“পাহাড়তলী স্টেশন”
প্রেমের গল্প – আহমেদ সুমন
গাড়ি এসে থামলো ভাটিয়ালী স্টেশন। জানালার পাশে বসে ল্যাম্পপোস্টের দিকে তাকিয়ে আছে মাহিম। হঠাৎ মায়ের ফোন পেয়ে ঢাকা থেকে রওনা হল চট্টগ্রাম যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পুরো পথেই আজ খুব অন্যমনস্ক মনে হচ্ছে তাকে। অতচ অন্যান্য বার খুব হৈ-হুল্লোড়র আর হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখত পুরো বগি। ট্রেনে থাকা অন্য যাত্রীরা ও তার খুনসুটি গুলো বেশ উপভোগ করত।
হঠাৎ একটি তীক্ষ্ণ আর সুমিষ্টি সুরে চমকে ওঠল মাহিম। কতগুলো ব্যাগ হাতে নিয়ে তড়িঘড়ি করে চলতি গাড়িতে ওঠে পড়ল মুনিয়া। নিজেকে সামলাতে না পেরে মাহিমের উদ্দেশ্যে বলে ওঠল “এই যে, একটু ব্যাগ গুলো ধরুন”।মুনিয়ার কন্ঠস্বর অন্যমনস্ক মাহিমের বুকে গিয়ে বিঁধল। নিমিষেই কেটে গেল তার সকল ক্লান্তি আর দূর্ভাবনা। মূহুর্তের মধ্যে মনে হল এমন সুরেলা কন্ঠের অমৃতবাণী সে আর কখনোই শুনতে পায়নি তার পঁচিশ বছরের জীবনে। বার বার তার কানে ভেসে আসছে সেই শব্দগুচ্ছ ” এই যে একটু ব্যাগ গুলো ধরুন “!
নিজেকে সামলে নিয়ে কয়েকটি ব্যাগ নিজ হাতে টেনে নিলো মাহিম। হাতে থাকা বাকি ব্যাগগুলো রেখে মুনিয়া ও বসে পড়ল মাহিমের পাশের সিটে। একটু ধন্যবাদ জানিয়ে চুপ হয়ে বসে রইল মুনিয়া। খানিক নীরবতার পর নিজের ভেতরের জলোচ্ছ্বাস থামাতে না পেরে মাহিম বলে উঠল, কোথায় যাবেন?
মুনিয়াঃ পাহাড়তলী স্টেশন। আপনি?
মাহিমঃ বটতলী স্টেশন। বেড়াতে যাচ্ছেন
নাকি?
মুনিয়াঃ হ্যাঁ, মামাতো বোনের বিয়ে।
মুনিয়ার প্রতিটি শব্দ মাহিমের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে, মুনিয়ার মুখ দিয়ে যেন স্বয়ং স্বর্গীয় কোন হুর কথা বলছে। খানিক আগে ও তার মনে যে বিষাদ চেপে বসেছিল, নিমিষেই তা চাপা পড়ে গেল মুনিয়ার সহাস্য মুখের কথা শুনে। কিছু সময় নীরব থাকার পর পুনরায় নীরবতা ভাঙ্গলো মাহিম।
মাহিমঃ যদি কিছু মনে না করেন, আপনার
নাম জানতে পারি?
মুনিয়াঃ হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি নুসরাত ইমরোজমুনিয়া। সবাই মুনিয়া বলে ডাকে।
মাহিমঃ মুনিয়া পাখির নাম শুনেছেন?
খুব মনকাড়া রূপ তার!
কিছু না বলে মুচকি একটু হাসি দিলো মুনিয়া।আবার নেমে এলো পিনপতন নীরবতা।
মাহিমের মনে শত প্রশ্ন উঁকি মারছে। কিন্তু মুখ ফোটে সব বলতে পারছেনা। আড়চোখে বার বার তাকায় মুনিয়ার দিকে। প্রতিটি দর্শনে সে খুঁজে পাই নতুন সৌন্দর্য। মুনিয়ার টোল পড়া গালের মুচকি হাসি মাহিমকে বিমোহিত করে তোলে। মুহূর্তের মধ্যে সে হারিয়ে গেলো কল্পনার রাজ্যে।বুনতে লাগলো রঙিন সব স্বপ্ন। আপন গতিতে ছুটে চলছে ট্রেন। পৃথিবীর সব কিছু পেছনে পেলে এগিয়ে যাচ্ছে তার গন্তব্যে। হঠাৎ গাড়ির সাইরেন বেজে উঠল। খানিকটা কেঁপে ওঠে মাহিম আবার ফিরে এলো তার বাস্তব জগতে। বুঝতে পারল গাড়ি কোন একটি স্টেশনে এসে থেমেছে।
চোখ মেলে দেখে,মুনিয়া তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখে ট্রেন “পাহাড়তলী স্টেশন ” এসে থেমেছে। নিমিষেই বুকের ভেতর চিনচিনে এক ব্যাথা অনুভব করলো মাহিম। ভালোবাসার বীজ তার অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেলো।
গাড়ি থামার সাথে সাথেই নামার জন্য প্রস্তুত হলো মুনিয়া। মাহিমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালো দরজার অভিমুখে। হঠাৎ বাকরূদ্ধ হয়ে পড়ল মাহিম। মুনিয়ার কথার কোন উত্তর না করে শুধু তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।খানিক অপেক্ষা করে ফের পা বাড়ালো মুনিয়া। জানালার ফাঁক দিয়ে মুনিয়ার চলার দৃশ্য দেখতে লাগলো মাহিম। কিছু পথ অগ্রসর হয়ে আবার পেছনে ফিরে তাকাল মুনিয়া। তার চোখে যেন মায়ার জাল। চোখে চোখ পড়তেই মাহিম অনুভব করলো স্বর্গীয় শিহরণ। সাইরেন বাজিয়ে ফের ছুটে চললো ট্রেন। অদৃশ্য হয়ে গেল মুনিয়ার অস্তিত্ব। পুরোনো সেই বিষাদ আর সদ্য ভাঙ্গা রঙিন স্বপ্নের বেদন আবারো চেপে বসল মাহিমের মাথায়….।
ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।