বইঃ আগুনের পরশমণি
লেখকঃ হুমায়ূন আহমেদ
বইয়ের ধরনঃ উপন্যাস
প্রকাশনীঃ হাতেখড়ি
প্রকাশকঃ মো: আবু মুসা সরকার
প্রচ্ছদ ও অলংকরণঃ সমর মজুমদার
পৃষ্ঠাঃ ৮৪
মুদ্রিত মূল্যঃ ৭০ টাকা
প্রথম প্রকাশঃ ডিসেম্বর ১৯৮৬
বই পর্যালোচনা লিখেছেন- অগ্নি কল্লোল
বাংলা, বাঙালি এবং বাংলাদেশ এর সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেষ্ঠ সময় ছিলো একাত্তর। এই সময় জনগণ সবচেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ ছিলো, সবচেয়ে বেশি সৎ ছিলো, সবচেয়ে বেশি অসাম্প্রদায়িক ছিলো। একাত্তর কে ভুলে যাওয়া সম্ভবপর নয়। একাত্তর কে অস্বীকার করা অনৈতিক, অন্যায়। একাত্তর কে অস্তিত্বহীন প্রমাণ করা মানে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে অস্বীকৃতি জানানো। তাই একাত্তর কে সাথে নিয়েই আমাদের পথ পারি দিতে হবে। একাত্তর আমাদের গর্ব। হুমায়ূন আহমেদ এর ‘আগুনের পরশমণি‘ একাত্তরের দেহের অংশ মাত্র। উপন্যাসটির নাম ‘গীতবিতান’ এর পূজা পর্বের (পূজা/২১২) অত্যন্ত সুপরিচিত এবং বিখ্যাত ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ গান থেকে নেওয়া।
আখ্যানঃ
একাত্তর এর মাঝামাঝি সময়। বদিউল আলম নামের এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সাতজনের একটি ছোট দল নিয়ে গেরিলা অপারেশন চালানোর জন্য ঢাকায় আসেন। পরিকল্পনা মোতাবেক মতিন সাহেবের বাসায় ওঠেন বদিউল আলম। এরপর, দলের অন্যান্যদের সাথে নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন যায়গায় বদিউল আলমের গেরিলা অপারেশন এর মাধ্যমে এগিয়ে চলে কাহিনী। পাকবাহিনীর অন্তরের ভেতর কাঁপুনি ধরিয়ে দেন বদিউল আলম আর তাঁর দল। উপন্যাসে রণাঙ্গনে সরাসরি লড়াই এর পাশাপাশি ছিলো পারিবারিক এবং সামাজিক ঘটনা। যার ভেতর স্পষ্ট হয় চরিত্রগুলোর আবেগ, প্রেম, মমতা। একসময় মতিন সাহেব এর পরিবারের সাথে ইচ্ছের অজান্তেই জড়িয়ে যান গেরিলা যোদ্ধা বদিউল আলম। ঘটনার এক পর্যায়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গুলি লাগে বদিউল আলমের। সহযোদ্ধা আশফাকের সহযোগীতায় কোনোরকম মতিন সাহেব এর বাসায় আসতে পারেন আলম। কিন্তু তখনো রক্ত ঝরছিল ক্ষত থেকে। আলমকে রেখে আশফাক যান ডাক্তার আনতে। কিন্তু আশফাক আর ফেরেনি। মতিন সাহেবের বড় মেয়ে রাত্রি, স্ত্রী সুরমা এবং মতিন সাহেব আলমকে বাঁচানোর প্রচেষ্টা করেন। রণাঙ্গনের যুদ্ধের বাইরেও চলছিল এক যুদ্ধ, নতুন ভোর দেখবার যুদ্ধ, বাঁচার এবং বাঁচানোর যুদ্ধ।
চরিত্র
ঘটনা এবং চরিত্রের মধ্যে অবিচ্ছেদ সম্পর্ক বিদ্যমান। মূলত চরিত্রকে কেন্দ্র করেই আবর্তন করে ঘটনা বা কাহিনী। হুমায়ূন আহমেদ এর চরিত্র সৃষ্টির প্রতিভা অসাধারণ। যার ফলে তার চরিত্রগুলো পাঠকের কাছে অতি পরিচিতজন বা চেনা জগতের বাসিন্দা হয়ে ওঠেন। তার অধিকাংশ চরিত্র অবাস্তবত এবং উদ্ভট হলেও এই উপন্যাসের অধিকাংশ চরিত্র বাস্তবধর্মী আর বিশ্বাসযোগ্য।
এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বদিউল আলম। একজন গেরিলা যোদ্ধা। যিনি পরিবারের মায়া ত্যাগ করে দেশকে স্বাধীন করবার আশা নিয়ে যুদ্ধে নেমেছেন। যার নেতৃত্বে ঢাকায় একটি ছোট দল এসেছে গেরিলা অপারেশন চালানোর জন্য। উপন্যাসের পুরোটা সময় জুড়ে লেখক তার উপর আলো জ্বেলেছেন। তাকে কেন্দ্র করে জুড়েছেন ঘটনা বা অন্যান্য চরিত্রগুলোকে। তার ব্যক্তিত্বের ভেতর ছিলো দৃঢ়তা, গাম্ভীর্য, নির্ভীকতা।
উপন্যাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মতিন সাহেব। যিনি মূলত একজন অস্থির প্রকৃতির মানুষ। তিনি তার পরিবারের এবং নিজের জীবনে বিপদ আসতে পারে জেনেও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আশ্রয় দিয়েছেন নিজ বাড়িতে। তার ভেতর দিয়ে লেখক আড়ালে থাকা একজন দেশপ্রেমীককে এবং রণাঙ্গনে সরাসরি না গিয়েও যে যুদ্ধ করা যায় সে দিকটাকেই তুলে ধরেছেন।
সুরমা, মতিন সাহেবের স্ত্রী। গম্ভীর প্রকৃতির রাগী মানুষ। কিন্তু একসময় গেরিলা যোদ্ধা আলমের প্রতি তাঁর মাতৃসুলভ মমতা গল্পের ভিন্ন মাত্রা সৃষ্টি করে।
উপন্যাসে খুব অল্প সময় দেখা যায় রাত্রিকে। শান্ত এবং লাজুক প্রকৃতির মেয়ে কিন্তু দায়িত্ববান। আলমের প্রতি তার সূক্ষ্ম ভালোবাসা যুদ্ধের ভেতর প্রেমময় সুবাতাস ছড়িয়ে রাখে।
এ ছাড়াও বিন্তি, অপালা সহ আরো কিছু চরিত্র ছিলো উপন্যাসে যা কাহিনী নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
#সংলাপ
মালা গাঁথতে যেমন সুতার প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন পুথিরও। সুতা যদি চরিত্র হয়ে থাকে তাহলে পুথি হচ্ছে তার সংলাপ। সুতার ভেতর পুথির আদর্শ সহাবস্থানের ফলেই তৈরি হয় একটি চমকপ্রদ মালা। হুমায়ূন আহমেদের এই উপন্যাসে সংলাপের আধিক্য ছিলো মাত্রাতিরিক্ত, কিছু প্রয়োজনীয় কিছু অপ্রয়োজনীয়। সংলাপগুলো নিতান্ত সহজ,সরল। প্রচলিত বাক্যগুলোকেই তিনি অক্ষরে আবদ্ধ করছেন। সংলাপগুলো পাঠককে খুব একটা ভাবায় না, চিন্তার খোরাক জোগায় না। তবে চরিত্র নির্মাণে প্রয়োজনীয় সংলাপগুলো মালার ভেতর কিছুটা আদর্শিক সহাবস্থানের চেষ্টা করেছে। এরকম সংলাপের শিল্পমূল্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
[নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ]
লিখনশৈলী
হুমায়ূন আহমেদ কে পাঠ করার জন্য খুব উচু মানের পাঠক হওয়ার আবশ্যকতা নেই। অত্যন্ত সাদামাটা এবং চিন্তাহীন বাক্য রচনা করেছেন তিনি। তাঁর আগুনের পরশমণি গ্রন্থটিতেও এর ব্যতিক্রম কিছু ছিলনা। শব্দ প্রচলিত, বাক্য সরল। উপমা এবং গভীরতা নেই বললেই চলে। তাঁর লেখার মধ্যে বরাবরই কৌতুক প্রিয়তা দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ নিছক হাসি-তামাশা কিংবা খুনসুটি ঠাসানো থাকতো গম্ভীর বিষয়ের মধ্যেও। আগুনের পরশমণি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস হলেও অত্যন্ত সংকটময় সময়েও তিনি চরিত্রগুলোর কৌতুক রসকে টেনে তুলেছেন। যা অনেক সময় উপন্যাসের মূল স্পিরিটকে গতিহীন করে।
#লেখকের_সামগ্রিক_জীবন-দর্শন
লেখক মূলত মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যোদ্ধাদের যে অবদান সে বিষয়টিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। পাশাপাশি রণাঙ্গনে সরাসরি লড়াই না করেও যে অসংখ্য মানুষ পরোক্ষভাবে যুদ্ধরত ছিলো সে দিকটিকে প্রকাশ করেছেন।
পাঠ_প্রতিক্রিয়াঃ
হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি বাংলা সাহিত্যে নির্জীব-চিন্তাহীন পাঠক তৈরি করেছেন। কোনরকম ভাবনা-চিন্তা ছাড়া খুনসুটি আর দৈনন্দিন কাজকর্ম দিয়ে পাঠকদের আটকে রেখেছেন দিনের পর দিন। তাঁর সাহিত্যে শিল্পমূল্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তিনি নিজেও তাঁর লেখা নিয়ে ছিলেন সন্দিগ্ধ। প্রশ্ন উঠেছে তাঁর লেখার সাহিত্যিক মূল্যবোধ নিয়েও। তবে এটা স্বীকার করতেই হয় যে তিনি অসাধারণ গল্প বলতে পারতেন। সহজ-সরল ভাষায় বলে যেতেন সুখ-দুঃখ, প্রেম-অপ্রেম, আনন্দ-বিরহের কথা। আগুনের পরশমণি মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক উপন্যাস হলেও লেখক মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার উপর পারিবারিক এবং সামাজিক, সূক্ষ্ম প্রেম এবং খুনসুটির হালকা কিংবা ঘন কুয়াশা ফেলে একধরনের আদর্শ দ্রবণ তৈরি করেছেন। কিন্তু সবসময় তা আদর্শ ছিল না। মূল ঘটনার ঝাপসা বর্ণনা মাঝেমাঝে বিচ্ছিন্ন করে রাখে মূল কাহিনী থেকে। মূল ঘটনার চেয়ে পারিপার্শ্বিক ঘটনার আধিক্যের কারণে ছন্দপতন হয়েছে শিল্পমানের। পরিশেষে, আলোচনা সমালোচনার ভেতর দিয়েই এগিয়ে চলে সৃষ্টি এবং তাঁর স্রষ্টা। বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ যেমন প্রয়োজনীয় তেমনি তাঁর সৃষ্ট আগুনের পরশমণি বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।