আশরাফ আলী চারু
পুঁটিজানী বিলের পাড়ে শ্যামল সরকার নতুন বাড়ি গড়েছেন। আশে পাশে আর কোন বাড়ি ঘর নেই। নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশ নিয়ে বিলের পাড়ে শোভাবর্ধণ করছে নতুন বাড়িটা। বিলের পাড়ের কাশফুল গুলো হেলে দুলে স্বাগত জানাচ্ছে নতুন বাড়িটাকে। বিলের শাপলা গুলো দুচোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে বাড়ির মানুষগুলোর। এ বাড়ির বাসিন্দারা হলেন শ্যামল সরকার, তার মা, বউ, দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে কমল সরকার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে, মেজো জন মেয়ে, সে পড়ে সপ্তম শ্রেণীতে, ছোট ছেলে পড়ে চতুর্থ শ্রেণী। শ্যামল সরকার পেশায় একজন শিক্ষক, স্ত্রী গৃহিণী আর বয়স্ক মা সংসারের সবাইকে দেখাশোনা করেন। সবমিলিয়ে নতুন বাড়িতে ভালোই যাচ্ছিলো। কিন্তু গতকাল সন্ধায় ঘটে যাওয়া একটা সমস্যার কারনে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন শ্যামল সরকার। বড় ছেলে কমল বিকেল বেলায় বিলের উত্তর দিকের খোলা মাঠে একাই দৌড়াদৌড়ি করছিলো আর কি জানি উচ্চ শব্দে বলার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু কোন শব্দ হচ্ছিলো না।
কমলের এমন কান্ড দেখে পরিবারের সবাই তার কাছে ছুটে যায়। সবাই কমলকে ডাকাডাকি করে, জানতে চায় কমল কি বলতে চাইছে। কমলের কি হয়েছে? কিন্তু পরিবারের লোকজনের উপস্থিতি বা তাদের কোনো কথাতেই কর্ণপাত না করে কমল তার মতো করে তার কাজ করতে থাকে, দৌড়াতে থাকে । এরপর সবাই কমলকে ধরে পাঁজাকুলে করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। কমলের দাদী আহাজারি করছেন, এখানে বাড়ি করতে মানা করলাম তাও এখানে বাড়ি করলি বাপ, এবার দেখে নে ভূতের আছড় কারে কয় ? মায়ের আহাজারি আর ছেলের এই সমস্যা নিয়ে শ্যামল খুব দুশ্চিন্তায় আছে।
এতক্ষণ ছেলেটা কোন কথা বলছিলো না। এখন একটু একটু করে কথা বলতে শুরু করেছে। দাদী জিজ্ঞেস করলেন- কমল ভাইয়া, তোমার কি হয়েছিলো? ভাইয়া বলোনা আমরা যে তোমাকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি।
এবার কমল মুখ খুললো – কিছুই হয়নি দাদী।
তবে মিছিলের মতো লাইনে দাড়িয়ে কি কি যেনো বলতে ছিলে?
মিছিল করতে ছিলাম। জানো দাদী, ওখানের দলনেতা আমাকে ডেকে নিয়ে বললো, কমল,পাকবাহিনী আমাদের উপর যেভাবে নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে আমরা যদি এখনো প্রতিবাদী না হই তবে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। তাই তাদের সাথে মিছিল করলাম, প্রতিবাদ করলাম, যুদ্ধ করলাম। জানো দাদী পাকবাহিনীকে আমরা পরাজিত করেছি। আমরা জয়লাভ করেছি। আরও অনেক কিছু আলোচনা হলো তাদের।
এরপর কোনো মত রাত কেটে সকাল হলো। কমলের বাবা পাশের গ্রামের অশীতিপর ইমাম সাহেবকে ডেকে এনে সমস্ত ঘটনা খোলে বললেন। ইমাম সাহেব সব শুনে বললেন- মাস্টার সাহেব ৭১ সালে পাকবাহিনীর লোকেরা এখানে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল আপনার মনে আছে ? এ ঘটনা আমাদের অনেকেই মনে রেখেছি আবার অনেকেই ভুলেও গেছি। এবার কমলকে উদ্দেশ্য করে বললেন-আচ্ছা কমল, তোমাদের স্কুলে স্যারদের কেউ কি পুঁটিজানী বিলের হত্যাযজ্ঞের কাহিনি তোমাদের সাথে আলোচনা করেছে ?
কমল বললো- জি হুজুর,আজ বাংলা স্যার আলোচনা করেছেন।
মাস্টার সাহেব, আমি যা চিন্তা করেছিলাম তাই হয়েছে। তোমার ছেলে এখানের পাকবাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনা শুনে বাড়িতে ফিরে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। তাই এমনটা ঘটেছে। তোমার ছেলের দেশের প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা আছে বলেই এমন ঘটনা ঘটেছে। চিন্তা করোনা তোমার ছেলের কোন ক্ষতিই হবেনা। তোমার এ সোনার ছেলে যে – পুঁটিজানীর স্বাধীনতার কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলো ।
মাধবপুর, শেরপুর টাউন, শেরপুর।