মোঃ ইমন শেখ
তখন সবেমাত্র পুলিশে জয়েন করেছি। ঘটনাটি সেই সময়কার। সেবার শীতের সময় পরপর তিনটে খুন হয়। রাকিব নামক জনৈক যুবককে দিয়েই শুরু হয় খুনের সিলসিলা। ঘটনাটি ঘটে ওর নিজ বাসাতে। দরজার সামনেই পড়ে ছিল ওর গুলিবিদ্ধ লাশ। রুমের সবকিছু সুন্দর করে সাজানো গোছানোই ছিল। সিন্দুক, আলমারি সব একেবারে অক্ষত। কোথাও বিন্দুমাত্র ধস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছিলো খুনি হয়তো প্রথমে দরজায় নক করেছে। তারপর রাকিব যখন দরজা খুলেছে ঠিক তখনই গুলি চালিয়েছে। তবে আশেপাশের লোকজন গুলির শব্দ শুনতে পায়নি।
রাকিবের পর পলাশকে খুন করা হয়। ওর অফিস গেটের সামনে ঘটনাটি ঘটে। এক্ষেত্রেও গুলি চলেছে। অথচ কেউ গুলির শব্দ শুনতে পায়নি। দারোয়ানের ভাষ্য মতে সন্ধ্যার দিকে একজন অদ্ভুত রকমের লোক গেটের সামনে ঘোরাঘুরি করছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে। লোকটি বড়বড় স্থির চোখে মাথা নিচু করে পায়চারি করছিল। কি দরকার জানতে চাওয়া হলেও সে কোন উত্তর দেয় নি। পাগল ভেবে দারোয়ান তাকে তাড়িয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর সে সিগারেট কিনতে গিয়েছিল মজনুর দোকানে। দোকান বেশি দূরে না। ৪/৫ মিনিটের পথ। ফিরে এসে দেখে লাশ পড়ে আছে গেটে। পরে সে-ই সবাইকে খবর দেয়।
তৃতীয় খুনের ঘটনাটি ঘটে শহরের অদূরে অপেক্ষাকৃত জনশূন্য এলাকায়। রাস্তার পাশে লাশ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন থানায় খবর দেয়। পরে পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে। কয়েকদিনের মধ্যেই পুলিশ নিহত ব্যক্তির নাম পরিচয় খুঁজে বের করে। নিহতের নাম জনি। জনিকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
ঘটনার তদন্তশুরুর পর মনে হচ্ছিল এটি সিরিয়াল কিলিং। কতগুলো বিষয়ের আশ্চর্যজনক মিল থেকেই ওরকম ধারনা কাজ করছিল মাথায়। নিহত তিনজনের বয়স প্রায় কাছাকাছি। তিনটি খুনের ধরন একই রকম। তিনজনকেই গুলি করে হত্যা করা হয়। বন্দুকে হয়তো সাইলেন্সার লাগানো ছিল। তাই গুলির শব্দ শোনা যায় নি। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে খুন তিনটি হয়েছে সমান্তর ধারায়। প্রতিটি খুনের মধ্যবর্তী সময়ের ব্যবধান এক মাস। তারমানে খুনি যথেষ্ট পরিকল্পনা করেই মাঠে নেমেছিল। তদন্তেকিছু দূর এগোনোর পর সিরিয়াল কিলিংয়ের সম্ভাবনাকে নাকচ করতে হলো। কেননা সিরিয়াল কিলিং এ সাধারণত খুনি একটা বার্তা দিতে চায়। খুনের ধরনও হয় অত্যন্তনৃশংস। তাছাড়া মাত্র ২/৩ টি খুন করে সিরিয়াল কিলার তৃপ্ত হয় না। খুনের তালিকা আরও লম্বা হয়। এক্ষেত্রে সেরকমটি হয় নি। তাহলে কি এটি রিভেঞ্জ কিলিং? নাকি তিনটি বিচ্ছিন্নহত্যাকান্ড? দ্বিতীয় ধারণা সঠিক হলে হত্যাকান্ড তিনটির মধ্যকার এই মিল নিতান্তই কাকতালীয়। কিন্তু একসাথে এতগুলো বিষয় কাকতালীয় হওয়া কষ্টসাধ্য। তাই ধরে নিলাম এটা রিভেঞ্জ কিলিং। সেক্ষেত্রে নিহতদের মধ্যে পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্কথাকতে হবে। শুরু হলো আন্তঃসম্পর্কউদঘাটনের মিশন। এ পর্যন্তবলে বিহারি কাকা থামলেন। রহস্যময় দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন একবার। আমরা আঁটসাঁট হয়ে বসলাম। মৃদু হেসে তিনি আবার শুরু করলেন।
আন্তঃসম্পর্কউদঘাটন মিশনের শুরুতেই রাকিবের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। জানা গেল ওখানে সে ভাড়া থাকতো। বাড়ির মালিক ওর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। জানার প্রয়োজনও মনে করেন না। কারণ ভাড়াটিয়ার সাথে না ভাড়াটিয়ার টাকার সাথেই তার সম্পর্ক। মাসে মাসে ওই টাকাটাই ঠিকঠাক মতো আদায় করেছেন। আর কিছু জানার প্রয়োজন মনে করেননি। আশেপাশের লোকজনও তেমন কিছু বলতে পারলো না। তবে গলির মোড়ের চায়ের দোকানদারের কাছ থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণতথ্য পাওয়া গেল। দোকানদারের ভাষ্য মতে রাকিব প্রায় রাতেই মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতো। গলি দিয়ে ঢোকার সময় কয়েকবার সে তার দোকানে সিগারেট কিনতে গিয়েছে। তখনই বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল সে। যাক নতুন তথ্য পাওয়া গেল। কিন্তু আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি তখনো অন্ধকারে। দোকানী, বাড়ির মালিক এবং আশেপাশের লোকজন কেউই রাকিবের কাছে কাউকে কখনো আসতে দেখেনি। তাদেরকে পলাশ ও জনির ছবি দেখালাম। কেউই ওদের চিনতে পারলো না। এমনকি ছবির ব্যক্তিদ্বয়কে তারা ঐ এলাকায় কখনো দেখেছে বলেও মনে করতে পারলো না। এবার পলাশের অফিসে গিয়ে হানা দিলাম। সহকর্মীদের মতে পলাশ খুব ভালো ছেলে। সবার সাথেই তার সুসম্পর্কছিল। ওর যে কোন শত্রু থাকতে পারে এটা তারা ভাবতেও পারে না। জানা গেল অফিস থেকে কিছুটা দূরেই একটা মেসে থাকতো সে। পৌঁছে গেলাম সেই মেসে। ওখানকার সকলেও ওকে এককথায় ভালো ছেলে বলে সার্টিফিকেট দিল। তবে ওর রুমমেটের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে পলাশ মাঝেমধ্যে ড্রাঙ্কেন অবস্থায় ফিরত। কিন্তু মাতলামি করেনি কখনো। আর তেমন কোন তথ্য পেলাম না। আন্তঃসম্পর্কের বিষয়ে এবারও নিরাশ হতে হলো। অবশেষে আশার আলোর দেখা পেলাম জনির বাড়িতে গিয়ে। বাড়িতে ওর মা ছাড়া আর কেউ থাকে না। ভদ্রমহিলা ছেলের শোক তখনো পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। কথা বলতে বলতেই কেঁদে ফেলছিলেন। ছেলের বিরুদ্ধে তার একগাদা অভিযোগ। মায়ের কথামতো কখনো চলেনি সে। ডানে যেতে বললে বামে আর বামে বললে ডানে গিয়েছে সবসময়। অসৎ সঙ্গে পড়ে গাঁজা মদে আসক্ত হয়ে সব স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মানে এখানেও সেই মদের নেশা।
তিনজনই যেহেতুপ্রায় সমবয়সী সুতরাং তাদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্বের একটা সম্ভাবনা আগে থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। মদের সাথে তিনজনের কমন সম্পর্কপাওয়ার পর সেই সম্ভাবনার ভিত্তি আরও মজবুত হয়। আমার কল্পিত এই আন্তঃসম্পর্কের সপক্ষে কোন অকাট্য প্রমাণ কিন্তু তখন পর্যন্তমেলেনি। তবু কেন জানি একই টেবিলে বসে ওই তিনজনের মদ পানের একটা দৃশ্য আমার কল্পনায় ভাসছিল। সে কল্পনা যে এতো দ্রæত সত্য হয়ে যাবে তা আমি ভাবতেই পারিনি। ওই যে কথায় আছে না ছবি কথা বলে। এক্ষেত্রেও কিন্তু ছবি কথা বললো। জনির মায়ের সাথে কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই ডান পাশের দেয়ালে চোখ পড়ল। সোনালী ফ্রেমে বাঁধানো ছবিতে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে চার যুবক। রাকিব, পলাশ, জনি ছাড়াও আরো একজন। ভদ্রমহিলা জানালেন চতুর্থজনের নাম নয়ন। ওরা চারজনেই একই কলেজে পড়তো। খুব ভালো বন্ধুত্বছিল ওদের মধ্যে। জনির সাথে বহুবার ওরা ওই বাড়িতে গিয়েছে। ভদ্রমহিলা আর বেশি কিছু বলতে পারলেন না। ফেরত দেওয়ার শর্তে তার কাছ থেকে ছবিটি চেয়ে নিলাম। পলাশের অফিসের সেই দারোয়ান নিশ্চিত করলো নয়নই সেই অদ্ভুত লোক যাকে সেদিন সে দেখেছিল। সুতরাং নয়নকে খুনি ভাবতে আপাত দৃষ্টিতে কোন বাধা রইল না। আবার সে যদি খুনি না-ও হয় তবুও তার সাথে সাক্ষাৎ করাটা ভীষণ জরুরী। কেননা ও-ই একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে নিহত তিনজনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কছিল। তাই অচিরেই নয়নের খোঁজ পড়লো। সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে জনির মায়ের কাছ থেকেই ওর ঠিকানা পাওয়া গেল। পৌঁছে গেলাম সেই ঠিকানায়। কিন্তু নয়নকে জীবীত অবস্থায় পেলাম না। আত্মহত্যা করেছে সে। তাহলে কি তিন বন্ধুকে খুন করে অনুশোচনায় এই আত্মহত্যা? সে সম্ভাবনাই বেশি। তবু রহস্য থেকে যায়। কেননা খুনের কারণ তখনো অজানা। যে জানতো সে সিলিংয়ে ঝুলছে। কোন সুইসাইড নোটও রেখে যায় নি। এ ধরনের ঘটনায় সুইসাইড নোট রেখে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তন্নতন্নকরে খুঁজেও তা পেলাম না। তবে যা পেলাম সেটি রহস্য আরও বাড়িয়ে দিল। যতœকরে গুছিয়ে রাখা একটি পেপার কাটিং আর একজন সাইকিয়াট্রিস্টের প্রেসক্রিপশন। নতুন রহস্যের সূত্রপাত হলো এখান থেকে। পেপার কাটিংয়ের সংবাদটি ছিল ৫ বছর আগেকার এক ধর্ষণ সম্পর্কে। ঐ ঘটনার সাথে কি নয়নের কোন সম্পর্কছিল? নাহলে ওই পেপার কাটিং যতœকরে গুছিয়ে রাখবে কেন? আবার যদি কোনো সম্পর্কথাকেও তাহলে সেটি ঠিক কি ধরনের সম্পর্ক? শুধু কি নয়ন নাকি নিহত তিনজনের সাথেও ধর্ষণের যোগসূত্র ছিল? দুটো রহস্য কি এক সূত্রে গাঁথা? অসংখ্য অমীমাংসীত প্রশ্ন। উত্তর পেতে হলে ধর্ষণের ঘটনার আদ্য পান্তজানা জরুরী। পেপার কাটিং থেকে জানা গেল ঐ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছিল পাশের থানায়। সাল তারিখ থেকে সহজেই মামলার নথিপত্র খুঁজে বের করা সম্ভব। জরুরী ভিত্তিতে ওই মামলার নথিপত্র তলব করে পাঠালাম। বিহারি কাকার কন্ঠ আরও রহস্যময় হয়ে উঠলো। সেই প্রেসক্রিপশনের কথা মনে আছে তোদের? আমাদের উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই তিনি বলতে শুরু করলেন। ওই প্রেসক্রিপশনটা কিন্তু এ মামলার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণএভিডেন্স। কেননা ওই প্রেসক্রিপশন থেকেই স্পষ্ট যে নয়ন মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। এখন ওর ঠিক কি ধরনের মানসিক সমস্যা ছিল সেটি জানাও জরুরী। এ রহস্য উদঘাটনে এবার হাজির হলাম ওই প্রেসক্রিপশনকারী সাইকিয়াট্রিস্ট মহাশয়ের চেম্বারে।
ভদ্রলোকের নাম আদুর রউফ। একজন নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট। তবে দুঃখের বিষয় তিনি আমাকে ঠিক প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করলেন না। স্পষ্ট করে কোন তথ্যই দিলেন না তিনি। পেশাগত এথিকসের দোহাই দিয়ে যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। ফলে নয়ন সম্পর্কেতেমন কোন তথ্য না পেয়ে ব্যর্থমনোরথে ফিরে এলাম। তাহলে কি রহস্যের জট খুলবে না? শেষ হয়েও কি শেষ হবে না এই কেইস? এই কথাগুলোই বিষন্নমনে ভেবে চলেছি বারবার। তখন হঠাৎ করেই বিষয়টি নজরে এলো। প্রেসক্রিপশনের শেষ তিনটি এপোয়েনমেন্টের তারিখ আর রাকিব, পলাশ ও জনির খুনের তারিখে আশ্চর্যজনক মিল। সেই থেকেই একটা খটকা কাজ করছিল মনে। তাহলে রউফ সাহেব মানে ওই সাইকিয়াট্রিস্ট কি খুনগুলোর সাথে কোনভাবে জড়িত? এথিকসের দোহাই দিয়ে কিছু একটা লুকানোর চেষ্টা করছেন না তো তিনি? সন্দেহটা পোক্ত হলো ধর্ষণ মামলার নথিপত্র পাওয়ার পর। আবারও ছুটে গেলাম তার চেম্বারে। ঠারেঠোরে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে ভালোই ভালো সব স্বীকার করুন। নতুবা বিপদ আছে। ভদ্রলোক খুব রূঢ় আচরণ শুরু করলেন। আর তখনই বোমাটা ফাটালাম। কাজও হলো। ৫ বছর আগেকার ধর্ষণের ঘটনার উল্লেখ করতেই ভদ্রলোক চুপসে গেলেন। প্রচন্ড শীতের মধ্যেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হলো তার কপালে। টিস্যু পেপার এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – নীরুকে চেনেন? ভদ্রলোক ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু মুখ খুললেন না। পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম – নিজের মেয়েকেই চিনতে পারছেন না? নাকি তার সম্পর্কেবলতেও আপনার এথিকসের বাধা আছে? তারপর আর কিছুই করতে হলো না। ভদ্রলোক নিজেই গড়গড় করে সব বলে যেতে লাগলেন। হ্যা,নীরু ছিল আমার একমাত্র মেয়ে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও কলেজে গিয়েছিল। রোজ দুপুর তিনটার দিকে বাড়ি ফিরতো সে। কিন্তু সেদিন দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। তবু ফিরল না সে। কত খোঁজাখুজি করলাম। পেলাম না। পেলাম পরের দিন। রাস্তার পাশে ঝোপের আড়ালে পড়ে ছিল তার চাকুবিদ্ধ ক্ষতবিক্ষত লাশ। সেই লাশ নিয়েও কতো দৌড়াদৌড়ি। থানা, পুলিশ, মেডিকেল, লাশকাটা ঘর। জানা গেল নীরুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। গণধর্ষণ। শোকে মুষড়ে পড়েছিলাম। তবু আশা ছিল এই জঘন্য অপরাধীরা ধরা পড়বে। সুস্থ বিচার হবে। কিন্তু কিছুই হলো না। বছরের পর বছর পেরিয়ে যেতে লাগলো। ওই ঘটনার কোন কুলকিনারা পেল না পুলিশ। আমিও আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু ঘটনার ঠিক ৫ বছরের মাথায় এসে হঠাৎ মিরাকল ঘটলো। রউফ সাহেব একটুথামলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন- আপনি ম্যাকবেথ পড়েছেন? রাজা ডানকানকে হত্যার পর লেডি ম্যাকবেথের অসুখের কথা মনে আছে? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে তিনি বলে গেলেন- স্মরণ করুন তো ঘুমের মধ্যে লেডি ম্যাকবেথের সংলাপ। ” আমার হাত দুটো কি কখনো পরিষ্কার হবে না? হাতে রক্তের গন্ধ, আরবের সমস্তআতর ঢেলে দিলেও সে দুর্গন্ধ দূর হবে না। ”
রউফ সাহেব হাসলেন। এই কেইসের লেডি ম্যাকবেথ হলো নয়ন। একদিন আমার চেম্বারে এসে লেডি ম্যাকবেথের মতোই প্রশ্নটি করে সে। আমার হাতের রক্তের দাগ কি কখনো দূর হবে না? আমি বললাম অবশ্যই হবে। তার আগে সব খুলে বলতে হবে। অনুশোচনা আর পাপবোধ তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল। লোকে পুলিশের কাছে মিথ্যে বললেও ডাক্তারকে কিন্তু মিথ্যে বলে না। কারণ তাতে রোগ সারার বদলে বাড়ে।
এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। তাছাড়া মানসিক সমস্যাটা নয়নকে এতোটাই কাবু করে ফেলেছিল যে যেকোন উপায়ে এর থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছিল সে। সুতরাং তার পাপগ্রস্তমন অপরাধ স্বীকার করলো। আর তখনই ধর্ষণের কথা জানতে পারলাম। তবে রাকিব, পলাশ কিংবা জনির জড়িত থাকার কথা কিন্তু সে স্বীকার করেনি। ওটা আমি নিজে উদঘাটন করি। ওকে হিপনোটাইজ করে পুরো ঘটনাটা জেনে নিই। নীরুকে ওরা অপহরণ করে। তারপর সারারাত ওর ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। মাতালগুলোর নির্যাতন সহ্য করেও মেয়েটি আমার বেঁচে ছিল। কিন্তু ছুরিকাঘাতে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। জানেন ছুরি চালিয়েছিল কে? নয়ন। সেই থেকে ৫ টি বছর কেটে গেল। সবাই ভুলে গেল নীরুকে। কিন্তু বাবা হয়ে আমি কি তাকে ভুলে যেতে পারি? পারি না। আপনার আইনের ওপর তো ভরসা করেছিলাম। কিছু কি করতে পারলেন আপনারা? পারলেন না। কিন্তু অপরাধীরা তো পার পেয়ে যেতে পারে না। তাদেরকে শাস্তিপেতেই হবে। তাই আমাকেই ব্যবস্থা করতে হলো। নয়নের দুর্বল মানসিকতা থেকেই বুদ্ধিটা আসে। ওকে হিপনোটাইজ করে প্রথমে রাকিব, তারপর পলাশ এবং সবশেষে জনিকে খুন করালাম। এমনকি নয়নের সুইসাইড ওটাও আমার পরিকল্পনা। সবই হিপনোটাইজের কেরামতি।
পুরো ঘটনাটা এবার পরিষ্কার। রাকিব, পলাশ, জনি, নয়ন প্রত্যেকেই অপরাধী। মেয়ের হত্যাকারীদের খুঁজে পেয়ে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে রউফ সাহেবের মনে। কাউন্সিলিং এর আড়ালে প্রত্যেক এপোয়েনমেন্টে নয়নকে হিপনোটাইজ করেন তিনি। তারপর তার হাতে তুলে দেন বন্দুক। অর্থাৎ নয়ন খুনগুলো করেছে হিপনোটাইজ হয়ে। আর একারণেই পলাশের অফিসের দারোয়ানের মনে হয়েছিল লোকটি ঘোরের মধ্যে আছে।
বহুদিন আগে শোনা বিহারি কাকার গল্পটি মনে পড়ে গেল আজ। রউফ সাহেবের কষ্টটা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারি এখন। কেননা আমার দশাও যে তার মতো। তবে এখন সে কথা থাক। প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে বুকে। আগে অপরাধীগুলোকে শাস্তিদিয়ে সে আগুন ঠান্ডা করি। তারপর নাহয় তোমাদের জন্য লিখবো আরও এক হতভাগ্য পিতার কাহিনী।