অপুদের বাড়ির পেছনে ইয়া বড় আমগাছ। সেই আমতলায় সবাই যথাসময়ে এসে হাজির হয়েছে। মোটামুটি প্রস্তুতিও শেষ। যাওয়ার আগে খুটিয়ে খুটিয়ে সবকিছু যাচাই করে নিচ্ছে দলনেতা অপু। অপারেশনের আগে একবার পুরো প্ল্যানটা রিভিউ করা অপুদের পুরাতন অভ্যেস। কিন্তু শরীফ এখনো আসেনি বলে চূড়ান্ত মিটিং শুরু করা যাচ্ছে না। শরীফের উপর তাই সবার রাগটা ক্রমেই পুঞ্জিভূত হচ্ছে। ‘শরীফের হয়তো বের হতে সমস্যা হচ্ছে। এই রাতে বেড়াল পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসা চাট্টিখানি কথা না!’- তমালের কথার যুক্তিতে সবাই কিছুটা শান্ত হয়। তাই শরীফের জন্য তাদেরকে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা- তাকে ছাড়া অপারেশনের প্ল্যানও ভেস্তে যাবে।
শরীফ এসে হাঁপাতে থাকে। সবার চোখ শরীফের দিকে স্থির। শরীফের দেরী দেখে রুমেল তার উপর কিছুটা চড়াও হয়। রুমেল জিজ্ঞেস করে
– শরীফ, জিনিসটা আনছোত?
– আনমু না মানে! তর কি মনে হয়?
– দেরী কইরা আবার এত্তো মানে মানে করন লাগবো না। জিনিসটা অপুর কাছে দিয়া দে।
অপু সবার সামনে হাঁটছে। শরীফ, তমাল, রুমেল, নুরু, শাহিন ঠিক তার পেছনে । খুব সর্তকতার সাথে হাঁটছে তারা। অনেকটা শিকারী বাঘের মত। নিঃশব্দে। অপুরা সবাই পাড়াতো বন্ধু। খেলার সাথী। সবাই ক্লাস সিক্স সেভেনে ছাত্র। তারা জোয়ার্দার বাড়ির পুকুরের পাড় ধরে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের গন্তব্য জোয়ার্দার বাড়ি। পুরাতন একটা বাড়ি। চারদিকে জীর্ণ দেয়ালে ঘেরা। এই বাড়িটা দেখলে বুঝা যায় এই তল্লাটে একসময় জোয়ার্দাররাই রাজ করেছে। জোয়ার্দার বাড়ির দক্ষিণের ভিটায় একটা পাকা দোতলা বাড়ি। রসুলপুর গ্রামের জন্য এই পুরাতন জরাজীর্ণ বাড়িকে রাজপ্রাসাদই বলা চলে। কলিমউদ্দিন জোয়ার্দার একাই এই বাড়িতে থাকেন। বিপত্নীক কলিমউদ্দিন জোয়ার্দারের দুই ছেলে সুদূর আমেরিকায় ঘাঁটি গেড়েছে। তাই নিঃসঙ্গ কলিমউদ্দিন জোয়ার্দারকে এত বিশাল বাড়িতে একাই থাকতে হয়। প্রজা হিসেবে তার দেখাশুনা করে সুন্দর আলী ও চাঁন বানু। বয়সের এই পড়ন্ত বিকেলেও কলিমউদ্দিন জোয়ার্দারের হাঁকডাকে থরথর করে কাঁপে রসুলপুর গ্রামের হাট মাঠ ঘাট। এখনো তাকে ছাড়া রসুলপুরে কোনো শালিসী বসেনা। সবাই তাকে বাঘের মত ভয় পায় । অথচ অপু সদলে তার বাড়িতেই কীনা অপারেশন পরিচালনা করতে যাচ্ছে!
শাহিন পকেট থেকে একটা পেন্সিল ব্যাটারির টর্চলাইট বের করে। টাইটের আলো বেশি দূর ছড়ায় না। ফাল্গুনেও কুয়াশা পড়ছে। দেয়ালের পাশেই একটা কাঁঠালগাছ বেয়ে টপটপ করে তারা জোয়ার্দার বাড়িতে ঢুকে। না। একদম ঠিকঠাক। অপারেশনের আগে তারা যেরকম ভেবেছে ঠিক সেরকমই। অপু জোয়ার্দার বাড়ির ভেতরের একটা জামগাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে আছে। সর্তকতার সাথে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। বাকিরা আরেকটু পেছনে লুকিয়ে আছে। অপুর ইশারা পেলেই শুরু করবে অপারেশন। স্পষ্ট অপু দেখছে- জোয়ার্দার সাহেব সিঁড়িতে বসে অযু করছেন। সুন্দর আলী জোয়ার্দারের হাতে পানি ঢালছে। কলিমউদ্দিন জোয়ার্দার নামাজে দাঁড়ালেই অপারেশন শুরু হবে। রান্নাঘরে ব্যস্ত চাঁন বানু। সবকিছু বিজলিবাতির আলোয় ফকফকা দেখছে অপু। অপেক্ষার এই মুহূর্ত যেন এক মহাকালের সমান। অপু ঠান্ডা মাথার ছেলে। বুদ্ধিও আছে অনেক। লেখাপড়ায় খুব নাম না করতে পারলেও অন্য সবকিছুতে রসুলপুরে সে অদ্বিতীয়। চ্যাম্পিয়ন। কলিমউদ্দিন জোয়ার্দার ঘরে ঢুকতেই অপুরা সবাই অপারেশন শুরু করার জন্য একত্রে জড়ো হলো। গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে তমাল ও নুরু। শেয়ালের ডাকটা তমাল ভালোই পারে। গেইটের বাইরে কোনো বিপদ দেখলে তমাল শেয়ালের তিনটা ডাক দিবে। বাকিরা তখন বুঝে যাবে সমূহ বিপদের কথা! এই দুইজনকে বাইরে পাহারা দেয়া ও মালামাল পাস করার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ভিতরে গেইটে কাছে দাঁড়ানো আছে শাহিন। কোনো বিপদ আঁচ করতে পারলেই সে গেইট খুলে দিয়ে চম্পট দিবে।
অপুরা গেরিলা পন্থায় অপারেশন শুরু করলো। অপু নিজেই চাকু দিয়ে একটা একটা করে কাটছে আর শরীফ তার হাতের ব্যাগে একটা একটা করে রাখছে। বাগানে রুমেল বসে আছে। তার চোখ অতন্দ্র পাহারায় ব্যস্ত। অপু আপন মনে কাজ করছে। একটা একটা সে তুলছে। রুমেল টের পায় তার পেছনে একটা ছায়া এসে দাঁড়ালো। নাক দিয়ে তার পিঠ শুঁকছে। রুমেল উঠে দাঁড়িয়ে পেছনে ঘাড় ঘুরাতেই দেখে তার পায়ে কাছে বসা জোয়ার্দার বাড়ির কালু গুণ্ডা। কুচকুচে কালো কুকুর। মারাত্মক হিংস্র সে। তাই সবাই তাকে কালো গুণ্ডা ডাকে। রুমেলকে দাঁড়াতে দেখেই কালু ঘেউঘেউ করে তার উপস্থিতি জানান দেয়। সুন্দর আলীও তার তিন ব্যাটারির টর্চলাইট নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, ‘অই বাগানে কোন শালায় রে?’ অপুরা যে যার মত প্রাণপণে দৌঁড়াচ্ছে। তাদের পেছন পেছন দৌঁড়াচ্ছে কালু গুণ্ডা। কালু গুণ্ডার পেছন পেছন দৌঁড়াচ্ছে সুন্দর আলী। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সুন্দর আলী যখন খেয়াল করলো যে তার সামনে ও পেছনে কাউকে আর দেখা যাচ্ছে না। তখন সে থামলো। অকস্মাৎ কালু গুণ্ডাও থামে।
সবাই আবার অপুদের বাড়ির পেছনে আমতলায় জড়ো হলো। অপু তার ডান হাত দিয়ে বাম হাতের কব্জি ধরে আছে। পুকুর পাড় দিয়ে দৌঁড়ে আসার সময় সে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। খানিকটা ব্যথা পেয়েছে মনে হয়।
– শরীফ, তোর হাতের ব্যাগ কই?
– কালা গুণ্ডারে দেইখ্যা আমি ব্যাগ ফালাইয়া দৌঁড় দিছি। ভিক্ষা চাই না মা, নে তর কুত্তা সামলার মত অবস্থা আমার।
– হায় হায়! করছোতটা কি..
অপুর দিকে বোকার মত তাকিয়ে আছে শরীফ। তার নিজের কাছেই নিজেকে৷ খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করলেই সে ব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় কী থেকে যে কী হয়ে গেল! অপুদের অপারেশন পুরোপুরি ব্যর্থ। এমনটা আর কখনো হয়নি। ঐদিকে স্কুল মাঠে জহিররা অপেক্ষা করছে। জহিরদেরকে কিভাবে মুখ দেখাবে অপু? সবার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। যে যার মত নিজেদের বাড়িতে চলে গেল।
ফজরের নামাজ শেষ হলো কিছুক্ষণ আগে। তখনো পুবের আসমানে রক্তিম সূর্যটা হাসেনি। কিন্তু সুন্দর আলী দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে অপুর দরজায় কড়া নাড়ছে। অপু আধঘুম চোখে দরজা খুলে দেখে সুন্দর আলী তার ডান হাতে একটা মোটা রুল। তাল কাঠের তৈরি রুলটা। প্রায়শই সুন্দর আলী রুলটাতে সরিষার তেল মালিশ করে। তেল মালিশের পর বেশ চকচক করে রুলটা।
– জোয়ার্দার সাবের হুকুম, জলদি স্কুল মাঠে আয়। তগো বিচার অইবো। তর দলে বেকতেরে আমি দাওয়াত দিয়া আইছি। তুই যেহেতু দলের সর্দার। তাই তরে বেকতের পরে দাওয়াতটা দিলাম। তর একটা সম্মান আছে না! হি হি হি। তাড়াতাড়ি মাঠে আয়। নাইলে কিন্তু জোয়ার্দার সাবে রাইগ্যা যাইবোগা। পরে বিরাট ঝামেলা অইয়া যাইবোগা।
জোয়ার্দার সাহেব যেহেতু ডেকেছেন- না গিয়ে আর রক্ষা নেই। তা না হলে কলিমউদ্দিন জোয়ার্দার রসুলপুরে একটা লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে ছাড়বেন। অপুর বাম হাতের কব্জিটা একটু ফুলে গেছে। ব্যথাও আছে। ডানপিটে অপুর আজই প্রথম ভেতর ভেতরে ভয় পাচ্ছে। আজ কি জানি তাদের কপালে আছে! ভাবতে ভাবতে অপু স্কুল মাঠের কোণায় এসে দাঁড়ায়। কলাগাছ দিয়ে শহিদ মিনারটা সুন্দর করে বানিয়েছে জহিররা। লাল নীল হলুদ কাগজ কেটে নিশান বানিয়ে টাঙানো হয়েছে। জহির লম্বা একটা বাঁশে সুতলি টেনে টেনে পতাকা তুলেছে। পতাকার একপ্রস্থের সমান নিচেই পতাকা বাঁধা হয়েছে। অপু স্কুলের অফিসে সামনে যেতেই সুন্দর আলী অপুকে রুম দিয়ে ইশারায় ডাকে। অপু ভয়ে ভয়ে অফিসে ঢুকে। তমাল, শরীফ, নুরু, শাহিন, রুমেল সবাই আছে। অপু হেড মাষ্টার মোহন চন্দ্র দাসের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
– মাস্টার সাহেব, আপনের গুনধর ছাত্ররা কি করেছে জানেন? আমার বাড়িতে তারা চুরি করে! কত্তো বড় সাহস!
– জোয়ার্দার সাব, দয়া করে আপনি উত্তেজিত হবেন না। আমি বিষয়টা দেখছি।
হেড মাষ্টার সাহেব অপুদের দিকে কটমট করে চোখটা একবার তাকিয়ে একটু দম নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘জোয়ার্দার সাহেব যা বলেছেন- ঘটনা কি সত্যি?’
অপুরা কেউ কোনো কথা বলছে না। প্রথাগত সেই সিদ্ধান্তঃ মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ। হেড মাষ্টার সাহেব নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তার চেয়ারের পেছনে একটা স্টিলের আলমারি ওপর থেকে লাল স্কচটেপ পেঁচানো বেত বের করলেন। এই বেতটা স্পেশাল। মোহন মাষ্টার খুব রাগ করলে এই বেতটা কাজে লাগান। বেত হাতে তিনি অপুকে মারতে উদ্যত হতেই জোয়ার্দার সাহেব তাকে থামতে বলেন। এই গুরুতর চুরির বিচার এই বেতে হবে না। আরো বড় শাস্তি তারা পাওনা। জোয়ার্দার সাহেব সুন্দর আলী ডেকে পাঠান। সুন্দর আলী একটা ফুলের তোড়া নিয়ে অফিসে ঢুকল। শরীফের ফেলে যাওয়া ফুলগুলো দিয়ে সারারাত জেগে জোয়ার্দার সাহেব ও সুন্দর আলী এই তোড়াটা বানিয়েছে। এখন জোয়ার্দার সাহেবের গোঁফের নিচে দুষ্টু একটা হাসি খেলা করছে। অপুরা কিছুই বুঝতে পারছে না। জলেশ্বরী নদীর জলের মতই ঘটনা প্রবাহমান স্রোত বড়ই রহস্যময়। জোয়ার্দার সাহেব চেয়ার ছেড়ে অপুর কাছে এসে ধমকের স্বরে বললেন, ‘তোদের বড় শাস্তি কি জানিস? এই ফুলের তোড়া নিয়ে তোরা সামনে হাঁটবি। আর আমরা বুড়োরা তোদের পেছন পেছন হাঁটবো। আর শোন, স্কুলে কিন্তু এবার শহিদ মিনারের কাজ শুরু করবো আমি। তখন তোদেরকে খাটতে হবে। এটাই তোদের জন্য আমার বড় শাস্তি। হেড মাষ্টার সাহেব চলেন- প্রভাতফেরী শুরু করা যাক। তোরা কিন্তু গলা ছেড়ে গাইবি ‘ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…।’
অপুরা হাসছে। হাসছেন মোহন মাষ্টার। দরজায় দাঁড়িয়ে হাসছে সুন্দর আলীও।
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ,
মাধবপুর, হবিগঞ্জ।