দৃশ্যপট-১ঃ
বৃহস্পতিবার। রোকনের মনটা আজ খুব ভালো। মন ভালো হওয়ার পেছনে অবশ্য কারণ আছে। কারণটা হলো তার বাবা। সকালবেলা রোকন তার বাবার কাছে গিয়ে বলেছিল,
আব্বা, টাকা লাগবো।
কী জন্য?
ভ্রু কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করে রতন আলী। রোকন উত্তরে বলে,
খাতা কিনমু। কলমের কালি শেষ। খাতা না নিয়া গেলে স্যার কানে ধইর্যা ডলা দিব!
আইচ্ছা বুঝছি। কয় টাকা লাগবো?
স্বাভাবিক কণ্ঠে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে রতন আলী। উত্তরে ছেলে বলে,
বিশ টাকা। পনের টাকা খাতার দাম। আর পাঁচ টাকা দিয়া কিনমু কলম।
ঠিকাছে। স্কুলে যাওয়ার আগে আমার কাছ থাইক্যা নিয়া যাইস।
মাথা নেড়ে সায় দেয় রোকন। দুজনের মাঝে কথা বাড়ে না আর। রোকন পুকুর পাড়ের দিকে চলে যায়। গোসলটা করে নেয়া যাক। যে গরম পড়েছে, তাতে সকালে গোসল না করলে আরাম নেই। গোসল শেষে রান্না ঘরে ঢোকে রোকন। একটা থালায় পান্তা ভাত,পেঁয়াজ আর মরিচ রাখা। এই হলো তার সকালের নাস্তা। খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয় সে। স্কুলের সময় হয়ে এসেছে। খাওয়ার পর, বাকী সকল আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করে সে তার বাবার কাছে যায়। গিয়ে বলে,
স্কুলে যাইতাছি। টাকা দাও।
এই নে।
হাত বাড়িয়ে কুন্ডলী পাকানো দশ টাকার নোট ছেলের হাতে ধরিয়ে দেয় রতন আলী। রোকন টাকা নিয়ে দু কদম পা বাড়িয়ে আবার থেমে যায়। বাবা তো তিনটা দশ টাকার নোট দিয়েছে। অর্থাৎ ত্রিশ টাকা। ঘটনা কী? ভুল করে দিয়ে দিল না তো? নাকি অন্য কোন কাজ আছে? এদিকে মায়ের তো জ্বর। কোন ওষুধ আনতে হবে কী? সে বাবাকে জিজ্ঞেস করে,
তিরিশ টাকা দিলা যে?
দশ টাকা দিয়ে তুই কিছু খাইস। অহন স্কুলে যা। দেরি করিস না।
বাবার কথা শুনে মনটা লাফিয়ে উঠে রোকনের। আনন্দে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করে। তবে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে চিৎকার করলে বাবা তেড়ে আসতে পারে। থাকুক। আনন্দ মনে মনেই থাকুক।
এরকম ঘটনা রোকনের জীবনে সব সময় ঘটে না। তার বাবা বাজারের অস্থায়ী চৌকিদার। টাকা পয়সা যা পায় তাতে সংসার চালানোই দায়। নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা। এর মাঝে অতিরিক্ত টাকা পাওয়ার কথা আশাই করা যায় না। রোকন মনে মনে ভাবে, নিশ্চয়ই বাবার রোজগার ভালো হয়েছে। তাই দশটা টাকা বেশি পেয়েছে সে। কি মজা!
রোকন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। তার স্কুলের নাম কম্পুপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলটা তার বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। প্রতিদিন সে হেঁটেই স্কুলে যায়। আজ অবশ্য ভিন্ন ব্যাপার হলো। সে সবেমাত্র রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে এমন সময়, একটা ভ্যান এসে তার পাশে দাঁড়ালো। ভ্যান চালক হাক ছেড়ে জিজ্ঞেস করলো,
যাইবো নাকি?
প্রশ্ন শুনে রোকন কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল। সে কি আজ ভ্যানে করে স্কুলে যাবে? নাকি হেঁটেই যাবে প্রতিদিনের মতো? মুশকিল! সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে। আচ্ছা রোকনকে নাহয় একটু সময় দেয়া যাক। দেখি সে কী করে। এবার অন্যদিক থেকে একবার ঢু মেরে আসি চলুন।
দৃশ্যপট-২ঃ
জাবির মিয়ার মন মেজাজ ভালো নেই। বেলা বাজে সাড়ে নয়টা । অথচ এখন পর্যন্ত আয় রোজগার কিছুই হয় নাই। সে সামান্য ভ্যান চালক। একবেলা রোজগার না হলে পেট চলবে কি করে? আগে সে ঢাকায় রিকশা চালাতো। সেই সময় টাকা পয়সা কিছু জমেছিল তার। সেই টাকায় ঘরদোর ঠিকঠাক করা হয়েছে । মাস তিনেক হলো সে গ্রামে ফিরেছে। শহরে টাকা ধরা দিলেও মন টেকানো দায়। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তাই গ্রামের ছেলে, গ্রামেই আশ্রয় নিয়েছে। এই গ্রামে রিকশার প্রচলন নেই। এখানে চলে ভ্যান। এক ভ্যানে যাত্রী বসে চারজন। এতে যাত্রীদের খরচ কম আসে। রিকশাটা বিক্রি করে তাই একটা ভ্যান কিনেছে জাবির মিয়া। এই ভ্যানই তার একমাত্র অবলম্বন।
প্রতিদিন জাবির মিয়া ঘর থেকে ভ্যান নিয়ে বের হয় সকাল সাতটার দিকে। এই সময়ে রাস্তায় কিছু যাত্রী পাওয়া যায়। আজও সে তার রুটিন অনুযায়ী বেরিয়েছে একই সময়ে। অথচ এখন পর্যন্ত একটা যাত্রীও পায় নি সে। কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর কি। এভাবে বসে থাকার চেয়ে বাড়ি ফেরা ভালো। দুপুরের খাবার খেয়ে নাহয় আবার বেরুনো যাবে। এই ভেবে সে ভ্যানটা ঘুরিয়েছে, এমন সময় একটা কণ্ঠ তার কানে ভেসে আসে,
এই ভ্যান, যাবে?
হ যামু। কই যাইবেন?
কম্পুপুর।
ছোট্ট করে উত্তর দেন ভদ্রলোক। এই লোক নির্ঘাত শহর থেকে আসছে। কোর্ট টাই দেখে তাই মনে হয়। অবশ্য এসব ভেবে লাভ নেই। যাত্রী পাওয়া গেল এক বেলা পর এতেই জাবির মিয়া খুশি। সে হাসি মুখে শুধু বলে,
উঠেন।
ভদ্রলোক ভ্যানে উঠে বসেন। একজন যাত্রী নিয়ে শুরু হয় জাবির মিয়ার যাত্রা। তবে রাস্তার আশেপাশে খুব সূক্ষ্ম নজর রাখে সে। এখনো তিনজন মানুষের জায়গা আছে ভ্যানে। মানুষ যতো বেশি টাকা ততো বেশি।
মিনিট দশেক পর একটা ছোট ছেলে তার নজরে আসে। রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। সবুজ শার্ট দেখে বোঝা যায় স্কুলের ছাত্র। তাকে দেখে জাবির মিয়া হাক ছেড়ে ডাকে। জিজ্ঞেস করে,
যাইবো নাকি?
ছেলেটা মূহুর্তেই হ্যাঁ অথবা না কিছু বলে না। কিছু একটা ভাবছে সে। হেঁটেই যাবে নাকি? দেখা যাক সে কী উত্তর দেয়।
দৃশ্যপটঃ ৩
জাবির মিয়ার ভ্যানে এখন দুইজন যাত্রী। দ্বিতীয় যাত্রীর নাম হলো রোকন। রোকন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, টাকা যেহেতু আজ আছে, ভ্যানে করেই স্কুলে যাবে সে। প্রতিদিন তো হেঁটেই যাওয়া হয়। আজ নাহয় একটু সাহেবি কায়দায় যাওয়া যাক। হিসেবটাও সে আগেভাগে করে নিয়েছে। ভ্যান ভাড়া পাঁচ টাকা। আর টিফিন পিরিয়ডে উদরপূর্তি হবে পাঁচ টাকার। তাই কোন সমস্যা নেই। সবকিছু চলবে হিসেব অনুযায়ী। কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হলো তখন, যখন ভ্যানটা কম্পুপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে এসে পৌঁছালো। ভ্যান থেকে নেমে রোকন, জাবির মিয়াকে দশ টাকার একটা নোট দিল। জাবির মিয়া নোট হাতে নিয়ে বললো,
ভাংতি নাই। পাঁচ টাকা থাকলে দাও।
কথা সে মিথ্যে বলে নি। দিনের প্রথম যাত্রী তারা দুজন। পকেটে টাকা না থাকাই স্বাভাবিক। তার কথা শুনে রোকন বলে,
আমার কাছেও ভাংতি নাই। ভাংতি কইরা দেন।
এই ভাংতি এখন জাবির মিয়া করবে কোত্থেকে? ইতিমধ্যে অন্য যাত্রী নেমে গেছে। তার ভাড়া হয়েছিল দশ টাকা। সেই ভদ্রলোক থাকলে হয়তো সুবিধা হতো।
রাস্তার আশেপাশে কিছু দোকান আছে। জাবির মিয়া এবং রোকন, দুজনেই সেসব দোকানে গিয়ে ভাংতির খোঁজ করে। রোকন এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে,
চাচা দশ টাকা ভাংতি হইবো?
না হইবো না।
বিরক্তি নিয়ে উত্তর দেয় দোকানদার। এসব ঝামেলা যে কেন আসে। এদিকে রাস্তার অন্যপাশে জামির মিয়া এক দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
ভাইজান দশটা টাকা ভাংতি দেন না?
না বাপু। এই সাত সকালে ভাংতি কই পাবো?
পান চিবুতে চিবুতে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে দোকানদার। আচরণে বিরক্তির ভাব সুস্পষ্ট।
এভাবে সব কটা দোকান ঘুরে চেষ্টা চলে টাকা ভাংতি করার। তবে সে চেষ্টা বৃথা চেষ্টা। দুজনে ফিরে আসে খালি হাতে। জাবির মিয়া যখন ফিরছিল তখন মনে মনে ভাবে,
ভাংতি যেহেতু পাওয়া গেল না, সেহেতু ভাড়া দশ টাকাই দিয়ে দিবে ছেলেটা।
অন্যদিকে রোকন ভাবে,
সে তো ছোট মানুষ তাই পাঁচ টাকা ভাড়া হয়তো নিবেন না ভ্যান চালক।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! দুজনের ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয় সহসাই। কেউ পাঁচ টাকা ছাড় দিতে রাজি নয়। রোকনও নয়, জাবির মিয়াও নয়। কী বাজে অবস্থা? এখন উপায় কী?
উপায়ের জন্য দুজনেই অপেক্ষা করে রাস্তায়। অপেক্ষা শুধু দীর্ঘ হতে থাকে। উপায় আর বের হয় না। এভাবে কেটে যায় মিনিট বিশেক। দুজনের মেজাজ বিরক্তি চরম সীমা অতিক্রম করেছে। কিন্তু এখনো ছাড় দিতে কেউ রাজি নয়। পাঁচ টাকারও মূল্য আছে। এদিকে রোকনের ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। দেরি করে ক্লাসে গেলে কান ধরে উঠবস করা অবধারিত। কিন্তু পাঁচ টাকা ছাড়া তো যেতেও পারবে না সে। একদম হিসেব করা টাকা বলে কথা।
আরও মিনিট দশেক এভাবে কেটে যায়। হঠাৎ রাস্তায় উদয় হয় এক অচেনা লোকের। তার পরনে লুঙ্গি আর সাদা ফতোয়া। লোকটি কাছে আসামাত্রই দুজনে একসাথে বলে উঠে,
দশ টাকা ভাংতি হবে?
এবারে আর প্রত্যাখ্যান শুনতে হয় না। লোকটি মৃদু হেসে পকেট থেকে দুইটা পাঁচ টাকার কয়েন বের করে দেয়। রোকন এবং জাবির মিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এতক্ষণে ল্যাঠা চুকেছে। জাবির মিয়া লোকটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
টাকা ভাংতি দিতে বড় মন লাগে ভাইজান। আপনার মনডা পরিষ্কার।
কথা নেহায়েত মন্দ বলো নাই।
হাসিমুখে উত্তর দেয় অচেনা লোক। একটা কয়েন এখন রোকনের পকেটে। অন্য কয়েন শোভা পাচ্ছে জাবির মিয়ার থলেতে। দুজনেই এখন মুক্ত। যে যার যার কাজে চলে যায়। আহ কি পরিশ্রমটাই না গেল। পাঁচ টাকার পরিশ্রম। তবে দিনশেষে পরিশ্রম সার্থক। আহ শান্তি! এখানেই শেষ হলো পাঁচ টাকার গল্প।
পাদটীকা-
পাঠক, বলতে পারবেন পাঁচ টাকার মূল্য কতো? আমাদের মতো মানুষ, সাদা চোখে পাঁচ টাকাকে দেখলে এর মূল্য স্রেফ পাঁচ টাকা। কিন্তু আপনি কী জানেন, গল্পের দুজন চরিত্র অর্থাৎ রোকন এবং জাবির মিয়ার কাছে পাঁচ টাকার মূল্য স্রেফ পাঁচ টাকা নয়। তাদের কাছে এর মূল্য হয়তো পাঁচশো টাকার সমান, অথবা তিনশো টাকার সমান। আচ্ছা বাদ দিন। ধরলাম দুইশো টাকার সমান। এর থেকে কম নয়। সমাজে মানুষ যেমন বহুরূপী। টাকাও তেমন বহুরূপী। অদ্ভুত! তাই না?
শিক্ষার্থী, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল- [email protected]