পৃথিবীর পূর্ব – গোলার্ধে আমদের ভু- প্রকৃতির অবস্থান । কর্কটক্রান্তি রেখার উপরে । ফলে পুরোপুরি শীতের দেখা পায় না বাঙালী । তবুও এই বাংলার প্রকৃতির অন্যতম ঋতু । শীত পঞ্চম ঋতু । পৌষ মাঘ – মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি । এই ঋতুতে প্রকৃতি ও মানুষের এক ভিন্ন রকমের সম্পর্কের বার্তা । শিশির ভেজা নানান সুখ থেকে স্মৃতিতে । হরেক রকম ।
ছোটবেলা থেকে স্কুলবেলায় শীতের ছোঁয়া । ‘ বড়বেলা ’র সদা ব্যাস্ত জীবনে সেই ছোঁয়ার স্পর্শ বড় টানে । অনেকবার । শীতের কোট-প্যান্ট -টাই ততটা আকর্ষণ করে না , যতটা ইচ্ছে করে গ্রামের বাড়ীর উঠানে শীতের সকালে চাদর মুড়ি দিয়ে নরম রোদ পোহাতে । নামী হোটেলের গরম ব্যাঙ্কূয়েট হলে ততটা আরাম নেই । যতটা আছে দীর্ঘ শীতের রাতে লেপ – কাঁথা মুড়ি দিয়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে ছোটবেলায় । দাদুর কাছে রূপকথার গল্প শুনতে ।
গ্রাম বাংলায় শীত কে উপভোগ করার নানান উপকরণ । অজস্র । তারই একটি অনন্য রূপ — শীতের সকালে কনকনে ঠাণ্ডা । গাছের পাতায় শিশির বিন্দু । সকালের সূর্যের সোনালি আলোয় , শিশির কনা মুক্ত্রোর মতো ঝলমল করে । যা বহু দেশ ঘুরে , বহু ব্যয় করে পাওয়া যায় না ।
শীতের শিশির ভেজা মুগ্ধতার হাতছানি , আমারা সবাই অনুভব করি । সে দিকটা এখন থাক । বরঞ্চ শীতের আমেজে কয়েকটা বিখ্যাত কবিতার লাইনের ভিতরকার ‘ সুখ- অনুভূতি ’ টা ছোঁয়ার চেষ্টা করা যাক ।
বেশী জনের কাছে যে কবিতার লাইনগুলো বড় অনুপ্রেরনার । বিশাল ইনপুট । সেই কবিতার সৃষ্টি তো শীতের রাতের মুগ্ধতায় । তুষার ঝরা শীতের সন্ধ্যায় । বনের প্রান্তরে থেমে । ‘ Stopping by Woods on a Snowy Evening by Robert Frost । মনোরম অরণ্য । অন্ধকার ও গভীর । কিন্তু অনেক প্রতিশ্রুতি রাখার আছে । ঘুমাবার আগে অনেক মাইল যাবার আছে ।
“ The woods are lovely , dark and deep,
But I have promises to keep,
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep. “
ইংরাজি কবিতায় শীতের ছড়াছড়ি । সে তুলনায় বাংলা কবিতায় শীতের ছোঁয়া কম । এমন কি রবীন্দ্র সাহিত্যেও । গ্রাম বাংলা কে গভীর ভাবে দেখেছিলেন তিনি । গল্পগুচ্ছে , ছিন্নপত্রে । কিন্তু শীত দেখেছিলেন পশ্চিমের চোখে । ‘ শীতের প্রবেশ ‘ কবিতায় তিনি বলেছেন , ‘ শীত , যদি তুমি মোরে দাও ডাক / দাঁড়ায়ে দ্বারে – / সেই নিমেষেই যাবো নির্বাক অজানার পারে ‘ কিংবা ‘ পউষ তদের ডাক দিয়েছে , আয় রে ছুটে আয় ।‘ আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রকৃতির শীত চিনতে ভুল করেন নি পল্লী বাংলার কবি জসিমুদ্দিন । তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে শীতে বাংলার ছবি । বাংলার নিজস্ব ঋতু । তাঁর বিখ্যাত ‘ রাখাল ছেলে ‘ কবিতায় –
“ ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির – ঝরা ঘাসে ,
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোগে হাসে ।“
কিংবা
“ চলতে পথে মটর শুটি জড়িয়ে দুখান পা ,
বলছে ডেকে গায়ের রাখাল একটু খেলে যা । “
পশ্চিমের মতো এ দেশে গাছে গাছে তুষার ধরে না । বরফ পড়ে না । বরং বাংলার ভু-প্রকৃতি জুড়ে থাকে — গাঁদা , ডালিয়া , গোলাপ , সর্ষে ফুল । নানান সবুজ শাক সব্জি । তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় । সেই কারনে কবি জসিমুদ্দিনের বাংলা , শীতের বাংলাও ।
বাংলায় শীত কে চেনানোর বাকী কৃতিত্ব কবি জীবনানন্দ দাশের । তাঁর শীত মৃত্যুর সিম্বল । যদিও রূপসী বাংলা মৃত্যুর পার থেকে মহাকাল দর্শন । আশ্চর্যভাবে ‘ রূপসী বাংলা ‘ র সৌন্দর্যও শীতে । সেখানে বৃষ্টি নেই । ‘ পৌষের ভেজা ভোরে ‘ , ‘ নোনাফল ‘ , ‘ পৌষের শেষরাতে নিম পেঁচাটির ‘ কথা । আবার ‘ শীতরাত ‘ কবিতায় তিনি বলেন , ‘ এইসব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে / বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে কিংবা পাতা ‘ । কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় ঋতু কাল – হেমন্ত ও শীত ।
আর মার্কসবাদী কবিদের কাছে শীতের এই সিম্বল কাজ করে নি । শীতের সকাল সন্ধ্যা ও দীর্ঘ রাত , এই বাংলায় গরীব মানুষদের কাছে বাড়তি ঝামেলার । অতি কষ্টের শীত কাল । সে কথা কবিতার লাইনে এসেছে । কবি সুকান্ত সূর্যের কাছে প্রার্থনা করেছেন ।
“ হে সূর্য ! শীতের সূর্য ! হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার
প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি
যেমন প্রতীক্ষা করে থাকে কৃষকের চঞ্চল চোখ
ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলোর জন্য ।
হে সূর্য , তুমি তো জানো ,
আমাদের গরম কাপড়ের কত অভাব !
সারারাত খড়কুটো জ্বালিয়ে ,
এক টুকরো কাপড়ে কান ঢেকে ,
কত কষ্টে আমরা শীত আটকাই ।
সকালের এক টুকরো রোদ্দুর –
এক টুকরো সোনার চেয়েও মনে হয় দামী । “
সাহিত্যে শীত অনেকটাই জরাজীর্ণ । তবে শীতের একটা আনান্দ আছে , ‘ শীতের হাওয়ার লাগল নাচন , আমলকির এই ডালে ডালে …’ । পশ্চিমে যেভাবে শীতকে আঁকা হয় , আমাদের এখানকার শীত ভিন্ন প্রকৃতির । বেশী উত্তাপ নিয়ে , আনান্দ নিয়ে আঁকা সে ছবি । যেমন , কুয়াশা ঢাকা সকাল , শীতের শহর , শীতের সব্জি , শীতের আগুন পোহানো , শীতের পিঠা-পুলি , শীতের খেলা , এবং অবশ্যই শীতের কষ্ট ।