ছোটগল্প – পারুল

ছোটগল্প - পারুল

নাঈমুর রহমান নাহিদ

ছগীর তার ভাঙ্গা গোয়াল ঘরটায় ঢুকে তার একমাত্র গরুটির বাঁধন খুলতে থাকে। পেছন থেকে তার চৌদ্দ বছরের মেয়ে শিউলি গামছা হাতে ছগীরের কাছে এসে দাঁড়ায়। বাবাকে গরুর বাঁধন খুলতে দেখে জিজ্ঞেস করে, ‘পারুলরে কই লইয়া যাইতাছো বাজান।’
ছগীর বাঁধন খোলা শেষ করে মেয়ের হাত থেকে গামছা নিয়ে বলল, ‘কাইল রাইতে কইছিলামনা তোরে, পারুলরে নিয়া আইজকা হাটে যামু।’
‘তুমি পারুলরে বিক্রি কইরা দিবা বাজান?’ করুণস্বরে শুধায় শিউলি।
‘আর তো কোন উপায় দেখতাছিনারে মা।’ ছগীরের কন্ঠে চরম হতাশা। ‘তোর মায়ের যখন অসুখ হইল তখন আতর আলীর থেইকা বাড়ি বন্দক রাইখা লোন নিছিলাম। লোনের শেষ তারিখ ঘনায়া আইতাছে। পারুলরে হাটে উঠায়া দেহি। যদি ভালো দাম পাই তাইলে লোনের টেকাডা পরিশোধ করতে পারুম। তোর মায়েরে তো বাঁচাইতে পারলাম না। দেহি যদি বাড়িডা বাঁচাইতে পারি।’
শিউলি এরপরে আর কোন কথা খুঁজে পায়না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে বাবার কাজ দেখতে থাকে। ছগীর পারুলের গলার নিচে হাত বুলিয়ে পারুলকে ভুসি খাওয়ায়। বালতি করে পুকুর থেকে পানি এনে সুন্দর করে গোসল করিয়ে দেয়। তারপর বের করে আনে গোয়াল ঘর থেকে। পারুলকে নিয়ে বেরিয়ে যায় হাটের উদ্দেশ্যে। শিউলি শুকনো মুখে বাড়ির দোরগোড়ায় এসে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পারুলের চলে যাওয়ার দিকে। ঘোলা হয়ে আসে তার নেত্রজোড়া। গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে কিছু যেন আটকে গেছে। ঢোঁক গিলে শিউলি। পারুল ও তার বাবা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেলে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখে মুছে ঘরের ভিতর চলে যায়।

হাটে পারুলকে নিয়ে খদ্দেরের আশায় দাঁড়িয়ে আছে ছগীর। এর মাঝে ক’জন পারুলের দাম হাঁকলেও ছগীরের তা পছন্দ হয়নি। পারুলের দিকে তাকায় ছগীর। পিঠের উপর ভনভন করে কিছু মশা উড়ছে পারুলের। গামছা উঁচিয়ে সেগুলোকে তাড়ায় সে। পারুলের পিঠে হাত বুলায়। পারুলকে প্রথম বাড়ি আনার দিনটা চোখের সামনে ভেসে উঠে ছগীরের।
শিউলির বয়স তখন পাঁচ বছর। ছগীরের বউ বেঁচে আছে তখন। গ্রামের একটি হাট থেকে একটি বাছুর কিনে আনে ছগীর। বাছুরকে দেখেই শিউলী দৌড়ে গোয়াল ঘরে চলে আসে। আদুরে কন্ঠে তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাজান, এই বাছুরের নাম কী?’
ছগীর মুচকি হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘বাছুরের তো কোন নাম থাকেনা মা।’
কথাটা শুনে শিউলির মুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। মেয়ের এমন মুখ দেখে ছগীর বলে, ‘আইচ্ছা মা, তুই-ই একটা নাম রাইখা দেয়।’
বাবার কথায় হাসি ফুটে শিউলির মুখে। গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলে, ‘আইজ থেইকা ওর নাম পারুল।’
মেয়ের কথায় হো হো করে হেসে উঠে ছগীর।

হঠাৎ এক কাস্টমার এসে পারুলের গায়ে হাত রাখলে ভাবনার সুঁতো ছিঁড়ে ছগীরের। কিছুক্ষণ দামাদামির পর অবশেষে বিক্রি হয়ে যায় শিউলির আদরের পারুল।

রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার চারিদিক গ্রাস করে রেখেছে। প্রকৃতির শোঁ শোঁ আওয়াজের মাঝে নিজ বাড়িতে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে ছগীর। তার উপর থেকে যেন বিশাল এক বোঝা সরে গেছে। আতর আলীর লোন পরিশোধের টাকা পেয়ে গেছে সে। পারুলকে তার চাহিদামত দামে বিক্রি করেছে সে। তার পাশের ঘরেই শিউলি ঘুমিয়ে। তার চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু শিউলির অজান্তেই গড়িয়ে পরে। হঠাতই একটা আওয়াজে ধড়ফড় করে উঠে বসে শিউলি। আওয়াজটা যেন আবার শুনতে পায়। নীরবতার মাঝে আবার কান পাতে সে। চোখদুটো চকচক করে উঠে তার। এ-যে তার পারুলের আওয়াজ। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ‘হাম্বা’ ‘হাম্বা’ ডেকে চলেছে পারুল। শিউলি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে। দরজা খোলার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় ছগীরের। মাথাটা একটু উঁঁচু করে হাঁক ছাড়ে সে। ‘এই রাইতের বেলা কই যাইতাছস মা?’
শিউলি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার বাবার রুমের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘পারুল ফিরা আইছে বাজান।’
‘পারুল আর আইবনারে মা।’ ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে ছগীর। ‘ওরে আমি হাটে বেইচা দিয়াইছি। স্বপ্ন দেখছস মনে হয়। যাইয়া ঘুমায়া পর।’ কথাটা বলেই বালিশে মাথা রাখে ছগীর। ঠিক তখনি বাড়ির উঠোন থেকে পারুলের ‘হাম্বা’ ডাক কানে আসে তার। সটান করে উঠে বসে সে। মনের ভিতর কে যেন বলে উঠে, ‘আমগো পারুল ফিরা আইছে!’

ইসলাম নগর, মাতুয়াইল, ঢাকা।

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
বৃষ্টি - তখন এবং এখন

বৃষ্টি – তখন এবং এখন

।গোলাম কবির  একটা সময় ছিলো, যখন বৃষ্টি হলেই জানালায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির বিন্দু গুলোকে ছুঁয়ে দেখতাম যেনো প্রেমিকার মসৃণ পেলব গাল! একটা সময় ছিলো, যখন বৃষ্টি ...
পঞ্চম ব্যক্তি - তানভীর আহমেদ সৃজন

পঞ্চম ব্যক্তি – তানভীর আহমেদ সৃজন

তানভীর আহমেদ সৃজন “ধুরর! শুধু শুধু সময় আর কতগুলো জ্বালানি অপচয় করে এলাম আমরা!” মুখ বাঁকিয়ে বলল রিকি, “কাজের কাজ কিছুই হলো না!” রিকির কথা ...
মানুষে জমিদারে কবিতে মিলিয়ে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ

মানুষে জমিদারে কবিতে মিলিয়ে শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ

মিরাজুল হক  মানুষ বিশিষ্ট ভূখণ্ডের সন্তান । মানুষের কল্পনা এবং ভাবনার বিন্যাস জল-নির্ভর , হাওয়া-নির্ভর এবং প্রাকৃতিক সম্পধ নির্ভর । কবি মহাকবিরা প্রকৃতির এই সংশ্লেষের ...
নীল বেদনা

নীল বেদনা

আশিক মাহমুদ রিয়াদ ঐ নীল চোখা বেদনার মধ্যে একধরণের মিশ্র সুখ আছে! তুমি জানো সেসব কথা। শেষবার যখন হাত ধরেছিলে তখন আমার নাকের নিচে গোফের ...
ভোরের ডাকে

ভোরের ডাকে

সেকেন্দার আলি সেখ রাত গিয়েছে পাহাড় চূড়োয় দিন এসেছে ফিরে ফুল ফুটেছে ভোরের আলোয় সারা বাগান ঘিরে তাইতো মাঝি বৈঠা ঠেলে বাইছে দাঁড় দূরে l ...
বিপন্ন বিস্ময়

বিপন্ন বিস্ময়

কষ্টের কবিতা – অরবিন্দ মাজি   মনের বদল প্রতিটি মুহূর্তে, যেমন বদলায় দৃশ‍্যপট…  সূর্য-কুয়াশার লুকোচুরি খেলা- সেখানেও  পরিবর্তনের মেলা…    ইদানিং প্রিয়জনের চোখেও – পরিবর্তনের ...