ভালোবাসার গল্প
প্রথমাংশ-লুনা রাহনুমা
শেষাংশ- আশিক মাহমুদ রিয়াদ
উঠতে, বসতে, হাঁটতে, খেতে, শুতে – মোদ্দাকথা সারাক্ষণই হাতের মুঠোয় মোবাইল ফোনটাকে বয়ে বেরায় পারমিতা। মেয়ের মুখে ভাতের লোকমা ঠেসে দিয়ে মোবাইলে রান্নার ভিডিওর দিকে তাকিয়ে আছে আজো।
অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে পারুল মায়ের গায়ে ধাক্কা দিয়ে বললো, মা মুখে ভাত দাও, আমার মুখ খালি।
পারমিতার লজ্জা লাগে। জলদি মোবাইলটি হাত থেকে সরিয়ে রেখে মেয়েকে খাওয়ানো শেষ করলো।
পাঁচ বছরের ছেলে জেদ ধরেছিলো, মাকে তার সাথে বল খেলতে হবেই। খেলার তিনমিনিটের মাথায় পারমিতার মনে পড়লো, পৃথার জরুরি মেসেজের উত্তর দেয়া হয়নি এখনো। তাই, তৎক্ষণাৎ ছেলের সাথে বল খেলা শেষ করতে হলো। বসে গেলো মোবাইলে। বলা বাহুল্য, ছেলের সাথে সেদিন আর বল খেলা হয়ে উঠেনি পারমিতার।
গতকাল রাতে বরের সাথে মুভি দেখার সময় ও পারমিতা দশ মিনিট পরপর মোবাইল চেক করছিলো। বিরক্ত হয়ে পারমিতার বর বললো, নতুন কাউকে পেয়েছ নাকি, প্রতি সেকেন্ডে তোমার মোবাইলে কী?
ব্যাস, আর যায় কই? মধ্যরাত পর্যন্ত তুমুল ঝগড়াঝাটি। কান্নাকাটি। নিজের হাতে পারমিতা মোবাইলটি পাসওয়ার্ড দেয়া লকারে ভরে রাখলো। সেই লকারে, যেখানে পারমিতার বিয়ের গহনা, সোনা-দানা, নগদ টাকা, বাড়ির দলিল আর পরিবারের অতি মূল্যবান জিনিসপত্র নিরাপদে রাখা হয়। তারপর বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়ে পড়লো। অভিমানে ফুলে ফুলে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো পারমিতা। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বামীটিও অন্যদিকে মুখ করে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন সারাদিন পারমিতার মোবাইলটি আটকে থাকলো লকারের ভেতরে। পারমিতা রান্না করলো, ঘর ঝাড়ু দিল, বাসন মাজলো, গোসল করলো, বাচ্চাদের নাওয়ালো- খাওয়ালো। দুপুর তিনটা পর্যন্ত খাবার টেবিলে বরের সাথে একত্রে বসে খেয়েছে। নিজের খাওয়ার পর বরের খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত বসে থেকেছে পতিব্রতা মেয়েটির মতো।
স্বামী খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে উঠে পড়তেই লাফিয়ে উঠলো পারমিতা। সকাল থেকে এতসব কাজ যে করেছে, সে পারমিতা ছিল না। সে ছিল পারমিতার শরীরের খোলস মাত্র। প্রায় লাশের মতো পারমিতার সে খোলসের শরীরে প্রাণটা ছটফট করে যাই আর আসি করেছে প্রতিটি মুহূর্তে।
+
দিন পেড়িয়ে যায়, পারমিতার মোবাইল আসক্তি আরো বাড়ে৷ বিজয়(পারমিতার স্বামী) সারাদিন কাজ শেষে ঘরে ফিরে এসে লক্ষ্য করে, তার স্ত্রীর মোবাইল আসক্তি দিন দিন বাড়ছে। স্বামীর মনের মধ্যে কৌতূহলের ওজনটাও দিন দিন বাড়তে থাকে৷ রাতে ঘুম ভেঙে বিজয় লক্ষ্য করে পারমিতা বেশ রাত ধরে জেগে আছে। মৃদু শব্দে খিল খিল হাসিতে খাট দুলে ওঠে।স্বামীর মধ্যে কৌতুহল বাড়ে। সেই সাথে বাড়ে দুশ্চিন্তা! এই তো সেদিনের কথা। কত বছর পেড়িয়ে গেলো। দুজন দুজনকে কত ভালোবাসতো। বিয়ের কয়েকবছর পেরিয়ে গেলেও ভালোবাসাটা তো ঠিক ই ছিলো৷ শেষ রাতে বুক ধুকপুকানীতে ঘুম ভাঙে বিজয়ের। নির্ঘুম শেষ রাতে বিজয়ের মাথায় ঘোরে বড় একটি প্রশ্নচিহ্ন। তবে কি পারমিতা তাকে আর ভালোবাসে না? পারমিতার অন্য কোন বন্ধু জুটেছে?
২.
একদিন সন্ধ্যে বেলা।পারমিতা তার ছেলেকে পড়াচ্ছিলো। বিজয় ঘরে ফিরে এসে দেখে পারমিতা তার ছেলে অভিকে পড়াচ্ছে। অভি পড়লেও পারমিতার দু চোখ ফোনের স্ক্রিনে। “মা মা এই অংকটা দেখিয়ে দাও না?” পারমিতা মোবাইলে ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে বলছে.. “তুই চেষ্টা কর। না পারলে দেখিয়ে দেব ” অভি বিরক্তের সুরে বলে,’উফফ পারছি না তো! তুমি একটু দেখিয়ে দাও না। ‘ বিজয়ের রাগ চটে যায়। হাত মুখ ধুয়ে এসে বিজয় বলে,’ছেলেটা অংক দেখিয়ে দিতে বলছে দিচ্ছো না যে?’ পারমিতা বিরক্তির সুর কেটে বলে,’তুমি দেখিয়ে দিলেই তো পারো! ‘ বিজয়ের কেন যেন রাগ চয়ে যায়। একসময় বিজয় পারমিয়ার খিল খিল হাসি পছন্দ করতো৷ কিন্তু ইদানীং একেবারেই অসহ্য লাগে৷ বিজয় তার হাতে থাকা গ্লাসটা ছুঁড়ে মারে ফ্লোরে। অভি হকচকিত হয়৷ পারমিতাও, চমকে যায়। বিজয় অভিকে বলে তুমি ঘরে যাও বাবু। শুরু হয় বিজয় পারমিতার মধ্যে বাকযুদ্ধ। অভি ঘরে এসে কান চেপে বসে থাকে৷ এক পর্যায়ে বিজয় পারমিতার গালে চড় বসিয়ে দেয়। পারমিয়া অভিমান চেপে বলে,’তুমি আমাকে মারতে পারলে?’ তারপর এক ছুটে রুমের ভেতরে গিয়ে ধড়াম করে দরজা সেটে দেয়।
৩.
আজ ১২ জুন। বিজয়-পারমিয়ার বিবাহ বার্ষিকী! বিজয় আর পারমিতার সাথে কথা বলে না৷ সেদিন রাগের মাথায় পারমিতার ফোনটি আছাড় ভেঙে ফেলেছিলো সে৷ বাবা দুজনই হীনমন্যতায় ভোগে। অভিও কেমন কথা বলার সঙ্গী পায় না।
তবে আজকাল দুজনের কথা চলে অভির মাধ্যমে। মান-অভিমান হলে দুজন দুজনকে ছুড়ে কথা বলে৷ এটাও রোমান্টিকতা! আজ সকালে বিজয় একটি বক্স অভির মাধ্যমে পারমিতার কাছে পাঠিয়েছে৷
বক্স খুলে পারমিতা কৌতুহল নিয়ে রাগী কন্ঠে অভিকে বলে.. এটা কি? অভি ভয় পেয়ে জবাব দেয়, বাবা পাঠিয়েছে। পারমিতা বক্স খুলে দেখে, তাতে একটা মোবাইল ফোন। আর ছোট্ট একটি চিরকুটে লেখা সর্যি পারমিতা। পারমিতার রাগ গলে যায়। সেও আজ মনে মনে ভেবে ছিলো যে আজ বিবাহ বার্ষিকীর দিনে সে অভিমান ভেঙে বিজয়ের সাথে কথা বলবে৷ দুজন দুজনের মান অভিমান ভেঙে কথা বলে৷ দুপুরে পারমিতা তার স্পেশাল রেসিপির রান্না করে৷ বিজয় খাবার মুখে তুলে বলে,বাবু তোর মাকে বল, খাবারটা দারুণ হয়েছে৷ পারমিতা আহ্লাদী সুরে বলে, হয়েছে হয়েছে আর ঢং করতে হবে না৷ পারমিতা বলে,এই রান্নাটাও মোবাইলে ইউটিউব দেখে দেখে শিখেছি। বিজয় বলে,” তাহলে তো বেশ হলো! নতুন মোবাইল নতুন রান্না” হা হা হা। খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই মিলে ঘুরতে যায়।পারমিতার নতুন মোবাইল ফোন থেকে সেলফি তোলে৷পারমিতা সেই সেলফি বাঁধাই করে রেখে দেয়। সবাই ই ফ্রেমে বন্দী!
আমরাও বন্দী মোবাইলে! মোবাইলের ডিসপ্লেতে এখন আমাদের চোখ৷ সুখ-অসুখের, মান-অভিমানের সঙ্গে!