জোবায়ের রাজু
কুসুমের প্রতি সাজেদা খানের এত আদর ভালোবাসা দেখলে যে কেউ বলবে যে ,কুসুম সাজেদা খানের পেটের সন্তান। অথচ সত্য এই যে, সাজেদা খানের মা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে এক সড়ক দুর্ঘটনায়। কাশেম খানের সাথে বিয়ের সাত মাস পর কুমিল্লায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় তলপেটে প্রচন্ড আঘাত খেয়ে সাজেদা খানের মা হওয়ার ক্ষমতা চিরতরে হারায়। এই ঘটনার পাঁছ বছর পর কুসুমকে দওক নেয় সাজেদা খান।
রামনগরের কুসুমের বাবা যখন এক ভুল চিকিৎসায় মারা যায়, তখন কুসুমের বয়স দেড় বছর। আবার যখন কুসুমের আট বছর বয়স, তখন তার মা হার্ট এ্যাটাকে মারা যায়। এতিম কুসুম পড়ে মহা বিপদে। তার চাচারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে , তারা কুসুমের কোন দায়ভার নিতে পারবে না। আর মামা খালারাতো ভরন পোষণের ভয়ে কুসুমের কোন খবরই রাখেনি। নিজেদের ব্যস্ততা দেখিয়ে সবাই কেটে পড়েছে। কুসুমের বাড়ির পাশে ছিল রাম নগর প্রাইমারি স্কুলের ম্যাডাম শিরিন সুলতানা। শিরিন সুলতানা তার মামাতো বোন সাজেদা খানকে চিঠি লিখে কুসুম সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়। খবর পেয়ে সাজেদা স্বামী কাশেম খানকে রাম নগরে এসে কুসুমকে নিয়ে যায়।
কুসুমের গায়ের রং ছিল তখন শ্যামলা। স্বার্থ্যরেও তেমন উন্নতি ছিল না। চুলগুলো জট বাঁধানো। বুকের হাড়গুলো গোনা যেত। সাজেদা খানের কাছে এসে কুসুম পরিবর্তন হতে থাকে। আদর যতেœর পাশাপাশি মাতৃ¯েœহ পেয়ে বড় হতে থাকে এবং সাজেদা খান দেখেন যে মেয়েটি শ্যামলা রঙ্গের হলেও আশ্চার্য রকম রুপবতী। দিন দিন সাজেদা খানের চোখে কুসুমের সৌন্দর্য ধরা পড়ে। সাজেদা খান সবচেয়ে অবাক হয় কুসুমের গান শুনে। মেয়েটি কি অসাধারন গাইতে পারে। জানা গেছে কুসুমের বাবাও নাকি ছিলেন রাম নগর যাএাপালার নিয়মিত গায়ক। যার গান মানুষ মুগ্ধ হয়ে শুনতো।
দুই.
সেই কুসুম চার বিষয়ে লেটার নিয়ে মেট্টিক পাস করেছে। মেয়ের ফলাফলে সাজেদা খান বেশ খুশি। কুসুম মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সাজেদা খানের সামনে এসে বলে- রাম নগরের এক ভাঙ্গা ঘর থেকে আমায় তুলে এনেছেন। মেয়ের মত ¯েœহ করেছেন। আজ আমার এই ফলাফলতো আপনারই অবদান। নেন, মিষ্টি নেন। ’ কুসুমের কথা শোনে সাজেদা খান শিশুর মত কেঁদে পেলে। তিনি খেয়াল করলেন, কুসুমের চোখ দুটোও ভেজা।
একদিন ঘটলো এক অকল্পনীয় ঘটনা। কুসুম নাজিম নামের এক ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে। এই ঘটনা মানতে পারছেন না সাজেদা খান। তিনি চোখের জলে বুক ভাসাচ্ছেন। মনে মনে কুসুমকে ডাকছেন। কাশেম খান মলিন মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি কুসুমের এই প্রতিদান আশা করেননি। জগতে কাকে বিশ্বাস করবেন।
কুসুম চলে যাবার প্রায় এক মাস পর এক ভোর রাতে সাজেদা খানের ফোনে একটি কল আসে।
– হ্যালো মা, আমি কুসুম। আপনাদের সবাইকে কষ্ট দিয়ে আমি চলে এলাম নাজিমের সাথে। ভেবেছিলাম সে অনেক ভালো ছেলে। কিন্তু আমার ভুল ভাঙ্গলো মা। নাজিম একটা নেশাখোর। অনেক মেয়ের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক। আমি এটা মানতে পারছি না গো মা। এখন কি হবে আমার ? ’
সাজেদা খান কিছু বলতে পারছেন না। কি শুনছেন এসব ! কুসুম কল করেছে এটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
তিন.
সাড়ে তিন বছর পরের এক সন্ধ্যা বেলা। বাসায় কাশেম খান আর সাজেদা খান ছাড়া কেহ নেই। হঠাৎ কলিংবেল বাজলো। সাজেদা খান দরজা খুলে দেখেন বাইরে কুসুম দাঁড়িয়ে আছে। তার কোলে ছোট্ট একটি বাচ্ছা। বয়স দুই মাস।
‘ মাগো আমি ফিরে এলাম। নাজিমের মত অমানুষের ঘরে থাকা সম্ভব হচ্ছে না বলে আমি আমার সন্তানকে নিয়ে চলে এলাম। আমি বুঝতে পারছি আপনি ছাড়া আমায় আর কেউ ভালোবাসতে পারবে না। আপনার ওই বুকে আমায় আশ্রয় দিবেন না ? ’
সাজেদা খান চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। কাশেম খান এসে বললেন- তোর আর এখানে জায়গা নেই। নিজের সন্তানের মত ভালোবেসেছি বলে এই প্রতিদান দিলি ? আমরা নিঃসন্তান ছিলাম, এখনো নিঃসন্তান। কুসুম নামের কাউকে আমরা চিনি না। ’
কাঁপা গলায় কথাগুলি বলে গেল কাশেম খান। তিনি তাকিয়ে আছেন কুসুমের কোলের ওই বাচ্ছাটার দিকে। তার বুকটা হু হু করে উঠল। এরকম একটি সন্তানের বাবাতো তিনিও হতে পারতেন। কুসুমের মত সে সন্তানকে আদর ভালোবাসায় বড় করতেন। আচ্ছা , সে সন্তানও কি কুসুমের মত একই প্রতিদান তাদের দিত ? কাশেম খান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।