জোবায়ের রাজু
মেজো মামার মেয়ে লামিয়া আমাকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। ওর প্রোফাইল পিকচার দেখে আমি তো অবাক। লামিয়া এতো বড় হয়ে গেল! অবশ্য অনেক বছর ওদের সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই। কী একটা কারণে মেজো মামা আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এই ঘটনার পর থেকে আম্মা আর আমাদেরকে ওই বাড়িতে যেতে দেননি। অনেক পরে জেনেছি এই ঘটনার পেছনে দায়ী ছিল লামিয়া মা। কারণ মামির ধারণা তার স্বামী আমাদেরকে লাখ লাখ টাকা দেন। তাই তিনি ছলে বলে কৌশলে ভাই বোনের সম্পর্ক নষ্ট করেছেন।
আমি একসময় মামার বাড়িতে বেশ যেতাম। লামিয়ার তখন শিশুকাল। ওকে কোলে কোলে রাখতাম। কথা বলা শেখাতাম। একটু বড় হওয়ার পর দেখলাম ওড়নার প্রতি লামিয়ার খুব লোভ। প্রায়ই সে আমার কাছে ওড়নার আবদার তুলতো। প্রতিবার বলতাম, ‘তোমার এখনো ওড়না পরার বয়স হয়নি। হলে কিনে দেবো।’ লামিয়া মিষ্টি হেসে বলতো, ‘সত্যি কিনে দেবে?’ ওই বয়সে শিশু লামিয়া ছিল আমার পরম বন্ধু। মামি ছোট্ট লামিয়াকে আমার হেফাজতে তুলে দিয়ে সারাদিনের সাংসারিক কাজে ডুবে যেতেন। আমি সারাদিন ফুলের মত এই বাচ্চাটিকে নিয়ে সময় কাটাতাম। কোনো কোনোদিন লামিয়া আমাকে ওড়না কিনে দেয়ার জন্যে ভীষণ জ্বালাতো। ওকে শান্তনা দিতে আমি ওড়না দিয়ে ছড়া বানিয়ে বলতাম, ‘কোনো এক দিনে, ওড়না দেবো কিনে।’ আমার বানানো ছড়া শোনে লামিয়া হি হি করে হাসতো।
২.
ফেসবুকে বন্ধু তালিকায় লামিয়া যুক্ত করার পর ওর টাইমলাইনে ঢুকলাম। অনেকগুলি ছবি পোস্ট করা। লামিয়া এখন ওড়না পরে। রঙিন সব ওড়নায় ওকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে।
আমাকে ছোট্ট মেসেজ পাঠিয়ে লামিয়া লিখেছে, ‘কোনো এক দিনে, ওড়না দেবো কিনে। হি হি হি।’ আমি লিখলাম, ‘ওরে পাগলি, মনে আছে এখনো?’ রিপ্লাই লিখেছে লামিয়া, ‘খুব মনে আছে। কেমন আছো ভাইয়া? একদিন বাসায় আসো। প্লিজ।’ লামিয়ার আবদার পূরণ করব কিনা ভাবছি। করা যায়। কিন্তু আম্মাকে জানানো যাবে না। যেতে দেবেন না।
৩.
অনেক বছর পর আজ মামার বাড়িতে আসলাম। আমার হাতে শপিং ব্যাগ। ব্যাগে একটি লাল ওড়না। লামিয়ার জন্যে কিনে এনেছি। এখানে এসে আমার কেমন কেমন যেনো লাগছে। এই বাড়িতে আজ এতো মানুষ কেনো? পোলাও কোরমার সুঘ্রাণ এসে নাকে লাগছে। কোনো প্রোগ্রাম নাকি!
এতো বছর পর মামি আমাকে দেখে অবাক হননি মোটেও। লামিয়া কোথায়Ñজানতে চাইলে মামি বললেন, ‘ও পার্লারে গেছে। আজ ওর এনগেজমেন্ট। তুমি হঠাৎ কী মনে করে?’ খানিক লজ্জা পেয়ে বললাম,‘না, এমনি এসেছি। আচ্ছা চলে যাচ্ছি। লামিয়া এলে এই ব্যাগটি ওকে দেবেন।’ মামি প্রশ্ন করলেন, ‘এখানে কি?’ স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘ওড়না। লামিয়ার জন্যে এনেছি।’ মামি এদিক সেদিক তাকিয়ে ছোট্ট করে বললেন, ‘মানে কী! লামিয়াকে ওরা আংটি পরাতে আসবে। একটা বাইরের ছেলে এসে ওদের হবু বউকে ওড়না দিয়ে গেছে, এই খবর কেউ জানলে আমাদের ইজ্জত কোথায় নামবে, একবার ভাবো।’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আমি বাইরের ছেলে নই মামি। লামিয়ার ফুপাতো ভাই। ও আমার ছোট বোন। একটা ওড়না গিফট করতে পারিনা?’ বিরক্ত হয়ে মামি বললেন, ‘না, পারো না। লামিয়া এখন বড় হয়েছে। তুমি যাও তো!’
৪.
আমি বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। ঠিক রাস্তা নয় এটি। পুল। ছোটবেলায় লামিয়াকে নিয়ে এই পুলে কত এসেছি। একদিন লামিয়ার হাত থেকে পুতুল পড়ে গেল পুলের নিচের পানিতে। জোয়ারে ভেসে চলে গেল সেই পুতুল। কত কেঁদেছে লামিয়া।
অনেক বছর পর আজ আবার এসেছি এই পুলে। শপিং ব্যাগ থেকে ওড়নাটি বের করে ফেলে দিলাম নিচের পানিতে। জোয়ারে ভেসে সেটা দূরে চলে যেতে লাগল, যেভাবে একদিন এখানে লামিয়ার হাত থেকে পুতুল পড়ে জোয়ারে ভেসে চলে গিয়েছিল।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী