১৮+গল্পHot Stories (প্রাপ্তবয়স্কদের বাংলা রোমান্টিক গল্প)গল্পছোট গল্পপ্রথম পাতাপ্রথম শারীরিক সম্পর্কের গল্পবিয়ের পরের প্রেমের গল্পশারীরিক প্রেমের গল্পসর্বশেষ

রক্তরস [ষষ্ঠ পর্ব]

আশিক মাহমুদ রিয়াদ

পূর্ণিমা রাত! সেরাতে গৃহস্থ বাড়ির উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছে এক বৃদ্ধা; রাত গভীর, জীবনের শেষ সময়ে মানুষের ঘুম উড়ে যায়। বৃদ্ধা দরজা খুলে দরজার চৌকাঠে বসে বিলাপ বকছে। মানুষজন! তার সম্পর্কে বলে, তার শরীরের জ্বীনের আছড় আছে। কিন্তু বৃদ্ধা তা মানতে না রাজ, সারারাত সে নির্ঘুম কাটিয়ে বিলাপ বকে সময় কাটায়। সকাল সকাল পূত্রবধুকে ঘুম থেকে উঠিয়ে তার সাথে ঝগড়ায় মাতে। পূত্রবধু তাকে অভিশাপ দেয়, তুই তাড়াতাড়ি মর।




সেই চাঁদনীর রাতে উঠোন থেকে দৌড় দেয় একটি ছায়া। বৃদ্ধা হঠাৎ দেখে কিছুটা হক চকিয়ে যায়, এলো নাকি তার শেষ সময়। সেই ছায়াটি মিলিয়ে যায়, পূবের হাশেমের ঘরে। হাশেম দীর্ঘদিন ধরে বিদেশ। হাশেমের বউ দারুণ সুন্দর। কথার সাথে সাথে হাসিতে ঢলে পড়ার অভ্যাস আছে, হাটের প্রায় সবদোকানের দোকানীরা তাকে চেনে। বিশেষ করে কসমেটিক। প্রতি রাতে হাশেমের ঘরে মধু খেতে আসে, এক ভ্রমর। হাশেম বিলেতে থাকে, তার বউ থাকে বাড়িতে। সে বাড়িতে শুধু হাশেমের বউ এবং তার শাশুরি, তার শাশুড়ি দীর্ঘদিনের জন্য বেড়াতে গেছে তার বোনের বাড়িতে। সেই সুযোগে বাজারের কসমেটিক দোকানদার পলাশ হাশেমের বউয়ের সাথে রাত্রিযাপন করে। মানুষ বলে,’চোরের দশদিন গেরস্থের একদিন’ কিন্তু গেরস্থই তাকে দেয় মধু খাওয়ার সুযোগ। এসব চোখে পড়ে সেই বিলাপ বকা বৃদ্ধার। সে সকালে তার ছেলেকে জানায়, তার ছেলে মতিউর হাশেমের চাচাতো ভাই। বাড়ির ভেতরে এমন অনাসৃষ্টি তো মানা যায় না। মতিউত রাতে খোটপেতে থাকে, সেই আবছা অবয়োব মাঝরাতের শুনশান নিরাবতায় ঢোকে বাড়ির ভেতরে। খপ করে চারদিক থেকে বাড়ির পুরুষরা বের হয়ে সে অবয়বকে ধরে, সঙ্গে সঙ্গে মহিলারা দরজা ভেঙে চুল ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে আসে হাশেমের বউ মাসুদাকে। রাতের আঁধারে নরনারীর নিশ্বাসে ভারী হওয়ার কথা ছিলো এ রাত। কিন্তু রাতের বৈচিত্র বড় বিস্ময়কর! তাদের দু’জনকে একসাথে বাধা হয়। সকাল সকাল খবর পাঠানো হয় এলাকার চেয়ারম্যান আজগরের কাছে। আজগর আসেন! একটু বেলা করেই। ততক্ষণে মাসুদাকে বেত্রাঘাত করা হয়েছে, কসমেটিক দোকানদার সালামকে মাথা ন্যাড়া করা হয়েছে, বস্ত্র উলঙ্গ করা হয়েছে। মাসুদাকেও ন্যাড়া করা হয়েছে।


বেলাগড়াতেই গ্রামের সব মানুষ এসে মের্দা বাড়িতে হাজির। সবাই এক নজরে দেখছে এ দৃশ্য। চেয়ারম্যান আসাতেই, ভীড়ের ভেতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,”চেয়ারম্যানতো নিজেই বেশ্যার ভাত খায়, সে আবার কি বিচার করবো?” এ কথা শুনে ভীষণ লজ্জিত হয় চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের চামচা বলে ওঠে,”কোন বেশ্যার ছেলে এ কথা বললি রে? সামনে আয় দেখি? বিচি কেটে হাতে ধরিয়ে দেব নেমকহারামের দল”

চেয়ারম্যান বিচারকার্য সম্পাদন করলেন! কর্তন করা হোক শানুর লিঙ্গ। সেই সাথে বন্ধ্যা করে দেওয়া হোক, মাসুদাকে। কিন্তু এ বিচার শেষমেষ থামলো, ভিন্নতায়। মাসুদাকে পাঠানো হবে নদীবানুর ঘরে, আজ থেকে সে বেশ্যা। শুধুই একজন বেশ্যা নয়, একজন চরিত্রহীনা নারী।

*
বৈশাখ মাস শুরু হয়েছে। বৈশাখের আগামণ ঘটেছে ঝড় দিয়ে। ঝড় শেষে এখন৷ মু্ষল ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। আফরোজা বেগম জানলার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছেন।তার শৈশবের কথা মনে পড়ছে। শৈশবে এমন ঝড়ের দিনে কত আম কুড়িয়েছেন।একবার আম কুড়াতে গিয়ে সে কি মহা বিপদের সম্মুক্ষিণ হলেন। আম কুড়াতে গিয়ে সাপের গায়ে পাড়া দিয়ে বসলেন। সাপ ছোবল দিলেও তিনি ফট করে পা সরিয়ে নিলেন। তারপর চিৎকার দিয়ে দিলেন এক দৌড়৷ তারপর প্রায় বছর খানেক সাপ দেখা শুরু করলেন। গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখতেন মশারির ওপর একটি সাপ কুন্ডুলি পাকিয়ে বসে আছে। চিৎকার দিতেন। তার দাদী এবং পরিবারের সবাই রা বলাবলি শুরু করলেন ওরে খারাপ জিনিসে ধরেছে। ওঝা দেখান লাগবো। ওঝা ডাকা হলো ওঝা দেখলেন কিন্তু সাপ আতংক গেলো না। আফরোজা বেগমের বাবা ছিলেন খুবই রাগী মানুষ। মেয়ের সাপ নিয়ে এমন কান্ড কারখানা দেখে তার রাগ চটে গেলো।
সে বেঁদের দলকে খবর দিলেন। বিষ দাত ভাঙা একটি সাপ হাতে নিয়ে নিজেই ছুঁড়ে মারলেন মেয়ের গায়ের দিকে। আফরোজা চিৎকার দিলো। চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো।


তারপর গা কাঁপিয়ে উঠলো৷ জ্বর থেকে সেরে উঠে ভুলে গেলেন সাপের কথা। আফরোজা বেগমের বাবা মারা গেলেন সাপের কামড়েই। বিষধর চন্দ্রবোড়া সাপের কামড়ে। সেদিন থেকে আবারো তার সাপের আতংক শুরু হলো। এই আতংক শেষ করলেন তার স্বামী আজগর সাহেব। বিয়ের পর তিনি সাপ নিয়ে নানান ধরনের সাহস দিতে লাগলেন। তার স্বামীর নামের সাথে একটি সাপের নামের মিল আছে , মাথায় যখন রাগ চটে যায় তখন তিনি আজগর সাহেবকে অজাগরের বাচ্চা বলে গালি দেন।

বিকট শব্দ করে বজ্রপাত হচ্ছে৷ বৃষ্টির আরো জোরে নামলো। বৃষ্টিতে চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। শুধু বৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। একে বলে কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি। ইংরেজিতে ক্যাটস এন্ড ডগস।
এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে হাজির হলেন আজগর সাহেব। বড় ভুড়ি নিয়ে শেষ কবে দৌড়েছেন সেটা মনে করতে পারলেন৷ আফরোজা বেগম জানলা দিয়ে দেখছেন,ঠিক যেন একটা অজাগর সাপ এঁকেবেকে আসছে।
হঠাৎ বাজ পড়লো বিকট শব্দ করে।আজগর সাহেব আছাড় খেলেন ধড়াস করে। কোমড়ে ব্যথা পেয়েছেন। ছাতা বাতাসে উড়িয়ে নিলো। কোমড়ে ব্যাথা পাওয়ায় তিনি উঠোন থেকে উঠতে পারলেন না। তিনি কাতর গলায় ডাকছেন,মনির! মনির! ঐ মনির রা? বৃষ্টির ঝুম শব্দে এই গলার স্বর বেশি দূর গেলো না।
আফরোজা বেগম, মনে মনে বলছেন এখন একটা বাজ পড়ুক। শেষ হয়ে যাক চিরতরে। এই উঠোনেই সলিল সমাধি হোক। হঠাৎ বিকট শব্দে বাজ পড়লো বাড়ির পাশের তালগাছে। তালগাছে আগুন লেগেছে,এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আগুন জ্বলছে। ধোয়ায় ভরে গিয়েছে সব।




মনিরকে দেখা গেলো, সে মালকোঁচা দিয়ে উঠোনের দিকে দৌড় দিলো, এবং ধড়াম করে আছাড় খেলো। আজগর সাহেব হাত নেড়ে নেড়ে মনিরকে ধমক দিচ্ছে। আচমকা আছাড় খাওয়ায় মনিরের পিঠ ধরে গিয়েছে।
সে অ ব্যথায় কাতরাচ্ছে,ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে উঠে চেয়ারম্যানের কাছে গিয়ে আবারো আছাড় খেলো। এই আছাড় খেলো আজগর সাহেবের গায়ের উপর। আজগর সাহেব হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মনিরকে সপাটে কিল মেরে গেলেন।
এই দৃশ্য দেখে আগরোজা বেগমের হাসি পেলো না।তার মুখ থেকে অনেক আগেই হাসি উঠে গিয়েছে৷
এই সংসারে তার আর থাকতে ভালো লাগছে। মরে গেলেও পারেন, কিন্তু আত্মহত্যা মহা পাপ।



*
আছরের নামাজ শেষ করে মাওলানা ইদ্রিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নদী পাশে। তার সাথে আছে আজিজ মাষ্টার। আজিজ মাষ্টার বলল,’মাওলানা সাহেব! আপনার লইগা পাত্রী খোজা শুরু করে দিয়েছি।’
মাওলানা ইদ্রিস বলে, ‘মাশাল্লাহ! ‘
তাদের দুজনের কথার মধ্যে হাজির হয় মোসলেম উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘মাওলানা সাহেব,আপনারে একটা কথা কই?’
মাওলানা ইদ্রিস বিনীত ভঙ্গিতে বলে,’আপনি আমার থেকে বয়স্ক মানুষ। আমাকে কথা বলতে অনুমতি নিতে হবে কেন? আপনি বলুন।
আপনি এই মসজিদে আইছেন প্রায় ছ’মাস।আপনারে দাওয়াত দিয়া বাড়িতে খাওয়ানোর খুব ইচ্ছা আমার।আগামী শুক্রবার আমার স্ত্রীর পঞ্চম মৃত্যূবার্ষিকী।ঐদিন মসজিদে মিলাদ শরিফের আয়োজন করার ইচ্ছা আছে। মিলাদ শেষ করে দুপুরে এবং রাতে আমগো বাড়িতে আপনি দুইটা খানা খাইবেন। মাষ্টার সাহেব, আপনিও খাইবেন।দুজনেই সম্মতি জানালেন।

সকাল থেকেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বকুল। আজ তার মায়ের পঞ্চম মৃত্যূবার্ষিকী বকুলের যখন চৌদ্দ বছর বয়স তখন মারা যায় তার মা৷ বকুল কাঁদছে! বকুলকে শান্তনা দিচ্ছে জামিলা। জামিলা বকুলের চোখের জল মুছতে মুছতে বলে,’এইরকম কান্নাকাটি করলে হইবো? সবারই তো একদিন চইলা যাইতে হইবো ঐ পাড়ে। কাঁইন্দো না,আও রান্নাঘরে আও। কত কাম করতে পইড়া আছে। তুমি বাবুরে নিয়া একটু বসো। আমি রান্না করি।

বকুল তার ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে বসে আছে। ছোট্ট শিশুটি হাত পা নাড়ছে। কখনো হাঁসছে আবার কেঁদে উঠছে। বকুল বলল,’আইজক্যা কি ঘরে মিলাদ হইবো নাকি? ‘ জামিলা বেগম বলল,’হ! কেন তুমি জানো না? ও তোমারে তো জানানোই হয় নাই। আইজক্যা মিলাদ হইবো। মিলাদে তোমার আব্বা দাওয়াত দিছে মসজিদের ইমামরে। তোমার বাপের কাছে শুনছি ইমাম সাহেব নাকি খুবই ভালো মানুষ। খুবই পরহেজগার মানুষ।




দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে রাতের খানা খেতে এসেছেন মাওলানা ইদ্রিস। সেই সাথে এসেছেন আজিজ মাষ্টারও৷ তাদের সামনে রাখা হয়েছে কোরাল মাছ,রুই মাছ,গরুর মাংস। এই গ্রামে হাঁটে সপ্তাহে গরু জবেহ করা হয়। তাও ভাগে পাওয়া মুশকিল। সকাল সকাল গিয়ে গরুর ভাগ বুকিং দিয়ে আসতে হয়। মোসলেম উদ্দিন বললেন,’মাওলানা সাহেব কোন ভালো খাবারের আগে করোলা খেতে হয় কেন জানেন? ‘ মাওলানা ইদ্রিস মাথা ঝাকায়, জ্বী না! মোসলেম উদ্দিন ঠাট্টা করে বলে,’মাওলানা হলেন আর এটাই জানলেন না?’ মাওলানা ইদ্রিস মুখের ভাত গিলে জবাব দেয়,’জ্বী,মাওলানা হয়েছি আল্লহর রাস্তায় কাজ করার জন্য। এইসব জানার চেষ্টা করি নাই কখনো। ‘ মোসলেম উদ্দিন বললেন,’রঙ্গতামাশা করছিলাম মাওলানা সাহেব। আপনি কিছু মনে নিয়েন না। খাওয়ার আগে করোলা খাইতে হয় কারন করোলায় খাইতে তিতা লাগে। ভালো খাওয়ার খাওয়ার আগে করোলা মুখের স্বাদ বাড়াইয়া দেয় দেয়।রুচি আনে মুখে। ‘
মাওলানা মাথা নেড়ে বলে, ‘জ্বী!এইবার বুঝতে পেরেছি ‘
খেতে খেতে মাওলানার চোখ যায় জানালার পর্দার কোনায়,একজন উঁকি দিয়ে আছে সেখানে।তার চোখ দেখা যাচ্ছে। কী অপূর্ব! মাওলানা ইদ্রিস বিষম খায়।



সেদিন বিকালের কথা, মাওলানা ইদ্রিস আতংকিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার সামনে বোরকা পড়া এক তরুনী দাঁড়িয়ে আছে ।যার আখি যুগল অপূর্ব সুন্দর ।মাওলানা ইদ্রিস ভাবলেন এ কি কোন মানুষ নাকি জ্বীন পরি। তিনি চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। পরনারীর দিকে তাকিয়ে থাকা জায়েজ নাই।

মেয়েটি খিল খিল করে হাঁসতে রইলো। মাওলানা ইদ্রিসের বুকধড়ফড় শুরু হলো। তিনি এখানেই বসবেন কি না ভাবছেন। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
পেরেশানি লাগছে। তিনি মনের অজান্তে আবারো তাকালেন মেয়েটির দিকে। তাকাতেই মেয়েটর চোখে চোখ পড়ে গেলো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে চোখ ঘুরিয়ে নিলেন। মেয়েটি খিল খিল করে হাঁসে।




মাওলান ইদ্রিস পানি পড়া খাচ্ছেন৷ পানি তিনিই পড়েছেন। তিনবার চোখে মুখে ছিটিয়ে নিয়েছেন। তারপর এক ঢোকে পানি খেয়েছেন। তার শরীর ভালো লাগছে না,মুখ স্বাদ পাচ্ছেন না। তেতো তেতো স্বাদ। নাকে গন্ধ আসছে না।
মাওলানা ইদ্রিস জ্বরে আক্রান্ত হলেন। কোন মতে এশার নামাজ পড়ে ঘুমালেন। ফজরে উঠতে পারলেন না। ফজরের আজান পড়লেন মোসলেম উদ্দিন। মাওলানাকে খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখলেন তার গায়ে জ্বর অনেক। গা পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এর মধ্যে আজিজ মাষ্টার এসে উপস্থিত হলেন।
মাওলানা ইদ্রিসকে নিয়ে আসা হয়েছে,হরিপদ মুখার্জির দাতব্য চিকিৎসালয়ে।হরিপদ মুখার্জি ভালো করে দেখলেন।

আজিজ মাষ্টার বললেন,’দেখেছেন মাওলানা সাহেব? ঘরে একজন স্ত্রী থাকলে আপনার সেবা যত্ন করতে পারতো। বিয়ের বয়স তো পার হয়ে যাচ্ছে। আপনাকে খুব শিগগিরই বিয়ে দিতে হবে৷ এইভাবে আর ক’দিন থাকবেন?

*
মোসলেম উদ্দিন আনমনা হয়ে বসে আছেন৷ তার হাতে চায়ের কাপ, তিনি চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। তিনি তার পূত্রবধুকে ডাক দিলেন৷বললেন,আইজক্যা ফজলুরে একটু কথা শুইনা যাইতে বইলো।
জামিলা বলে,’আচ্ছা আব্বা,বলুমনে৷ ‘
মোসলেম উদ্দিনের সামনে বসে আছে ফজলু। মোসলেম উদ্দিন পান মুখে দিতে দিতে বলল,’তোর ব্যবসা বানিজ্য কেমন যাচ্ছে?’
ফজলু মাথা কাঁত করে বলে,’জ্বী আব্বা, ভালো যাচ্ছে। ‘
মোসলেম উদ্দিন বলে,শোন তোকে একটা কাজের কথা কই।
ফজলু বলে,বলেন আব্বা।
মোসলেম উদ্দিন পান চিবোতে চিবোতে বলে,মার বয়স হয়ে গিয়েছে। আমি এখন তোগো বোঝা হইয়া গেছি৷ আর বেশি দিন বাঁচব না। আমার দিন ক্ষণ ঠিক হইয়া আছে শুধু ভিসা আসলেই চলে যাবো। খাটিয়া দুয়ারের কাছে আসতে বেশি বাকি নেই।
ফজলু তার বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,আব্বা আপনি এরকম কথা বলবেন না তো।




মোসলেম বলে,রাগ করিস না বাপ৷ বুড়া হইছি, কোথা দিয়া কোন কথা বইলা ফেলাই হুস থাকে না৷
শোন,তোর বোন বড় হয়েছে৷ ওকে একটা ঘরে পৌছায়া দেওয়া দরকার৷
ফজলু বলে,এই কথা আমিও আপনারে কমু কইরা ভাবছিলাম। পাত্র দেখতে হবে।
মোসলেম উদ্দিন বলে,পাত্র দেখতে হবে না৷ পাত্র আমার দেখা আছে।
ফজলু বলল,পাত্র কোথায় থাকে? নাম কি?
মোসলেম উদ্দিন বলে,তুমি চেনো তাকে। তার নাম মাওলানা ইদ্রিস।
ফজলু বলে,কিন্তু উনি তো শুধু মসজিদে ইমামতি করেন৷ থাকেনও মসজিদে।
মোসলেম উদ্দিন বলে,সেটা আমি জানি। তবে আজিজ মাষ্টারের কথা হয়েছে উনি ওনার স্কুলে একটা চাকরির ব্যবস্থা কইরা দেবেন।
শোন বাপ,আমি চাই বাইচ্চা থাকতে মাইয়াডারে সৎ পাত্রের হাতে উঠাইয়া দিতে। এই বয়সে সুন্দরী মাইয়া ঘরে রাখতে নাই। মাওলানা ইদ্রিস অত্যান্ত ভালো মানুষ। ওনার মতো ভালো মানুষ এই দশগ্রামে পাওয়া যাইবো কিনা সন্দেহ৷




*
বকুলের মুখ লাজুক লাজুক আজকাল! সে আনমনা, উদাসীন মুখ করে বসে থাকে। কোথায় কোন ধ্যানে হারিয়ে থাকে। জামিলা বেগম ঠাট্টা করে বলেন,’এর মধ্যেই হারাইয়া যাইতাছো,বিয়া হইলে কি করবা?’ বকুলের ধ্যান ভাঙে সে ভাবির কথায় নড়ে চড়ে বসে। কপালের কোনে অগোছালো চুলগুলোকে কানের পাশে গুজে নেয়৷ তারপর প্রস্তুত ভঙ্গিতে বলে,কি যে কও না ভাবী।
জামিলা বেগম ছেলেকে সুজি মুখে দিতে দিতে বলে,বুঝি বুঝলা। তোমার বয়স তো আমিও পার কইরা আইছি। তোমার ভাইরে যখন প্রথম দেখলাম, বুকের মধ্যে যেন কি একটা নাই হইয়া গেলো।
বকুল খিল খিল করে হাসে।
ভাবী বলে, ‘হাসো ক্যা? দেইখো তোমারও হইবো আনে। ‘
বকুল বলে, আমার কোন দিনও হইবো না। আমার অত প্রেম ভালোবাসা নাই।
ভাবী বলে,তয় জামাই কিন্তু একখান মাশাল্লাহ! তোমার পছন্দ হইছে?
বকুল লজ্জায় লাল হয়ে যায়,সে বলে তোমগো পছন্দই আমার পছন্দ। বকুল উঠে যায়। জামিলা হাসে! আর শিশুটি কেঁদে দেয়।




মাওলানা ইদ্রিস এখন মসজিদে থাকেন না৷ তিনি বাজারে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন। মাসে এক হাজার টাকা ভাড়া। তার ঘরের জন্য খাট, আলনা এবং একটি আলমারি কিনেছেন। এগুলো মাওলানা ইদ্রিস কিনেননি। এগুলো মোসলেম উদ্দিন তাকে কিনে দিয়েছেন। মেয়েকে তিনি এই ঘরে পাঠাবেন, তার চাহিদায় কোন ঘাটতি রাখবেন না। মোসলেম উদ্দিন খুবই খুশি। বিয়ে হবে ছোট পরিসরে। খুব বেশি আয়োজন না করাই ভালো। আত্মীয় স্বজন দু একজন দাওয়াত দিতে হবে। দাওয়াত দিতে হবে বকুলের ছোট খালাকে।
বকুলের ছোট খালা দাওয়াতের আগে এসেই উপস্থিত। তিনি শুধু একা আসেন নি। সাথে নিয়ে এসেছেন তার সাতটা ছেলে মেয়েকে। তাদের সাথে বড় ছেলের বউ জাহানারাও আছেন।
-মোসলেম উদ্দিন ঠাট্টা করে বলেন, তোমরা যে কেন এখনো ফুটবল মাঠ বানাওনি। ফুটবল খেলার দল তো জোগাড়। এবার একটা মাঠ বানাইয়া ফ্যালাও। মাঠের দুই পোস্টের এক পোস্টে তুমি দাড়াবা, আরেকপোস্টে তোমার ঘরের জন। মানে আমার ভায়রা ভাই।
-বকুলের খালা বলে, কি যেন কন দুলাভাই। আমগো কি এহনো হেই বয়স আছে?
-মোসলেম উদ্দিন বলে, বয়স নাই বয়স নাই কইরা তো সাতটা জোটাইয়া ফ্যালাইলা।




-এখন আর হেই ইচ্ছা নাই দুলাভাই।
ছেলে মেয়েগুলো তাদের কথা শুনছে। বকুলের খালা তাদের ধমক দিয়ে বলছ, তোরা খাড়াইয়া খাড়াইয়া কি পিড়িতের কথা হুনতাছোস? যা এইখান দিয়া, ঘরের ভিতরে যাইয়া বস।
বুঝলেন দুলাভাই,আমার এতগুলান মাইয়া পোলা একটাও মানুষের মতো মানুষ হয় নাই। সব গুলা বলদ৷ একটাও মাইষ্যের জাত না।
-মোসলেম উদ্দিন বলে, আহা! মাইয়া পোলাগো এইরম কইতে হয় না।
বকুলের খালা বলে, কি করুম ভাইজান!মনে অনেক দূঃখ।
– এসব দূঃখ-টূঃখ বাদ দাও দেহি। মাইয়ার বিয়া খাইতে আইছো,ভালো কইরা খাও৷
-মাইয়া তো আর আমার একার না। তোমাগোও মাইয়া। ঢক কইরা খালি খাইওই না । একটু খেয়াল টেয়াল রাইখো ।
বাড়িতে বিয়ের আমেজ লেগেছে। ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে। মোসলেম উদ্দিনের চোখে মুখে আনন্দ। বকুলের আজ গায়ে হলুদ। তাকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে। মোসলেম উদ্দিন চোখ বুলিয়ে দেখলেন, মেয়েটিও তার মায়ের মতো হয়েছে৷ দেখতেও একেবারে মায়ের মতো। মোসলেম উদ্দিন ক্ষাণিক কল্পনায় হারিয়ে যান।




মোসলেম উদ্দিন যেবার বিয়ে করতে গেলেন । যুদ্ধের কয়েক বছর আগের ঘটনা। সন্ধ্যা নাগাদ বাবা বাজার থেকে এসে মোসলেম উদ্দিনের মাকে বললেন, এই লও মোসলেমের লইগা সুন্দর দেইখা একটা পাঞ্জাবি কিন্যা নিয়া আসছি। আর পাঞ্জাবি, নতুন টুপি একখানা সাদা রুমাল, আতর । কালকে মোসলেমের বিয়া। পাশের গ্রামের তৈয়ব উদ্দিনের মাইয়া। আইজক্যা বিকেলে আমি যাইয়া দেইখা আসছি। মাইয়ার চেহারা পরির লাহান, তোমার পুত্তুরের যে কাইল্যা পিত্তা চেহারা এইতে এই মাইয়ার বাপ আমগো লগে সম্মোন্ধ করতে আসছে এইডাই অনেক ভাইজ্ঞ্যের ব্যপার। মোসলেম উদ্দিনের তখন উড়ন্ত বয়স, গ্রামে-গঞ্জে কাবাডি খেলে বেড়ান, খেলা থেকে ফিরে এসে তিনি শোনেন এই ঘটনা। সেই সন্ধায় বিয়ে হয় তার।

বকুলের মাথায় গাঁদা ফুলের খোপা।
বকুলের খালা ছড়া জপে –
মাইয়া আমার পরির লাহান,
জামাই হইলো জ্বীন।
দেহো দেহো চাইয়া দেহো
এগো কত মিল।




বকুল লজ্জা পাচ্ছে৷ জামিলা বকুলের কানে কানে বলছে, তোমারে দেইখা আইজক্যা হিংসায় জ্বইলা যাইতাছি।
বকুল ভুরু কুঁচকে বলে,কেন?
তোমারে পরির লাহান সুন্দর লাগতাছে।আমার ইচ্ছা করতাছে এখন বউ সাইজ্জা তোমার লগে গায়ে হলুদ করি।
বকুল ভাবীর, হাত ধরে ভাইজানরে ডাক দেই? তাইলে।
গায়ে হলুদ শেষে পানি ছোড়াছুড়ি করা হয়। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আলতা আর হাজার পাওয়ার রঙ মাখামাখি করে। জরি মেখে দেয় এ ওর গালে। মোসলেম উদ্দিন চেয়ারে বসে আনন্দ উপভোগ করেন।
বকুলের ছোটখালা দৌড়ে আসে মোসলেমের দিকে।গায়ের রঙ মেখে দেয়। ভাইজান আসেন আনন্দ করেন। মাইয়ার গায়ে হলুদ আর আপনে কিনা এখনে বইসা আছেন। আহেন আহেন, আপার গায়ে হলুদের দিন যেমন মজা করছিলাম তেমন মজা করুম। সবাই আনন্দে মেতে ওঠে।




*
মাওলানা ইদ্রিসের গায়ে হলুদ হচ্ছে তার মুখ লাজুক লাজুক। তার গায়ে হলুদ দিচ্ছে সব পুরুষেরা।
আজিজ মাষ্টার ইদ্রিসের মাথায় পানি ঢালছে। বাজারের মুদি দোকান্দার গায়ে হলুদ মেখে দিচ্ছে।মাওলানা ইদ্রিসের কাতুকুতু লাগছে সে হাঁসছে, নড়াচড়া করছে। মুদি দোকানদার শফিক বলছে,এত তিড়িংবিড়িং কইরেন না তো মিয়া। আপনার গায়ে হাতই তো দেয়া যায় না। মাওলানার মুখে সাবানের ফেনা। সে চোখ মেলার চেষ্টা করতে করতে বলছে,সুরসুরি লাগছে ভাইজান। হে হে হে হ হে।
শফিক বলছে,আপনিতো মাইয়া মানুষ না। আর আপনার গায়ে তো কোন মাইয়া মানুষ হাত দেয় নাই। তাও সুরসুরি ক্যান লাগতাছে?




পুরুষ মাইনষের এত সুরসুরি থাকা ভালো না।
এর মধ্যে হাজির হলো দাতব্য চিকিৎসক হরিপদ বাবু। তিনি নাচতে নাচতে বললেন, মাখো ভালো কইরা হলুদ মাখো। আইজক্যাই তো সময় মাওলানারে হলুদ মাইখা ভরাইয়া দাও।’
মাওলানা বললেন,নানা হরিপদ বাবু বেশি অপচয় করা ঠিক না।
হরিপদ বাবু বললেন,রাখেন আপনার অপচয়। বিয়া কি বার বার করবেন নাকি? বিয়াব করছেনই তো এই একবার৷
হলুদের গোসল শেষে মাওলানা নতুন লুঙ্গি পড়েছেন৷ এর মধ্যে হাজির হলো কন্যার বাড়ির ছেলে মেয়েরা। তারা বাটিতে করে হলুদ নিয়ে এসেছে। মাওলানাকে আবারো হলুদ মাখানো হলো। যে কোন উৎসবে এই গ্রামের মানুষ সম্প্রীতি বজায় রাখে, তারা কখনো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না। তারা তাদের উৎসবকে একই সাথে পালন করে।



বকুলের বিয়ে হলো মাওলানা ইদ্রিসের সাথে। বিকেলের দিকে বকুলকে ভ্যানে করে নিয়ে এলেন তার ঘরে। সে রাতেই হলো বকুলের সাথে তার বাসর। বকুল ফুলের ঘ্রান আমার মোটেও ভালো লাগে না।বেশি ঘ্রান নিলে মাথা ধরে। দারুণ অস্বস্তি লাগে। মাওলানা ইদ্রিস বলল,আমার কাছে কিন্তু বকুল ফুলের ঘ্রান খুবই ভালো লাগে। আল্লাহ পাকের কি অপূর্ব সৃষ্টি৷




নববধুর ঘোমটা তোলে ইদ্রিস,

-কি অপূর্ব তার চেহারা। বকুল মিটিমিটি হাসে। হাসতে হাসতে লজ্জায় লাল হয়ে যায়
-মাথা নিচু করে বলে, কি দেখেন?
-পরী দেখী
-এত দেইখেন না
-কেন?
-আমার শরম লাগে না বুঝি।
ইদ্রিস এবার নিজেও একটু লজ্জা পায়। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। তারপর বলে,
তোমার কি আমারে মনে ধরছে?
-না!
-আচ্ছা! আমি এমনিতে মানুষ অতিব সরল।
-বকুল হাসে! সেই হাসির রোল পড়ে যায় বাসরঘরে। এরপর কিছুক্ষণ ধরে বয়ে যায় নিস্তব্ধ নিরাবতা। বকুল হাই তোলে।
-রাইত বেশি হইছে, তুমি কি শুয়ে পড়বা বকুল?
-বকুল মাথা নিচু করে বলে! আপনে কি শুইবেন?
-না! তুমি শুলে আমিও শোব।
এবার একটু গলায় রাগ এনে বকুল বলে, তাহলে আপনি শুইয়া পড়েন। আমার এখনই শোয়ার কোন মতলব নাই। একটু গুরুগম্ভীর্য আসে ইদ্রিসের মধ্যে। একটু বিব্রতও হয় বটে। এরপর বকুল ফিক করে হাসে! বাতি নিভাইভেন না? ইদ্রিস বাতি নিভায় না। কিছুক্ষণ আলাপ করে তার জীবন নিয়ে, কিভাবে সে মা-বাবা ছাড়া একা একা মানুষ হয়েছেন। এতিমখানায় বড় হয়েছেন! বকুলকে সে ধর্মীয় অনেক বিধিনিষেধ সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। বকুল সেসব মনোযোগ দিয়ে শোনে।


মাঝেমধ্যে মাওলানা হু হু করে কাঁদে এতে বকুল বিব্রত হয় না।ই দ্রিসের মায়া মায়া মুখখানা দেখতে তার বেশ ভালো লাগে। পুরুষ মানুষ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে পারে? না বকুল এমন কাউকে জন্মের পর থেকে দেখেনি। কেমন ছেলে মানুষের মতো কাঁদে বেচারা। মাঝেমধ্যে মাওলানা ইদ্রিসের কান্না দেখে বকুলের দারুণ হাসি পায়।
মাওলানার দিকে বাড়িয়ে দেয় শাড়ির আঁচল। মাওলানা ইদ্রিস যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন তার নিষ্পাপ মুখ টা দেখে বকুল লজ্জা পায়। ফজরের নামাজের আগে মাওলানা ইদ্রিসের ঘুম ভাঙলে সে তাঁকিয়ে দেখে বকুলকে। কেমন মিষ্টি চেহারা৷ মাওলানা ইদ্রিস একধরেনের পাপ বোধ করে। আবার তার মনে হয় তিনি তার স্ত্রীকে দেখছেন। বকুলের গায়ে হাত রাখেন। বকুল হাতটাকে মাথার নিচে দেয়। মাওলানা ইদ্রিসের বন্ধ নাকে বকুল ফুলের ঘ্রান আসে। আজ বকুলের বাসর!

এই লেখাটি শেয়ার করুন
ছাইলিপির ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
error: কপি করা থেকে বিরত থাকুন ! বিশেষ প্রয়োজনে ইমেইল করুন [email protected]