ড. গৌতম সরকার
আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, “তোমার জীবনে প্রথম নারী কে?
আমি আমার মায়ের কথা বলবো।
সেই অন্ধকার কন্দরের ঘষা কাঁচের স্মৃতি পেরিয়ে
মায়ের শরীর থেকে ভেসে আসত জবাকুসুম তেলের গন্ধ,
বিকেলবেলাটা কখন যেন খোলা মাঠ পেরিয়ে দূরের সিপাহীজলার বুকে
হারিয়ে যেত, ঠিক তখনই মায়ের চারপাশ জুড়ে
চাঁপাফুলের নেশাগন্ধের সাথে কর্পূর ও রেড়ির তেলের গন্ধ মিশে থাকত৷
সন্ধেবেলা তেল, মশলা, হলুদ, লঙ্কাফোড়ন ছাড়িয়ে
তুহিনা স্নো আর ল্যাভেন্ডার পাউডারের স্নেহগন্ধ
আমাকে রূপকথা পেরিয়ে, পক্ষীরাজে চড়িয়ে কোন কোন সব মুলুকে পৌঁছে দিত!
কেউ যদি আমাকে প্রশ্ন করে, তোমার জীবনের প্রথম প্রেমিকা কে–
আমি আমার মায়ের কথা বলবো।
ছোটবেলা মানে তের-চোদ্দ বছর বয়স পর্যন্ত মাকে আদর,
শাসন, অত্যাচার, বিরক্ত, পিছন থেকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরা,
ধেড়ে ছেলের আচমকা বুকের মধ্যে মুখ গোঁজা, মাঝ রাতে আমার ঘুমন্ত
মায়ের কপালে চুমু খাওয়া সব কিছুই ছিল আমার প্রেম।
আরেকটু বড় হতে প্রেমের ধরণটা বদলে গেল। তখন কথা না শোনা,
অকারণে টেনশন দেওয়া, পড়াশোনায় অবহেলা, বন্ধুদের সাথে
লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেটে টান,
ভাঙা গলায় ভেঙে যাওয়া গালে উত্থিত অসংখ্য ব্রণ,
সরস্বতী পূজোর সকালে ফুলবাবু হয়ে গন্ধসাবান আর পাউডার মেখে
হারকিউলিস সাইকেলে চক্কর…..আর আমার সুন্দরী মা,
আমার বিদুষী মা, আমার রাগী মা, আমার দুঃখী মা
দিনরাত আমার অধঃপতনের
সিঁড়িভাঙা অঙ্ক পেরোতে না পেরে যারপরনাই বিপর্যস্ত হত,
সেটাই ছিল আমার প্রেম।
আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে জীবনে কোন নারীকে
তুমি সবথেকে বেশি জ্বালিয়েছো, আমি আমার মায়ের কথাই বলবো।
যখন আরেকটু বড় হলাম, সেই নারীর সাথে প্রথম বিচ্ছেদ।
বাড়ি থেকে বহু দূরে একাকী বিজনে সেই নারী প্রতি রাতে
আমার চোখে জল আনতো। জীবনে প্রথমবার অনুভব করলাম বিরহ কত বেদনার।
তখন মোবাইল যুগ আসতে অনেক দেরি। আমার প্রৌঢ়া মা
দিনের পর দিন উন্মুখ বসে থাকত আমার দুছত্র চিঠির প্রত্যাশায়। তাঁর লেখা উত্তরে শুধুই
আমি কেমন আছি, কী খাচ্ছি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর নিজের জন্য একটা বাক্যও থাকতো না।
কেউ যদি প্রশ্ন করে, জীবনে কোন নারী তোমাকে সবথেকে বেশি কাঁদিয়েছে….
আমি আমার মায়ের কথা বলবো।
বয়স বাড়ছে, মা আমার আস্তে আস্তে বুড়ো হচ্ছে।
আমার ঘর-বসত হল, অপত্য স্নেহ টের পেলাম।
ওই মহিলাকে নিয়ে ভাববার অবকাশ কমে এল। তবু কোনও কালবৈশাখীর বিকেলে,
কিংবা ভরা শ্রাবনের রাতে, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস, প্রকৃতির অভিশাপে
বুকটা আশঙ্কায় ঠান্ডা হয়ে উঠত। অফিস থেকে বহু কষ্টে
ট্রাঙ্ককল বুক করে বুড়িটার সাথে কথা হত। আমার মা বড় অবুঝ ছিল, জেদিও ছিল,
শ্বশুরের ভিটেমাটি ছেড়ে ছেলের সংসারে কোনোদিন এলোনা।
তারপর একদিন আমার প্রথম প্রেম কখন যেন
গোলাপের শুকনো পাপড়ি হয়ে ঝরে পড়ল।
গঙ্গা দিয়ে জল বয়ে চলতে লাগলো। শুধু আমার বুকের
একটা প্রকোষ্ঠ কর্কটরোগে ক্ষইতে শুরু করলো। কেউ যদি প্রশ্ন করে,
কোন নারী তোমাকে সবথেকে বেশি কষ্ট দিয়েছে….
আমি আমার মায়ের কথা বলবো।
‘আজ বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’
শীতে তাড়সে শরীর জবুথবু৷ আত্মজরা দেশবিদেশে ছড়িয়ে…..
অতি সঙ্কটেও তাদের অস্থির করতে ইচ্ছে হয়না। আর করেই বা কি হবে?
সহস্র-অযুত মাইল দূর থেকে চেনা গতের কতকগুলো উপদেশ ছাড়া
তো কিছুই করতে পারবে না! সেগুলোও তো শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে।
সেই ক্রান্তিকালে বুড়িটার কথা খুব মনে পড়ে।
যখন শরীর বিদ্রোহ করে, রাতের পর রাত ঘুম আসেনা,
প্রৌঢ়া স্ত্রীর মারণব্যাধির চিকিৎসায় নার্সিংহোম-হসপিটালে একা একা
দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, পরিশ্রম আর টেনশনে বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করে,
তখন আধো ঘুমের ঘোরে শৈশবের বিছানায় খুঁজে ফিরি জবাকুসুম,
তুহিনা স্নো, ল্যাভেন্ডারের গন্ধের সাথে মশলামাখা ভিজে শাড়ির গন্ধ।
যখন ভোরেরবেলা পাখির ডাকে বৃদ্ধ চোখদুটো খুলি,
তখন অজান্তেই আঙুল দিয়ে
চোখের দুকোল মুছি।
আমাকে কেউ যদি প্রশ্ন করে কোন নারী তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছে,
আমি আমার মায়ের কথা বলবো।