“এক্সকিউজ মি? হ্যালো?”
আমি রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে কি যেন একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম কথাটা। অজান্তেই নব্বই ডিগ্রি কোনে ডানদিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিলাম। কিন্তু এক পলক দেখায় অনেক কিছু ঘটে গেল। এক পলক দেখায় কেউ জীবন হারায়, কেউ পাগল হয় আবার কেউ সর্বস্ব খোয়ায়। আমারও বুঝি সে সংকেতই এলো। তাই বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে আবার নব্বই ডিগ্রি কোনে ডানদিকে ঘুরে তাকালাম।
কি অপরুপ দৃশ্য! এমন ভাগ্য ক- জনেরই হয়। যেন এক প্রিন্সেস! কি অপরুপ তার চেহারা। চেহারা থেকে যেন এনার্জি বাল্বের মত আলোকরশ্মি ছড়াচ্ছে! এই প্রিন্সেস যেই ঘরে যাবে নির্ঘাত সে ঘরের ইলেক্ট্রিসিটি বিল কমে যাবে।
আমি বুঝতে পারলাম অন্যকাওকে নায়, আমাকেই ডাকছে। আমি তার দিকে অপলক তাকিয়ে আছি আর রাস্তা পার হচ্ছি। কোন দিক দিয়ে গাড়ি আসছে কোন খেয়াল নেই। এই এক পলক দেখায় আমিও হয়ত জীবন খোয়াতে চলেছি!
চোখের পলকে একটা বাইক শোও করে এসে আমার সামনে থমকে গেল। বাইকে বসা দুজন প্রায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। তাদের দুজনের মুখ থেকে বিড়বিড় করে কি যেন বের হল। নির্ঘাত গালাগাল! সেদিকেও আমার দৃষ্টি নেই। অবশেষে এ পর্যায়ে জীবনটা খোয়াতে হল না। সহি-সালামত রাস্তা পার হয়ে সেই এনার্জি বাল্বের সামনে এসে দাঁড়ালাম।
“আপনিই সুমন্ত?”
আমি তখনও তার দিকে তাকিয়ে। সে আমার চোখের সামনে হাত নেড়ে আমার ঘোর ভাঙালো। আমি সামান্য ইতস্তত বোধ করলাম। তা দেখে সামান্য হেসে ফেলল সে। ওমা! কি সুন্দর হাসি। সেই এক পলক দেখে যদি একটি জীবন খোয়ানো যায়, তবে এই হাসির জন্য গোটা বিশ্ব খোয়ানো সামান্যই হবে।
“আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?”
“আমাকে আপনি চিনবেন না। আমি আপনার একজন ভক্ত।”
“আমার! কেন? আমি কি কোন সেলিব্রেটি?”
“কেন আপনার নাম কি সুমন্ত নয়?”
“জ্বী আমিই সুমন্ত।”
“তাহলে ঠিকই তো আছে।”
এই জীবনে আমার মত মানুষেরও ভক্ত আছে
তাও আবার এত সুন্দর একজন রাজকুমারী। আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। যাই হোক প্রিন্সেস এর কথাই মেনে নিলাম। শুভ কিছু ঘটবে এমন আভাস আসছে। তাই আপাতত মেনে নিলাম আমি একজন মহা সেলিব্রেটি।
“জানেন আমি আপনার কত্তবড় ভক্ত?”
“না।”
“আপনি মনে হয় খুব মজা করতে পছন্দ করেন তাই না?”
“হুম। কিভাবে বুঝলেন?”
“আমি সব বুঝতে পারি। জানেন আপনার লেখা গল্পগুলো আমি কয়বার করে পড়ি?”
“কয়বার?”
“৫ থেকে ৭ বার করে পড়ি। জানেন আপনার লেখাগুলো আমার খুব ভালো লাগে?”
“না। এখন জানলাম।”
“আসলেই আপনি একটা মজার মানুষ।”
“আমাকে ভালো লাগে না?”
“জ্বী?”
“না মানে, লেখা ভালো লাগে লেখককে ভালো লাগে না?”
আমার এ কথায় প্রিন্সেস একটু লজ্জা পেল। সামান্য মুচকি হেসে বলল,
“হুম। কেন লাগবে না?”
“তাহলে বললেন না যে?”
“দুঃখিত। খেয়াল ছিল না।”
“আপনাকে একটা কথা বলি।”
“জ্বী, বলেন।”
“আপনি অনেক সুন্দর। আপনার কথা, আপনার চোখ, আপনার হাসি সত্যিই অসাধারন।”
“ধন্যবাদ।”
“আপনার জন্য দুটো লাইন বলি?”
“জ্বী, প্লিজ।”
“কে তুমি প্রিন্সেস? কোথা থেকে এলে?
এক পলক দেখা দিয়ে, এ কোন অসুখ দিলে?”
“অসাধারন।”
“সারবে কিসে এই অসুখ, বলে দিও প্লিজ।
নইলে এসে পড়িয়ে দিও ভালোবাসার তাবিজ।”
“সত্যিই অসাধারন।”
“আপনাকে তুমি করে বলার জন্য দুঃখিত।”
“ইটস ওকে।”
“আপনিও কিন্তু আমাকে তুমি করে বলতে পারেন?”
“আচ্ছা ঠিক আছে। বলব।”
“আচ্ছা, একবার তুমি করে বল তাহলে।”
“আচ্ছা ভালো থাকো। বাই।”
“বাই কেন?”
“আমার যে তাড়া আছে তাই।”
“ওওও আচ্ছা। আবার কবে দেখা হবে?”
“যখন আপনার সময় হবে।”
“ঠিক আছে।”
“কিভাবে যোগাযোগ হবে? তোমার কার্ড থাকলে দাও?”
আমি মুহূর্তেই পকেটে হাত দিলাম কার্ড বের করার জন্য। কিন্তু ততক্ষণাৎ মনে হল আমার তো কোন কার্ডই নেই।
“কি হল কার্ড পাচ্ছো না? শেষ হয়ে গেছে?”
“না আমি আসলে কার্ড ইউজ করি না।”
“আচ্ছা কোন সমস্যা নেই।?
“হুম। তোমার কনট্যাক্ট নম্বরটা আমাকে দাও।”
প্রিন্সেস চলে যাচ্ছে। আমি তার পথে তাকিয়ে আছি। তার হেটে যাওয়া দেখছি। অপেক্ষায় আছি কখন একবার ফিরে তাকাবে। আমার সে অপেক্ষার অবসান হল না।
রাত ১১ টা বাজে। গোটা ঘর অন্ধকার। আমি প্রিন্সেস কে একবার কল করলাম। তার আলোর আবেশে এ অন্ধকার ঘরকে আলোকিত করার একটা প্রচেষ্টা!
প্রিন্সেস বুঝি আমার কলেরই অপেক্ষায় ছিল। রিং হতে না হতেই রিসিভ!
“হ্যালো, লেখক সাহেব। কেমন আছেন? এখনও ঘুমাননি যে?”
“খুব একটা ভালো না। ঘুম আসছিল না তাই এখনও জেগে।
তুৃমিওতো জেগেই আছ।”
“হুম। তা এখন কি লিখতেছেন?”
“লিখতেছি না। কিন্তু ভাবছি লিখবো।”
“কি লিখবেন?”
“একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমের গল্প।”
“বাহ! দারুণ তো।”
“তোমার জেগে থাকার কারণ?”
“কোন কারন নেই। অকারনেই।”
“কাল কি একবার দেখা করা যাবে?”
“কেন?”
“তোমাকে দেখলে পঙতি গুলো খুঁজে পাই আমি। তোমায় দেখলে কবিতারা ধরা দেয়।”
“বাহ লেখক সাহেব। প্রেমে পড়ে গেলেন না তো আবার?”
“দোষের তো কিছু করিনি।”
“তা বলার ক্ষমতা তো আর আমার নেই।”
“না থাকাই ভালো। কাল তাহলে দেখা হচ্ছে?”
“হুম। হবে।”
সারারাত আমার ঘুম হল না। সেই এক পলক দেখায় আমার ঘুমও খোয়া গেল।
সামনে খরস্রোতা একটা নদী। তার একপাড়ে আমরা দুজন। আমার ডানপাশে আমার প্রিন্সেস। প্রিন্সেস আজ নীল শাড়ি পড়েছে। তার জিরো ফিগারে খুব ভালো মানিয়েছে। আমার বুকপকেটে একটা গোলাপফুল রাখা। লক্ষটা আশা করি বুঝে গেছেন। দুদিন ধরে পানি দিয়ে তাজা রাখা ফুলটা আজ মুক্তি পেলো।
অনেকক্ষন ধরে দুজনে নীরব আছি। কিভাবে শুরু করব মনে মনে ভাবছি। কিন্তু কিছু পাচ্ছি না।
“কি ব্যাপার লেখক সাহেব। কিছু বলছেন না যে?
নাকি নদীর ভেতরে আবার হারিয়ে গেলেন?”
“হুম হারিয়ে গিয়েছি ঠিকই। তবে নদীর ভেতরে নয়। অন্য কোথাও।”
“ওওওহ। ভালো।”
“কোথায় হারিয়ে গিয়েছি জানতে চাইলে না?”
“না।”
“কেন?”
“ইচ্ছে হয়নি তাই। আপনার পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনির কি খবর? কতদুর লিখলেন?”
“এখনও শুরু করিনি লিখা। খুব শীঘ্রই শুরু করব।”
“বেশ ভালো। শুরু করে দেন।”
“আচ্ছা তোমার চোখদুটো একটু বন্ধ কর।”
“কেন?”
“ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেব।”
“তাহলে তো বন্ধ করছি না।”
“প্লিজ বন্ধ কর, একটা সারপ্রাইজ আছে।”
প্রিন্সেস চোখ বন্ধ করল। আমি তার সামনে গিয়ে, এক হাটু মাটিতে রেখে সিনেমার নায়কদের মত এক হাতে তার সামনে গোলাপ ফুলটাকে তুলে ধরলাম। আশেপাশে থাকা লোকজনের জন্য কিছুটা ইতস্ততবোধ হচ্ছে। নার্ভাসে হাতটা কাপতেছে। কোনমতে শুধু রয়ে গেলাম।
এবার তার চোখ খোলার পালা। চোখ খুললো সে। তার চোখের দিকে তাকাতে ভীষন লজ্জা হচ্ছে। সাজিয়ে রাখা কথাগুলো জট লেগে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে আকাশ সমান সাহস বুকে নিয়ে গড়গড় করে বলে ফেললাম,
“এখনও তোমার নাম জানা হয়নি আমার। তুমি কি জানো আমি কি নাম দিয়েছি তোমার? প্রিন্সেস। আমি হব প্রিন্স তুমি হবে আমার আমার প্রিন্সেস। আমি চাই এখান থেকেই শুরু হোক আমাদের পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনী। তোমার সম্মতির অপেক্ষায় আমি এভাবেই থাকতে চাই। প্লিজ, সম্মতি দিয়ে আমায় তুলে নাও তোমার বাহুডোরে।”
প্রায় দুই মিনিটের মত অতিবাহিত হয়ে গেল। প্রিন্সেস চুপ! তার দৃষ্টি নিচের দিকে। ফেঁসে গেলাম বুঝি! ওভার একটিং হয়ে গেছে। আজীবন বুঝি এভাবেই থাকতে হবে। এদিকে বা পায়ে কিঞ্চিৎ ব্যাথাও শুরু হয়ে গেছে।
আরও এক মিনিটের মত অতিবাহিত হল। অতঃপর প্রিন্সেস এর সম্মতি পেলাম।
কি এক আনন্দ! মনে হল পুরো পৃথিবীটা হাতে পেলাম! আনন্দে গড়া-গড়ি দিতে ইচ্ছে করছে। আশেপাশে লোকজন থাকায় দেওয়া হল না।
হঠাৎ মনে হল শক্ত কিছু পিঠের মধ্যে ঠেকলো! মুহূর্তে সব আলোকিত হয়ে গেল, আসল এনার্জি লাইটের আলোয়। টের পেলাম গড়াগড়ি দিতে গিয়ে খাট হতে নিচে পড়ে গেছি! এতক্ষণ ধরে যা ঘটে গেল তার সবটুকুই স্বপ্নে দেখা।
পরদিন সকাল থেকে আমার মুখে তালা! যা বলার বলে যাচ্ছে তামান্না (আমার বউ)। আমি শুধু শুনে যাচ্ছি। কিছু বললে নির্ঘাত ঝগড়া! তিন-চার ঘন্টা ধরে সবকিছু গোজগাজ করে তামান্না রওনা দিল বাপের বাড়ি।
“একটু এগিয়ে দিয়ে আসি তোমায়?
প্রকাশ্যে নয় মনে মনেই বললাম।
তার দরকার হল না। একাই চলে গেল তামান্না। বড়জোর দুই দিন! তারপর হঠাৎ করে এসে দরজায় টোকা দিয়ে বলবে,
“কি, লেখক সাহেব?
লেখালিখির ভুত কি নামছে মাথা থেকে?”
আমি দরজা লক করে এসে বিছানায় কাত। নতুন কোন স্বপ্ন দেখার চেষ্টায় শুয়ে থাকলাম।
পঞ্চগড় সদর, পঞ্চগড় ।