একটি জাতি ভাষা সংস্কৃতি ঐতিহ্য রক্ষা করার জন্য যেভাবে প্রাণপণ লড়াই করেছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল,বলতে গেলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই ,একটা জাতির মুক্তির জন্য সেদিন যেভাবে লড়াই করেছিল তা কোনোভাবেই মাপা যাবে না, কারণ সেটা ছিল এক অন্তহীন লড়াই, দীর্ঘ যাত্রার পর,দীর্ঘ নয় মাস লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে, লাখ লাখ স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বাধীনতার ফসল ঘরে তুলেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষেরা ।আজ দীর্ঘ ৫০ বছর পর সেইসব বীর শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের রক্তাক্ত সংগ্রামের রুপরেখা আঁকার চেষ্টা করছি।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বর্ষ দ্বিখণ্ডিত হল, ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের জন্ম হলো। ভারত বিভাগের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গপ্রদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হলো আর মুসলিম অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত হলো। পূর্ববঙ্গের লোকজন সেদিন জিন্নাকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করে আনন্দে মেতে উঠেছিল, কিন্তু এই আনন্দের রেশ বেশি দিন থাকেনি ।স্বাধীনতা লাভের ৩-৪ বছরের মধ্যে শুরু হলো বঞ্চনার ইতিহাস ।পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক বঞ্চনার শিকার হতে থাকে ।পাকিস্তানের শাসকেরা পূর্ববঙ্গের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ করতে শুরু করে । পূর্ববঙ্গ তীব্র অর্থনৈতিক বঞ্চনার শিকার হতে থাকে, সামগ্রিক উন্নয়নে পূর্ববঙ্গ পিছিয়ে পড়তে থাকে, তাছাড়া সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পশ্চিম পাকিস্তানের কুক্ষিগত হতে থাকে।
একটা জাতির সংস্কৃতি বেঁচে থাকে ভাষার উপর নির্ভর করে। পূর্ববঙ্গের প্রায় ৯৮শতাংশ মানুষ ছিল বাংলা ভাষাভাষী।পাক সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে পূর্ববঙ্গের বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর জোর করে তা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে এবং বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার চক্রান্তে নেমে পড়ে,পাক সরকারের এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে পূর্ববঙ্গের মানুষজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে ,বাংলা ভাষা রক্ষার উদ্দেশ্যে তীব্র আন্দোলনের পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়।
ইতিমধ্যে নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে পূর্ববঙ্গে উর্দু ভাষা প্রসারে আরো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠেন। নাজিমউদ্দিনের এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের বাংলা ভাষাভাষী মানুষজন বাংলাভাষাকে বাঁচাতে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়, ছাত্র আন্দোলনে রাজধানী ঢাকা উত্তাল হয়ে ওঠে, তারা ১৪৪ ধারা ভেঙে একুশে ফেব্রুয়ারি মিছিল নিয়ে এগিয়ে চলে। ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়, পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে, পুলিশের গুলিতে মোঃ সালাউদ্দিন, আব্দুল জব্বার, আব্দুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমেদের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের মৃত্যুতে বাঙালি জাতি তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ছাত্র আন্দোলনের গতি তীব্রতর হতে থাকে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু কবিতা, সাহিত্য, গান রচিত হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে লেখা আব্দুল গফফার রচিত -“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি?”গানটি পূর্ববঙ্গে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে ।একুশে ফেব্রুয়ারির এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যে সমস্ত গান ,সাহিত্য ,কবিতা রচিত হয়েছিল তা স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরো গতিশীল করে তুলেছিল সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বলতে গেলে ১৯৭১ স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করেছিল এই ভাষা আন্দোলন।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে ।পাক সরকার তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে,এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ চালিয়ে যেতে থাকে ।স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবর রহমান আন্দোলন শুরু করে ,সরকার মুজিবুর রহমান সহ লীগের প্রথম সারির নেতাদের গ্রেপ্তার করে, শেষে পর্যন্ত গণ আন্দোলেনের চাপে সরকার ১৯৬৯ সালে মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ।১৯৭0 সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৬২ টি আসনের মধ্যে ১৬০ টি আসনে জয়লাভ করে, ফলে পূর্ববঙ্গে স্বায়ত্তশাসনের সম্ভাবনা আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, কিন্তু রাষ্ট্রপতি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেয় ফলে পূর্ববঙ্গে মানুষজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।
এহেন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের মার্চে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে পূর্ববঙ্গে গণ আন্দোলন শুরু হয়। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১, ৭ ই মার্চ বাংলাদেশের রেসকোর্স ময়দানের এক জনসভায় এক আগুনঝরা বক্তৃতা দেন। তিনি সেদিন জনতার উদ্দেশ্যে বলেন,-” বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু সময়ের অপেক্ষা ,আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ো, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো,তোমাদের হাতে যা আছে তাই নিয়ে সংগ্রাম গড়ে তোলো,এ লড়াই আমাদের শেষ লড়াই ,এ লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে।” মুজিবরের এই জ্বালাময়ী বক্তৃতা বাংলাদেশ গণ আন্দোলনকে আরো তীব্রতর করে তোলে। ১৯৭১, ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের জনগণ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এক মরণপণ লড়াই শুরু করে ।পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিশংস ভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা শান্তিপূর্ণ জমায়েত ,গ্রাম ,লোকালয় সর্বত্র গণহত্যা শুরু করে দেয়,কিছু মৌলবাদী শক্তি ও পাকবাহিনীকে সমর্থন করতে থাকে ।প্রায় দীর্ঘ নয় মাস ধরে পাক বাহিনী নির্বিচারে হত্যায় মেতে ওঠে, প্রায় ত্রিশ লক্ষ নরনারী ধ্বংসলীলার শিকার হয় ,বলা যেতে পারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এরকম নির্মম হত্যালীলা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ।পাক বাহিনীর গণহত্যা থেকে বাঁচতে প্রায় এক কোটি নর-নারী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় ।এদিকে পাক সরকার আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে, এরূপ উপস্থিতিতে পূর্ববঙ্গের কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করে, শেখ মুজিবুর রহমান এই সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ।এই সরকার ভারতের মাটি থেকে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে থাকে ।এরূপ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে ,তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ নির্যাতিত ,নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ান, অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ,বাংলাদেশে মুক্তি বাহিনী এবং ভারতীয় বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের পরিপেক্ষিতে পাকবাহিনী পিছু হটতে থাকে এবং অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়ে ।তখন ভারতীয় বিমানবাহিনী আকাশপথে পাক সেনাদের উদ্দেশ্যে শান্তিপূর্ণ আত্মসমর্পণের বার্তা প্রেরণ করে ,অনেকটা টালাবাহানার পর পাক সেনা বাহিনীর সেনা প্রধান এ কে নিয়াজী প্রায় ৯৩০০০ হাজার সৈন্যসহ ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ঘটে।
একথা অবশ্যই বলা যেতে পারে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কুড়িয়ে পাওয়া নয়,প্রায় ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণের বিনিময়ে ,তাদের স্বপ্নের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। দীর্ঘদিন একটা জাতি পরাধীনতার গ্লানি, শোষণ ,লুন্ঠন , অপশাসনের পরিপেক্ষিতে স্বাধীনতার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, তাই তারা পরাধীনতার শিকল ছিঁড়ে ফেলার জন্য প্রাণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়, এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পথে পা বাড়ায়, অসংখ্য তাজা প্রাণের বিনিময়ে, সুখস্বপ্নের জলাঞ্জলির বিনিময় এই স্বাধীনতা তারা অর্জন করেছে, বিশ্বের মানচিত্রে একটা স্বাধীন জাতির অস্তিত্বকে তুলে ধরতে পেরেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ শুধু মাত্রএকটা যুদ্ধ নয়, এটি একটি জাতীয় জাগরণ।
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত