স্বর্গ নরক
জোবায়ের রাজু
আজ বহুদিন পর সাত সকালে বড় দা’র এমন অপ্রত্যাশিত আগমন দেখে আমাদের চোখ যেন এক শ হাত উপরে উঠে গেল। একি দেখছি আমরা! বড় দা সত্যি ফিরে এসেছে? মুখ ভর্তি দাড়ি আর চোখের নিচে কালি দেখে মনে হচ্ছে বড় দা খুব খারাপ অবস্থায় আছে।
মা আমি আর রকি মিলে দেখলাম উঠোনের ডালিম তলায় পুরাতন চেয়ারে বসা বৃদ্ধ বাবার পা জড়িয়ে ধরে বড় দা ব্যাকুল গলায় কাঁদতে কাঁদতে বলল ‘আমাকে ক্ষমা করো বাবা। আমি তোমাদের সাথে অন্যায় করেছি।’ আজ এতদিন পর বড় ছেলেকে দেখছেন বাবা, তবুও কোন রকম করুনা না করে তেজী গলায় বললেন ‘তোর মত ছেলেকে ক্ষমা করা যায় না।’ এই বলে বাবা চেয়ার থেকে উঠে হনহনিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। দাঁড়িয়ে রইলাম মা আর রকি। অশ্রæত চোখের কাতর দৃষ্টিতে আমাদের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে বড় দা। পাপের শাস্তি পাওয়া বড় দা’র এই অসহায় ভাবটা দেখতে আমার ভালোই লাগছে। কোন সাহসে আজ এখানে এসেছে।
আমাদের ছোট্ট রকি ফ্যালফ্যাল চোখে পরিস্থিতি দেখছে। কি হয়েছে সে বুঝতে পারছে না। বড় দা রকিকে ডাকতেই সে এক দৌড়ে তার কাছে চলে গেল।-
-তুই কেমন আছিসরে ভাই?
-ভালো।
-শ্বাসকষ্ট উঠে এখন?
-কম। ইনহেলার নিয়েছি।
-আজ স্কুলে যাবি না?
-না। হেডস্যারের বউ মরে গেছে। জানো দাদা, আমি এবার বৃত্তি পেয়েছি।
-তাই নাকিরে?
-শ্রাবণী ভাবী কই? আসেনি?
বড় দা জবাব না দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি রকিকে কঠিন গলায় ডাকলাম-‘ওখান থেকে চলে আয় রকি। আয় বলছি।’ রকি আমার কাছে আসার সময় পেছনে পেছনে বড় দাও আমার কাছে এসে বলল-‘তোর বোধ হয় এক বিন্দুও রাগ কমেনি আমার উপর, তাই না?’ কোন কথা না বলে আমি ক্ষোভে জ্বলতে লাগলাম। আমাকে চুপ দেখে আবার বলল-‘তোরা সবাই আমাকে ক্ষমা কর ভাই। আমি আমার অন্যায় স্বীকার করছি।’ বড় দা’র এসব অহেতুক প্রলাপ শুনতে আমার গা ঘ্যাণ ঘ্যান করছে। অসহ্য হয়ে মুখ ফুটে বলে ফেললাম-‘এখানে এসেছিস কেন? তুই তো আমাদের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে বউ নিয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছিস। আজ আবার এখানে কেন? যা, তোর বড়লোক শ্বশুর বাড়িতে যা। সেখানে কি করেই বা যাবি! শুনেছি তোর বউ নাকি তোকে এখন আর পাত্তা দেয় না!’ আমার কথায় বড় দা আবার চুপ হয়ে গেল।
এই সেই বড় দা, আমাদের বাবা মা যাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছেন। একদিন শ্রাবণী নামের এক বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে বড় দা বাবা মায়ের সামনে এসে নত কণ্ঠে বলল-‘আমরা বিয়ে করেছি বাবা। ও শ্রাবণী। শ্রাবণী, আমার বাবা মাকে সালাম করো।’ আমি অবাক হয়ে দেখলাম লম্বা এক ফর্সা সুন্দরী মেয়ে বাবা মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করছে।
কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই শ্রাবণী ভাবীকে সহজে মেনে নিলেন বাবা মা। সংসারি মেয়ের মত অল্প দিনে আমাদের পরিবারের একজন হয়ে উঠলেন শ্রাবণী ভাবী। দিন যাবার সাথে সাথে মা আর শ্রাবণী ভাবীর সম্পর্কে ভাটা পড়তে থাকে। বড় ঘরের মেয়ে হিসেবে শ্রাবণী ভাবীর আলাদা একটা বড়াই ছিল, যা আমাদের পরিবারের কারোই ভালো লাগত না। তার বাবার ব্যাংক ভর্তি টাকা আর গুলশানের মত উন্নত এলাকায় অভিজাত বাড়ির বড়াই প্রায়ই আমাদের কাছে অসহ্য লাগত।
আমার মায়ের সুখের সংসার, যেটাতে মা সংসার বলতেন না, বলতেন স্বর্গ। সেই স্বর্গটাকে দিন দিন বিষাক্ত করে তুলেছে শ্রাবণী ভাবী। মায়ের নামে বড় দা’র কাছে অহেতুক আজে বাজে মিথ্যে নালিশ দিলে বড় দা সেটা নিয়ে মায়ের সাথে এক ধরনের সংগ্রাম শুরু করে দিত। ফলে সংসার নামের স্বর্গটা থেকে সুখ জিনিসটা ক্রমেই দূরে সরে যেতে থাকে। এমনও দেখেছি মা আর বড় দা’র তুমুল ঝগড়ার এক পর্যায়ে মা মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে যান।
ডাক্তার ডাকা হয়। আমি বাবা আর রকি মিলে মায়ের সেবা করি। বড় দা আর শ্রাবণী ভাবী ভুলেও মাকে দেখতে আসেনি। দুজনে চুপচাপ বসে রইল নিজেদের ঘরে।
একদিন ব্যাগ ভর্তি সমস্ত জামা কাপড় আর শ্রাবণী ভাবীকে নিয়ে বড় দা তার শ্বশুর বাড়িতে চলে যায়। যাবার সময় মাকে বলল এই সংসার নাকি তার কাছে এখন নরক মনে হয়। এই নরকে আর থাকা যায় না। মা বাড়ি কাঁপিয়ে কাঁদলেন। আমরা হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম বড় দা সুখের সন্ধানে বউ নিয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে।
কিন্তু সেখানে আর বেশী দিন সুখ পায়নি বড় দা। ধনীর দুলালি শ্রাবণী ভাবী বড় দা’কে আর মূল্যায়ন করে না। ফেসবুকের মাধ্যমে শ্রাবণী ভাবী খুঁজে নিয়েছে তার নতুন সাথী। এই নতুন সাথীকে নিয়ে একদিন শ্রাবণী ভাবী উদাও। একাকী হল বড় দা।
আজ সেই একাকীত্ব নিয়ে আমাদের নরকে এসেছে বড় দা, কঠিন বাস্তবতা যাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে। স্ত্রীর মোহে পড়ে ক্ষণকালের জন্য সে ভুলে গেছে এটা আমাদের মায়ের সোনার সংসার নয় কেবল, একখানা স্বর্গও।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে বড় দা বলল ‘জানি তোরা কেউ আমাকে ক্ষমা করবি না। আমাকে তো ক্ষমা না করাই উচিত। তাই চলে যাচ্ছি। আজ থেকে পথই হবে আমার ঠিকানা।’ এই বলে বড় দা যখন বাড়ি থেকে চিরতরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ায়, তখনই মা কোমল সুরে বলল-‘পথ কেন বাবা! তোর আশ্রয় হবে আমার আঁচল তলে। তোরা আমার সন্তান। আমার সন্তানেরা আমার আঁচল তলে থাকবে।’ মাকে জড়িয়ে ধরে বড় দা ব্যাকুল গলায় কাঁদতে লাগল।
তারপর সব কিছুর সমাধান খুব সহজে হয়ে গেল। আমাদের কঠিন বাবাকেও দেখলাম বড় দা’র সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিতে। মা চুলোয় মোরগ পোলাও বসিয়ে দিলেন। দুপুরে আমাদের মহাৎসবে ভোজ হল। মা আহ্লাদী গলায় বললেন ‘আমার সংসার স্বর্গে এতো শান্তি লাগছে আজ।’ বড় দা কোন কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।