জোবায়ের রাজু
উপন্যাসের শেষের অংশটি পড়তে পড়তে কখন যে রাত বারোটা বেজে গেলো, টের পায়নি তাসলিমা। সালেহা বেগম দৌড়ে এসে মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল গলায় বললেন, ‘মা, বাঁশির শব্দ শুনছিস?’ মায়ের এমন প্রশ্নে তাসলিমার মনে হলো আজ তো শনিবার। শনিবার মানেই রাত বারোটার পর মায়ের বাঁশি শোনবার অদ্ভুত সময়।
শনিবার এলে রাত বারোটার দিকে সালেহা বেগম যে বাইর থেকে বাঁশির শব্দ শোনেন, এটা মিথ্যে নয়। তিনি স্পষ্ট শোনেন কে যেনো উদাস সুরে আকুল করা বাঁশি বাজায়। ঠিক স্বামী কবির হোসেনের মত। মানুষটা আর কিছু পারুক না পারুক, খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতেন। বাঁশির প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিলো মানুষটার। যখনই মন ভালো থাকতো, আলমারি থেকে বাঁশিটা বের করে ফুঁ দিতেন আর আশ্চর্য সুরে বাঁশি বাজতো।
বিয়ের পর থেকে সালেহা বেগম স্বামীর বাঁশি বাজাতে পারার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে যতখানি অবাক হয়েছেন, ঠিক ততখানি ব্যথাও পেয়েছেন স্বামীটি তার সৎমায়ের অত্যাচারে বড় হওয়ার করুণ গল্প শোনে। কবির হোসেন শৈশবে মাকে হারাবার পর বাবা যখন আবার বিয়ে করে সংসারে নতুন মানুষ আনেন, সেই মানুষটি মা হতে পারেন না কবির হোসেনের। ফলে সৎমায়ের অনাদরকে সেই সুদূর শৈশবে আপন করে নেন তিনি।
বিয়ের পর সালেহা বেগম দেখেন তার সৎ শাশুড়ি নন কেবল, সৎ দেবররাও কবির হোসেনকে দুই চোখের বিষ ভাবেন। ফলে সংসার জীবন শুরু করার প্রথম দিকেই সালেহা বেগম বুঝে গেছেন এখানে বাস করতে হলে এইসব কাঁটাকেও সাথে নিয়ে বাস করতে হবে। শাশুড়ি এবং দেবররা সালেহা বেগমের দোষ ত্রæটি খোঁজার ফন্দি আঁটেন বলে কবির হোসেন স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা সংসার পাতেন।
সেই সংসারে নতুন মানুষ আসে। আশ্চর্য রূপ নিয়ে জন্মায় তাসলিমা। আল্লাহ এমন একটি মেয়ে ঘরে পাঠিয়েছেন বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ত্রæটি রাখেন না কবির হোসেন। মেয়েকে ঘিরে স্বামীর আহলাদ দেখে মুখ টিপে হাসেন সালেহা বেগম।
খুব মনে আছে সালেহা বেগমের সেই শনিবার রাতের কথা। অপূর্ব জোছনা ঝরেছিলো আশ্চর্যজনক সৌন্দর্য নিয়ে। রাতের নিস্তব্দতা ভেঙে দিয়েছে ঝিঁ ঝিঁ পোকা। নিশিরাতের জানালা খুলে বাইরের অদ্ভুত জোছনা দেখে কবির হোসেন বউকে বললেন, ‘আসো, রাতভর উঠোনে বসে জোছনায় ভিজি।’ স্বামীর আবদারকে অহেতুক পাগলামী ভেবে সালেহা বেগম ঘুমন্ত মেয়ে তাসলিমার কপালে চুমু খেতে খেতে বললেন, ‘আমার মেয়েই আমার জোছনা। অন্য জোছনা দেখবো না।’ বউকে বেশ কয়েকবার আবদার করেও সাড়া না পেয়ে কবির হোসেন রাত বারোটা দিকে বাঁশিটা নিয়ে বাইরে বের হলেন। রূপালি জোছনার আলোয় সমস্ত গাঁও ভেসে গেছে আশ্চর্য সৌন্দর্য নিয়ে। জোছনার রূপ দেখতে দেখতে গাঁয়ের শেষ মাথায় চলে এলেন কবির হোসেন। তারপর বাঁশিতে ঠোঁট রেখে আকুল করা সুর তুললেন। সালেহা বেগমের কানেও পৌঁছলো সেই সুর।
ভোর হওয়ার পরও কবির হোসেনের বাড়ি আসার খবর নেই দেখে চিন্তায় পড়লেন সালেহা বেগম। সকাল বেলায় গ্রামবাসী আবিষ্কার করেন ডোবায় ভাসছে কবির হোসেনের লাশ।
আসমান ভেঙে পড়ে সালেহা বেগমের মাথায়। বড় অবেলায় কে তাকে বিধবা করলো আর দুধের শিশু তাসলিমাকে করলো বাবাহারা! এই বিচার কারো কাছে পেলেন না সালেহা বেগম। রহস্যে থেকে গেলো কবির হোসেনের খুনের ঘটনা। তবে সালেহা বেগমের ধারনা তার সৎ দেবররা পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে তার স্বামীকে খুন করেছে।
অকালে বিধবা হয়ে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে তাসলিমাকে আঁকড়ে ধরলেন সালেহা বেগম। স্বামীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার জীবনে যতগুলি শনিবার রাত এসেছে, তিনি রাত বারোটার পর শুনেছেন বাঁশির সুর। শনিবার রাত বাড়ার সাথে সাথে কে যেনো বাঁশি বাজায় তার স্বামীর মত। মন বলছে তার স্বামীই ওই বাঁশি বাজাচ্ছেন স্বর্গ থেকে।
তাসলিমা বড় হয়েছে। মাকে ঘিরে তার সমস্ত পৃথিবী। প্রতি শনিবার রাতদুপুরে মায়ের এই বাঁশির ঘটনা তার এখন অসহ্য লাগে। কারণ তাসলিমা কখনো মায়ের মত বাঁশির ওমন ডাক শোনেনি। এটা নিশ্চয়ই মায়ের মানষিক রোগ।
আমিশাপাড়া, রাজু ফার্মেসি, নোয়াখালী।