পর্ব – ১ :
বাঙালী ……। একমাত্রিক পরিচয়। মানুষ কখনই একমাত্রিক বিশিষ্ট নয়। মানুষ সর্বদা নিজেদের বিভিন্ন রূপে দেখতে পায়। যেমন একজন মুসলমান। শুধুমাত্র মুসলমানই নই। এই পরিচয়ে বাঁধা নই। সে বাঙালী – বাংলা ভাষা সাহিত্য ও গান বাজনা বিষয়ে যথেষ্ট গর্বিত। তার একটা রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গী আছে। ধনী – দরিদ্র , উপার্জনের সক্ষমতা – অক্ষমতা , স্বাস্থ্য – অস্বাস্থ্য , শিক্ষিত – অশিক্ষিত , উপকারী – বদমাশ , সামাজিক – অসামাজিক , উদার – সংকীর্ণ মনের ইত্যাদি অনেক বহুমাত্রিক পরিচয় আছে ।
এই বাঙালির প্রানের কথা হয় বাংলায়। মনের ভাষা বাংলা। প্রান জুড়িয়ে , আনান্দের ভাষা। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মানচিত্রের সীমানার বাইরে, দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আছে বাঙালী। সেই সংখ্যার একটি বড় শতাংশ বাঙালী মুসলমান। তা হিন্দু- বাঙালীর সংখ্যার থেকে অনেক বেশী ।
বি আর আম্বেদকারের এই বিশ্লেষণটা ( ইন্ডিয়ান নাশনালিজম প্রবন্ধে ) এখনও খুবই প্রাসঙ্গিক – “ প্রথমত জাতিগত ভাবে হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে কোন তফাত নেই। ইউ-পি মুসলমান ও ইউ-পি হিন্দু , বাঙালী মুসলমান ও বাঙালী হিন্দু , বিহারী মুসলমান ও বিহারী হিন্দু , মাদ্রাজি মুসলমান ও মাদ্রাজি হিন্দু , জাতিগত ভাবে উৎপত্তি একই ।
দ্বিতীয়ত , ভাষাগত ভাবে ঐক্যও এক। হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই বাংলাতে , বাংলা ভাষাতে , গুজরাটে গুজরাটি , মহরাস্ট্রে মারাটি , মাদ্রাজে তামিল ভাষাতে কথা বলে। “ একদা প্রচার করা হয়েছিল , রবীন্দ্রনাথ – বুর্জুয়া কবি। ইহা অহেতুক ও ভিত্তিহীন। ইদানীং উগ্র সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী- মৌলবাদী ভাবনা সংক্রমণ ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়ছে। অতি দ্রুত । এই দৃষ্টিকোণ থেকে আগেও প্রচার ছিল, এখনও করা হয় যে , রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি – তবে তিনি মুসলমানদের জন্য কি করেছেন ? এক শ্রেণীর সংকীর্ণ মুসলমানদের অভিযোগ -তিনি হিন্দু কবি , তিনি মুসলমানদের নিয়ে কিছু লেখেন নি …।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বর্ষ উদযাপন (২০২০) উপলক্ষে একটা প্রচার সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যাচ্ছে যে , রবীন্দ্রনাথ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনের বিরুদ্ধে ছিলেন । এই ধরনের রবীন্দ্র-বিরোধী প্রচারের কৌশল পুরনো । দেশ ভাগের পর পাকিস্তান শাসক বাঙালী ও রবীন্দ্রনাথ কে বিলীন করতে ‘ মার্শাল – ল ‘ প্রয়োগ করে ( ১৯৫৮ ) । তখন আইয়ুব খানের শাসন । রবীন্দ্রসঙ্গীতও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় । এই ধরনের ষড়যন্ত্রকারীদের নেতৃত্বে ছিলেন কিছু বাঙালী মুসলমান – আবুল মনসুর আহমেদ , গোলাম মোস্তফা প্রমুখ । এই প্রসঙ্গে আবুল মনসুর আহমেদের কথা উল্লেখ করতে হয় –
“ রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থান করে দিয়েছেন । তবুও এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয় , কারন এটা বাংলার মুসলমানদের সাহিত্য নয় । অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ প্রেরনা পায়নি । এ সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয় , এর স্পিরিটও মুসলমানীয় নয় , এর ভাষাও মুসলমানের নয় । “ ১ এই বিদ্বেষ মেশানো বিরুদ্ধ প্রচারে রবীন্দ্রনাথ বা রবীন্দ্রসাহিত্য মোটেই ছোট হয় নি , আহত হয় নি । সংকীর্ণ দুর্বল হয় দেশবাসী ও মানুষের বিবেক ।
মুসলমান কে …? এবং কি চায় সে …? যদি মুসলমানীর অর্থ এই হয় যে , তা বিশেষ কতকগুলো অনড় মতবাদ । তবে সে মুসলমানীর জন্য রবীন্দ্রনাথ কিছুই করেন নি । এই মুসলমানীর সমর্থন কোরান ও হযরত মহম্মদ ( দঃ ) এবং মুসলিম বিজ্ঞ জ্ঞানীরা করেন নি । বরং তার প্রতিবাদ করেছেন । যেমন মহা মনিষী সাদী বলেছেন –
“ তারিকত ব –জুজ খেদমতে খালক নিসত
বাতসহিব ও সাজ্জাদ ও দলক নিসত “
সৃষ্টির সেবা ভিন্ন আর কিছু নয় , তসবিহ , জায়নামাজ ও আলখাল্লায় ধর্ম নেই । অথবা যেমন পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে , — “ আল্লাহ সম্বদ্ধে ভুল ধারনার জন্য রোষে পতিত হয় না , পতিত হয় দুষ্কৃতকারীর জন্য “ ( সুরা ১১ , আয়াত ১১৭ ) । ২ পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পর শিক্ষাবিদ ও ভাষাতত্ত্ববিদ মহম্মদ শহীদুল্লাহ বড়ই আশা করেছিলেন যে স্বাধীন রাষ্ট্রে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধি । “ বাংলা , বাঙালী মুসলমানদের মাতৃভাষা , তবে সে ভাষার মধ্য দিয়াই তাহাদের মুসলমানি সম্পূর্ণ প্রকাশ করিতে পারে “ ( প্রবাসী , ১৩৩৩ ) । ৩
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আশা করেছিলেন বাংলা ভাষাতেই মুসলমানি প্রতিভার বিকাশ ঘটবে । তিনি সরাসরি মন্তব্য করেছিলেন , ‘ আল্লার জ্ঞানের বাইরে কোন জ্ঞান নাই । রবীন্দ্রনাথ তার প্রতিধ্বনি করেছেন । রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজনের কবি । এ প্রসঙ্গে তিনি কোরান থেকেও উদ্ধৃতি দেন । ৪
কাজী আবদুল ওদুদের ( সাহিত্যিক , শিক্ষাবিদ ) মতে “ মুসলমানীর অর্থ যদি হয় সত্যপ্রীতি , কাণ্ডজ্ঞান -প্রীতি , মানব-প্রীতি , ন্যায়ের সমর্থন ও অন্যায়ের প্রতিরোধ , তবে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় মুসলমান এ-যুগে আর কেউ জন্মেছেন কিনা এইসব সমালোচকদের গভীর বিচার বিশ্লেষণের বিষয় হওয়া উচিত । “৫ আমারা জানি কিছু মুসলমান , বাংলার উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল । উর্দু লেখা হয় আরবি হরফে । তাই কেউ কেউ বলতে থাকে আল্লার কালামের হরফে লেখা বড় পবিত্র ভাষা উর্দু । আরবি হরফে যদি বাংলা লেখা হয় , তবে তাও কি বড়ই পবিত্র হবে ? এই যুক্তির ভিত্তি নেই । কোরানের ভাষা আরবি । কিন্তু আল্লাহর ভাষা কেবল আরবি নয় । সকল মানুষের ভাষা আল্লাহর তরফ থেকে পৃথিবীতে এসেছে । সেই সময়ে কোন বাঙালী যদি হযরত মহম্মদের ( দঃ ) কাছে যেতেন , তিনি কি বাংলায় কথা বলতে পারতেন ? ভাষা – ভাব প্রকাশের মাধ্যম । উর্দু ভাষা হিন্দি ভাষার নামান্তর । দেবনাগরী হরফে লেখা হয় ।
রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ভাবনা , দৃষ্টিকোণ – দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পড়াশোনা করা এবং জানা-বোঝার প্রেক্ষাপট বিরাট , সীমাহীন । রবীন্দ্র-জীবনীর ছোট-বড় থেকে নানান ঘটনা- উপঘটনা – কোন কিছুই লুকানো নেই । তাঁর প্রবন্ধ , গান , কবিতা ,গল্প , উপন্যাস , চিঠিপত্র , সংবাদপত্রে প্রকাশিত রচনা ও মতামত ইত্যাদি সবকিছুই সর্বজনের সমান অধিকারের বিষয়াদি । অপার বিপুল গবেষণার ক্ষেত্র ।তা আমাদের গর্ব , অহংকার । মাথা উঁচু করে খুব গর্ব করে বলি , রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমাদের জন্ম । তাই তাঁর কাছে আমাদের ঋণের বোঝা , অন্য মনিষীদের থেকে অনেক বেশী । ‘ তাই তো কবি বিষ্ণু দে-র করুন আকুতি , “ আমদের ক্ষীয়মাণ মানসে ছাড়াও , সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো “ ।
১ , ২ – রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান চিন্তা – শামসুল আলম সাঈদ , পৃষ্ঠা – ৫২ ।
৩, ৪ – রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান চিন্তা – শামসুল আলম সাঈদ , পৃষ্ঠা – ৪২ ।
৫ – বাংলার মুসলমানের কথা – কাজী আবদুল ওদুদ , পৃষ্ঠা – ৬৬ ।
- হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক – রবীন্দ্র রচনার সংগ্রহ – নিত্যপ্রিয় ঘোষ ।
- ভারতে হিন্দু – মুসলমানের যুক্ত সাধনা – ক্ষিতিমোহন সেন ।
- তর্কপ্রিয় ভারতীয় – অমর্ত্য সেন ।