা মায়ের সংসারে অনেকটা অবজ্ঞা নিয়ে দিন কাটে রোমানার। সময়ের পরিক্রমায় মেয়ে ফারিয়ার জন্য মাতৃত্ব বোধ জেগে উঠে। কেমন আছে মেয়েটা, মা ছাড়া সে কতখানি সুখি, বাবা তার সঠিক দেখা শোনা করে তো? এসব প্রশ্ন মনে মনে ঘুরপাক খায় রোমানার। দিন দিন সে ভাবতে থাকে মামুনের কাছে ফিরে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। নিজের ভুলের কথা স্বীকার করবে। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদবে। এসব ভাবতে গিয়ে চোখ ভিজে এলো রোমানার।
খুব সুন্দর একটি সকাল। এই সকালে মামুনের আপন নিবাসে ফিরে এসেছে রোমানা। একদিন এ বাড়ি থেকে সব ছেড়ে সে চলে গেছে।
বাড়িটা আজ এত নিস্তব্দ কেন? মামুন কোথায়? ফারিয়াও? আলিশান ঘর থেকে বেরিয়ে এলো চোখে মোটা চশমা পরা মাঝ বয়সের এক মহিলা। জিজ্ঞাসু সুরে বললÑ‘কি চাই?’ রোমানা বললÑ‘মামুন কোথায়?’ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল মহিলাটি। শান্ত গলায় বললÑ‘মামুন সাহেব তো আট মাস আগে আমাদের কাছে এই বাড়ি বিক্রি করে মেয়েকে নিয়ে জাপান চলে গেছেন।’
ধাক্কার মত খেলো রোমানা। মামুন মেয়েকে নিয়ে দেশ ছেড়েছে! ভীষণ কান্না আসছে রোমানার। তার জীবনে ভুলের ঝুলিটা এতো ভারী হচ্ছে কেন? এসবের জন্য সে নিজেই দায়ী।
লম্বা এক রেল লাইনে এসে দাঁড়ায় রোমানা। কোথায় যাবে সে? বাবা মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে না। সেখানে রোজ তাকে কটু বাক্য শুনতে হয়। রেল লাইন ধরে খালি পায়ে হাঁটতে থাকে সে। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে জানে না। তার সে পথ জানা নেই।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।