সুচরিতাসু,
দীর্ঘ চার দশক পর তোমাকে চিঠি লেখার অবসর হল। আমাদের সময়ে যে বয়সে একটি ছেলে প্রেমের চিঠি লিখত–সেই সময় আমার বাবার পরিশ্রমের ঘাম গন্ধ, মায়ের একমাত্র শাড়ির হলুদ, তেল গন্ধ, বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়া দিদির হারমোনিয়ামের বেলো টিপে গান শেখার হতাশ চেষ্টা, আর বুড়ি ঠাকুমার ছানিপড়া দুচোখের অনির্দেশ দৃষ্টি আমাকে সতর্ক করে দিত, মেয়েদের মুখের দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে রাস্তা পেরিয়ে যেতাম, যারা হয়তোবা আমার প্রেমিকা হলেও হতে পারতো।
তোমার সেই ছাতিম গাছটার কথা মনে আছে? গাছটার কত বয়স কেউই সঠিক জানতো না। বাপ-ঠাকুর্দার আমল থেকে একইরকম ডালপালা বিছিয়ে গ্রামের ঠিক মধ্যিখানে গ্রীষ্মের ছায়া, বর্ষার ছাতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কবে কোনও এক সুহৃদ চারপাশটা বাঁধিয়ে দিয়েছিল, সেই ছাতিমতলা ছিল পাড়ার যত বুড়োমানুষের আড্ডার পীঠস্থান। তার পাশে ডাকাতিয়া বিল, আর বিলের উত্তর পাড়ে তরুণ সঙ্ঘ ক্লাব। ক্লাবের মাঠে ঘেঁটুদা মেয়েদের ব্রতচারী শেখাত। সেখানে তুমি প্রতি বিকেলে আসতে। আমি বাবার পুরোনো ভাঙা সাইকেলটায় চড়ে চলে যেতাম পূবপাড়ার দিকে। আমার অবিবাহিত দিদি কয়েকঘর টিউশন পড়াত। ধোপা-নাপিত-মেথর-মুদ্দোফরাসের পাড়া। দিদি অঙ্কটা পারতো না, শর্ত ছিল সপ্তায় দুদিন গিয়ে আমি অঙ্কটা শিখিয়ে দেব।
ব্রতচারীর পোশাক ছিল আকাশি-নীল শাড়ি, সাদা ব্লাউস আর ঘন নীল রঙের বেল্ট। আর ছোটরা পড়ত একই রঙের স্কার্ট-ব্লাউস। আকাশ রঙা সজ্জার বুকে শেষ সূর্যের কামরাঙা আলো তোমার মুখে বিজবিজে ঘামের মুক্তদানা বুনে দিত। তোমার মুখের পানে চকিত দৃষ্টি হেনেই চোখ নামিয়ে নিতাম…..তখনই নাকে আসতো বাবার পরিশ্রমের ঘামগন্ধ, মায়ের তেল-ঝোল-মশলা মাখা শাড়ির নাড়িগন্ধ, আর দিদির আভরণহীন, প্রসাধনহীন শরীরের ছাপোষা গন্ধ, ঠাকুমা তখন মরে গেছে।
আমি যখন ক্লাস টুয়েলভ, তুমি তখন টেন, আমি যখন কলেজে, তুমি মেয়েদের স্কুল ছেড়ে কো-এড স্কুলে….শত শত ছেলের বুকে…ঢেউয়ের উথাল…পাথাল….তোলপাড়। স্কুল, টিউশন, বড়রাস্তা, বাজার…অপার…অবাক…কাম দৃষ্টি ছাড়িয়ে বড় হতে হতে এতটাই বড় হয়ে গেলে….কবে যেন সাতসমুদ্র পার হতে কোনও এক পৃথ্বীরাজ পক্ষীরাজ ঘোড়া চড়ে এসে সংযুক্তাকে পিঠে বসিয়ে নিয়ে চলে গেল ভূমণ্ডলের অন্য কোনও অক্ষে। তারপর আর কী! আমার সেই ঘামগন্ধের গল্প চলতেই থাকল।
তারপর দিন যায়, দিন আসে। গ্রীষ্মের পর বর্ষা, তারপর শরৎ আসে, বাবা-মা-দিদির সাথে আমারও বয়স বাড়ে। আশপাশের যুবকেরা প্রৌঢ় হল, প্রৌঢ়রা বৃদ্ধ। তারপর ঈশানকোনে ঝড় উঠল–দুমাসের ব্যবধানে বাবা-মা চলে গেল আর আমার অবিবাহিতা শ্রীহীন দিদিও গান গাওয়া বন্ধ করে দিল। কিছুদিন পর এবাড়ি, ওবাড়ি, পাড়ার মুদির দোকান, সিনেমাহলের সামনে যার সঙ্গেই দেখা হোক না কেন নিজের বিয়ের তদ্বির করে বেড়াত। তারপর একদিন টিউশন থেকে ফিরে দেখি দিদি ঘরে নেই–সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত নামল দিদি ফিরল না। দুদিন পর কোথা থেকে যেন ফিরে এল। তারপর থেকে আমার অত কথা বলা, পাড়াবেড়ানো দিদি একদম চুপচাপ হয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দিল। একদিন ভোরে বাড়ির পাশের পুকুরে ভোরের সদ্য ফোটা পদ্মের মত আমার দিদি ভেসে উঠল। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলল আমার দিদির পেটে তখন একমাসের বাচ্ছা।
তারপর থেকেই তোমাকে একটা চিঠি লিখতে বড় ইচ্ছে হয়। তবে ইচ্ছে হলেই তো হয়না, সাহস থাকা চাই, যেটা কোনোদিনই আমার ছিলনা। আসলে যখন একা হয়ে গেলাম, আমাদের দুকামরার ঘর থেকে বাবার পরিশ্রমের ঘামগন্ধ, মায়ের শাড়ির মশলাগন্ধ, আর দিদির শরীরের নিরাভরণ ছাপোষা গন্ধ মতে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল, ঠিক তখনই এক রাতে নিজের শরীরের তীব্র কাম গন্ধে অস্থির হয়ে পড়লাম, স্বপ্নে তোমায় দেখলাম, ভোরের আলোয় ঘুম ভেঙে নিজের কাছে নিজেই ভীষণ লজ্জা পেলাম।
দিদি চলে যাওয়ার পর পূবপাড়ার টিউশনগুলো টিকে ছিল। বাবার পুরোনো লজঝড়ে সাইকেলটার চেইন ঠিক তোমাদের বাড়ির সামনেই পড়ে যেত। তারপর তোমাকে দুয়েকবার দেখেছিলাম….সবুজ টিয়াপাখি শাড়ি, সিঁথিতে আগুন নিয়ে হেঁটে চলে যেতে। তোমার চলার পয়ার ছন্দে বেজে উঠত অমরাবতীর শুভ নহবত, আনকোরা শাড়ির খসখস শব্দে ঘুম ভাঙত দোয়েল, শ্যামা, ফিঙে, গাং শালিখ, ঘাস ফড়িংয়ের—তোমার উছল হাঁসির কলতানে গড়িয়ে যেত শয়ে শয়ে গঙ্গা-যমুনা, নদ-নদী, খাল-বিল। আমি তখন সাইকেলের চেইন লাগাতে গিয়ে ঘেমে-নিয়ে একসা হয়ে—প্রখর দিবালোকে চোখের সামনে উড়ে বেড়াত সন্ধ্যেরাতের হাজার জোনাকি।
তারপর কবে যেন শরীরের দপদপানি কমে এল। ভাঙা ছাতা পড়া আয়নায় চোখে পড়ল অসংখ্য বলিরেখা ভরা একটা মুখ, চুল-দাড়িতে অনেক রুপোলি রেখা……তারপর বদহজম, লো প্রেসার, হাই সুগার আর প্রস্টেটে কষ্ট নিয়ে এখন সম্বল বলতে একটা কাঁঠাল কাঠের লাঠি আর ভিজে উঠোনে পৌষের একচিলতে রোদ।
আজকাল তোমাকে বড় চিঠি লিখতে ইচ্ছে হয়। অনেকদিন তোমাকে দেখিনি। এখন তো তোমারও বয়স হয়েছে…..গিন্নিবান্নি হয়ে নিজের সংসারে বসে গেছ….ছেলেমেয়ে নিজেদের জগৎ খুঁজে পেয়েছে…তোমারও কি এখন মাঝে মাঝে নিজেকে একা মনে হয়? এই দেখো কি বলে ফেললাম? তোমার অমন বটবৃক্ষের মত স্বামী….সপ্তসাগরের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয়-পরিজন…. তোমার একাকিত্বের বিলাসিতা সাজেনা!
তোমাকে দেখিনা বহুদিন! চোখে আমার ছানি পড়েছে…লিখতে গেলে জল কাটে। চোখ মুছলে ভিজে আঙুলে লেখাগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই আজকাল আমি তোমায় মনে মনে চিঠি লিখি। একটা কথা বলতে খুব লজ্জা করছে, যদি কিছু মনে না করো… বলবো? মনে মনে তোমাকে মাঝে মাঝে ভালোবাসি! এ কী? তুমি রাগ করলে?
ইতি-
‘থাক না নামটা নাই বা বললাম’