বই পর্যালোচনা: ‘হোম ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড ‘– অমর্ত্য সেন

বই পর্যালোচনা: ‘হোম ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড ‘– অমর্ত্য সেন

পর্যালোচনা- মিরাজুল হক 

পুস্তক পর্যালোচনা : 

Home in the World – A memoir by AMARTYA SEN 

Publisher – ALLEN LANE (Penguin Books ) ; MRP – Rs. 899.00

‘ থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে , দেখবো এবার জগত টা কে ‘ । কিন্তু কি ভাবে দেখবো ? কোন দৃষ্টিকোণ থেকে ? কি লেন্স দিয়ে দেখবো ?   চোখ থাকলেই তো দেখা যায় না । দেখার চোখ থাকা চাই । হাঁটি হাঁটি পা পা করে ঘরের চৌকাঠ টপকে পাড়া গ্রাম সমাজ  দেশ অতিক্রম করে  যে মানবশিশুর সংগে বিশ্ব প্রকৃতির  পরিচয় ঘটে , সেই সব  শিশুর জীবনের তাল লয় ছন্দ একই  রকম হয় না। বিভিন্ন শিশুর মনের আধার হরেকরকম , আলাদা।  আর এই মনের গঠন ও বিকাশের উপকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী। এই বইটির সময়কাল নভেম্বর , ১৯৩৩ থেকে মার্চ , ১৯৬৩। এই তিরিশ বছরের পরিমণ্ডলে শিশু থেকে বালক , ছাত্র থেকে গবেষক থেকে তরুণ শিক্ষক অমর্ত্য সেন কে দেখতে পাই । এই সময়কালের অমর্ত্য সেনই  সুপ্ত অঙ্কুরিত বীজ। আগামী ভবিষ্যৎ । মানবসভ্যতার অন্যতম রূপকার । আমাদের কাছে ,’ আমাদের বিবেক’। 

বইটির প্রথমেই অমর্ত্য সেন আল-বেরুনী র , ‘ তারিক-আল-হিন্দ’ এর  প্রাসঙ্গিকতার প্রেক্ষিতে , আল-বেরুনী র একটি মন্তব্য উল্লেখ করেন । সেটা ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে একটা অন্যরকম ধারনা – ‘ ভারতীয়রা  যে কোন বিষয়ের উপর আলোচনা করতে পারে –  বিষয়টা সঠিক ভাবে না-জেনেও ‘ । এটা অধিকাংশ  বাঙালী ও ভারতীয়দের ক্ষত্রে  অনেকটাই ঠিক । তাই  এই বইয়ের শুরুতেই তিনি বলেছেন , “ I should begin by taking about things I do know … at least to talk about things I have experienced “ ( পৃষ্ঠা – XV ) ।  তাই  বইটির শিরোনামে  – “A memoir “ কথা টি তাৎপর্যপূর্ণ । নিজের অভিজ্ঞতা নির্ভর  জীবন কথা বা স্মৃতিকথা ।  

বাড়ী – ঘর – বাসা :

বি-বি-সি র একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল , ‘ Where do you consider to be your home ? ‘ ( পৃষ্ঠা – ৩ ) । ঘর বা বাড়ী র প্রতি আমাদের সবারই একটা গভীর  আবেগ আছে । স্মৃতি আনান্দ বেদনার আকুলতা । আবার ওপার বাংলায় বাড়ী কে বলে  ‘ বাসা ‘। এই ‘ বাসা ‘র আগে ‘ ভালো’ শব্দটা জুড়ে দিলে , পাওয়া যায় একটা অন্য মাত্রা । ‘ভাল-বাসা’ র টান । বাড়ীর প্রতি নিবিড় টান । যা প্রচ্ছন্ন থাকে । অপ্রকাশিত । এই বাড়ী র মধ্যকার আলো বাতাস পরিমণ্ডলের উপকরণ নিয়ে চৌকাঠ টপকে , বাড়ী র উঠান পেরিয়ে বাইরের জগতের সংগে পরিচয় ঘটে । তাই এটার বহুমাত্রিক তাৎপর্য আছে । 

আদি পৈত্রিক নিবাস অধুনা বাংলাদেশের মানিকগঞ্জের মাটো তে । তবে  তাঁর জন্ম রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর গুরুপল্লী তে ।  আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের মাটির কুঠিরে ।  গুরুদেবের আশ্রমে –  ( যেখানে বিশ্ব একত্রিত হয়েছে জ্ঞান চর্চার অন্বেষণে ) ,  ক্ষিতিমোহন সেনের কাছে তাঁর শৈশবের বিকাশ । যদিও তাঁর পড়াশোনা প্রথম শুরু  হয়  ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে। ডক্টর আশুতোষ সেন , তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক । ঢাকতে তাঁদের বাড়ীর নাম , ‘ জগত কুঠির ‘ । আবার শান্তিনিকেতনে তাঁদের বাড়ীর নাম ‘ প্রতীচী ‘। তাঁর নবেল প্রাইজের অর্থে , বাংলাদেশ ও ভারতের শিক্ষা , স্বাস্থ্য , দারিদ্রতার উপর যে সংস্থা কাজ করছে , তারও নাম ‘ প্রতীচী ট্রাস্ট ‘ । 

অমর্ত্য সেনের মা , আমিতা সেনের ইচ্ছায় স্কুলের মূল পড়াশোনা শুরু হয় গুরুদেবের আশ্রমে । যেখানে প্রকৃতির প্রশান্তির মধ্যে মানুষ একত্রিত হয়েছে , তাঁর কথায়  , ‘ School without walls ‘ । এই আশ্রমের রূপ ও বিকাশ তাঁর জীবনের গড়ে ওঠার অন্যতম উপকরণ । আর তাঁর ভাবনাচিন্তার বিকাশে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব খুবই মজবুত । তা তিনি অনেকবার বলেছেন , বিভিন্ন প্রসঙ্গে । এমন কি নবেল প্রাইজের বক্তব্যেও উল্লেখ করেছেন । 

আশ্রমে রবীন্দ্রনাথ ও ক্ষিতিমোহন সেনের একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল ।  রবীন্দ্রনাথ খুব ভোরে উঠে , আশ্রমে ঘুরে বেড়াতেন ।   ক্ষিতিমোহন সেনের কুঠিরে পৌঁছে যেতেন । একবার  খুব ভোরে রবীন্দ্রনাথ গিয়ে দেখেন ক্ষিতিমোহন সেন তখনও ঘুমিয়ে আছেন । রবীন্দ্রনাথ ডাক দিলেন – 

‘ ঊষাকালে , রবি ( সূর্য ) এলো 

  ক্ষিতির ( পৃথিবী ) দুয়ারে , 

 এখনো কি ক্ষিতি ( ধরিত্রী ) জাগবে না , থাকবে ঘুমিয়ে  ? 

তাঁর শৈশবের এই আশ্রমের যাপিত জীবনে ,তাঁর মনের উপর গভীর প্রভাব ফলেছিলেন তাঁর দাদু  আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন ও দিদিমা । দাদুর কাছেই তাঁর পড়া -জানা- উপলব্ধি —  ভারতীয় সাহিত্য ও জীবন দর্শন । বিশেষ করে মূল সংস্কৃত তে পড়াশোনা করেন কালিদাসের কালজয়ী উপন্যাস গুলো । “ I greatly enjoyed the fact that I could easily move from Kalidasa’s elegant poetry in Meghaduta and Shudraka’s intriguing play Mircchakatika ( among my favorite literary writings ) to the Mathematics and epistemology of Aryabhata…” ( পৃষ্ঠা – ৯৮ ) । 

আশ্রমের পাঠভবনে কর্ম শিক্ষা ও গানের ক্লাস ছিল বাধ্যতামূলক । গানের ক্লাস নিতেন কনিকা বন্দোপাধ্যায় । আশ্রমের ‘ মোহর দি । গানের ক্লাসে অমর্ত্য সেন কে তিনি খবুই বকাবকি করতেন ।  “ My music teacher – a wonderful singer whom we called Mohordi ( her real name was Kanika Bandopadhya) – did not accept that I was simply deficient and initially refused to excuse me from the class . She told me , ‘ Everyone has a talent for singing, it is a matter of practice. “ ( পৃষ্ঠা – ৪৫ )  

 এই সময়ে তাঁকে অনেকটা প্রভাবিত করে গৌতম বুদ্ধের জীবন ও দর্শন । রাজা শুদ্ধোধনের পুত্র সিদ্ধার্থ রাজপ্রসাদ থেকে বেরিয়ে ,  দেখতে পান  একজন বৃদ্ধ মানুষ , একজন অসুস্থ মানুষ , একজন মৃত মানুষ ও একজন সন্ন্যাসীকে । প্রশ্ন জাগে রাজকুমারের মনে । সারথি ‘ ছন্ন ‘ কে জিজ্ঞেস করলে , সারথি বুঝিয়ে যা বলেন , তা হল – এই সব কিছু মানুষের নিয়তি । বৃদ্ধ , অসুস্থ ও পরে মানুষের মৃত্যু । আর সন্ন্যাসী এইসব প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে সংসার-জীবন ত্যাগ করে , মৃত্যুকে জয় করার জন্য বদ্ধপরিকর । তাই একরাতে ঘুমন্ত স্ত্রী পুত্রকে , পরিবারকে নিঃশব্দে বিদায় জানিয়ে রাজপ্রসাদ ত্যাগ করেন , রাজপুত্র সিদ্ধার্থ ।

এই “ পথের শেষ কোথায় , শেষ কোথায় / কি আছে শেষে ? “ ( চণ্ডালিকা , রবীন্দ্রনাথ ) । এই পথই মানুষের চলার গতিপ্রকৃতি । উদ্দেশ্য বিহীন , ক্ষন বিলাসী এবং খাওয়া পরা বেঁচে থাকা , বংশবৃদ্ধির দৈনন্দিন কাজ কর্মের মধ্যে ভেসে যাওয়া জীবনের পথ নয় । জীবনের বাঁকে বাঁকে , বিশেষ করে পরিণত বয়সে  এ-প্রশ্ন মনে আসে বারাবার , অনেকবার  ।  

তাঁর মতে গৌতম বুদ্ধই ধর্ম সম্পর্কে একটা মৌলিক ‘ Paradigm shift ‘ এর কথা বলেছেন । খুবই জোরালো ও দরকারি ঘোষণা । ‘ God ‘ – কি , কেন ও কোথায় … এই সব নিয়ে গৌতম বুদ্ধ খুব বেশী আলোচনা করেন নি ; বরঞ্চ মানুষ হিসাবে আমদের কি করা উচিত – চাল -চলন – গতিবিধির উপর বেশী গুরুত্ব দেন । ‘ Metaphysical view of universe ‘ — নিয়ে সে রকম আলোচনা গৌতম বুদ্ধের  দর্শনে নেই । “ It was Buddha who changed the religious question from ‘ Is there a God ? ‘ to questions such as ‘ How should we behave? No matter whether there is a God or not. This is I believe, immensely significant. “ ( পৃষ্ঠা – ৯৬) ।

 

বাংলার নদী কেন্দ্রিক জীবন জীবিকা – ঘটি ও বাঙ্গাল :

ঢাকা থেকে শান্তিনিকেতনে আসার পরে অমর্ত্য সেনের কথাবার্তায়  বাঙ্গাল টান ছিল – ‘ কইবো বা কইমু ইত্যাদি । তা নিয়ে আশ্রমের বন্ধুরা খুব মজা করতো । পিতা ডক্টর আশুতোষ সেনের দিক থেকে তিনি ঢাকার মানিকগঞ্জের । আবার দাদু ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন সোনারগঞ্জ , বিক্রমপুরের । দুই দিক থেকেই তিনি ‘ বাঙ্গাল ‘ । প্রাচীন বাংলার পূর্বে ‘ বঙ্গ ‘ প্রদেশের লোকজনদের সংগে পশ্চিমের ‘ গৌড়’ প্রদেশের মানুষ জনের মধ্যে ভাষা ও খাদ্য-অভ্যাসে কিছু অমিল ছিল । সেই প্রাচীনকাল থেকেই ‘ বঙ্গ’ প্রদেশের লোকজনদের ‘ বাঙ্গাল ‘ এবং ‘গৌড়’ বঙ্গের মানুষজনরা  ‘ ঘটি’ বলে পরিচিত । প্রেসিডেন্সি র ছাত্রজীবনেও তিনি ছিলেন  ‘ ইস্ট বেঙ্গলের সমর্থক । তাই ১৯৯৯ সালে নোবেল প্রাপ্তির পর ইস্টবেঙ্গল ক্লাব তাঁকে  ‘ আজীবন সদস্য ‘ করে সম্মানিত করে । তাঁর কথায় , “ Undeserved reward “  ( পৃষ্ঠা – ৩১ ) । 

তবে এই ‘ ঘটি’ ও‘ বাঙ্গাল ‘এর লড়াইয়েও একটা অর্থনৈতিক পরিণতি উপলব্ধি করেন । মাছের বাজারে সাপ্লাই চেন —  ‘ ইলিশ’ বা ‘রুই চিংড়ি ‘র বিক্রি । রুজি রোজগার । নদী নালা পুকুর নির্ভর বাংলার অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা । ‘ Adam Smith’ এর ভবনাচিন্তায় যা দেখা যায় – সেই অর্থনীতির  রূপরেখা । নাব্য সমুদ্র গমনের উপযোগী নদ -নদী এবং উদীয়মান মানব সভ্যতা ( পৃষ্ঠা – ৩২ ) । 

রবীন্দ্রনাথের জীবনে ওপার বাংলার বক্সি গঞ্জের  পদ্মার পাড়, নদীর দুই তীরের মানুষ – প্রকৃতি ,  শিলাইদহ , পতিসরের প্রভাব বড্ড বেশী ।   যেখানে বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথকে  খুঁজে পাওয়া যায় এবং প্রকৃতি ও নিসর্গ  অনাবিল সৌন্দর্যের পাশাপাশি ,  শিলাইদহ – পতিসর , শাহজাদপুরের দুঃস্থ মানুষের জীবন গাথাও সমানভাবে উজ্জ্বল । এতে রবীন্দ্র চেতনায় দার্শনিক দিকের  পরিচয় মেলে । তাঁর শিল্প সাহিত্যে বাংলার নদী ও মানুষের  দ্বারা কতটা অনুপ্রানিত হয়েছিলেন  তা  তাঁর কবিতায় , গানে নাটকে  উপন্যাসে প্রবন্ধে  বোঝা যায় । দারিদ্র ঘেরা মানুষের কর্ম ও জীবন স্রোত — তাঁর দর্শনকে কি ভাবে প্রভাবিত করেছে , তা অসম্ভব বাস্তবতায় বর্ণনা করেছেন ।  যার মাধ্যমে অন্য একজন মানুষকে গভীর ভাবে উপলব্দধি করা যায়। মাটি ও মানুষের রবীন্দ্রনাথ , আমাদের রবীন্দ্রনাথ । এখানেই  একজন জীবন নির্মাতার সাহিত্য সাধনার ব্যাপ্তি । সুতারং এটা মানব মনের বিকশে অন্যতম বড় ইনপুট বা উপকরণ ।

এই প্রেক্ষিতে অমর্ত্য সেনের  ‘ সোশ্যাল চয়েস ও কল্যাণমূলক অর্থনীতি ‘ ভবানার বীজ বপন করার সংগে রবীন্দ্রনাথের একটা কোথায় মিল আছে । কি সেই মিল ?

আমাদের ছোট বড় নদীর দুই পাড়ে , ছোট বড় গ্রাম । জনবসতি । নদীর দুকূল ভেসে বন্যা , বন্যার ভয়াবহতা ।  তাদের জীবনযাপন করার সংগ্রাম , উৎপাদিত ফসল , হাটে ( মার্কেটে ) কেনা বেচা । অর্থের আদানপ্রদান । অর্থের ভারসাম্য ও শ্রেণী পার্থক্য । তাঁর কথায় , “ This ambivalent nature of the river is a captivating analog for the struggle for asecure role in society – a society that can both help and decimate the human beings relying on it “ ( পৃষ্ঠা – ২৩ ) । 

তাঁর বয়স তখন মাত্র ন বছর । বাবার সংগে বোটে করে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন । বিস্তীর্ণ দুই পাড় জুড়ে পদ্মা ।  ধলেশ্বরী  থেকে চমৎকার খেয়ালী মেঘনা । শান্তিনিকেতনে আসার জন্য দীর্ঘ  পথের যাত্রা ।  মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকা ; ঢাকা থেকে গোয়ালান্দ ।  স্টিমারে পদ্মা নদীর উপর দিয়ে দীর্ঘ পথের যাত্রা । বাংলা জনজীবনে নদীর প্রভাব বর্ণনা করতে গিয়ে , তিনি হুমায়ুন কবিরের ( সাহিত্যিক ও সেই সময়ের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ) ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত ও সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ নদী ও নারী ‘ র প্রাসঙ্গিকতা উল্লেখ করেন ।  নদীর ধারের মানুষজন  । বাড়ী তৈরি করে । দুকূল ছাপিয়ে যাওয়া বন্যায় সেই  বাড়ী ঘর সবকিছু  ভেসে যায় । আবার তারা নতুন করে বাড়ী তৈরি করা । পলি জমিতে সোনার ফসল ফলায় । ফসল গোলাজাত করে । পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকা । লড়াই , বাঁচার লড়াই । ‘ হাই-স্কুল’ বয়সে পড়া এই উপন্যাস ‘ নদী ও নারী ‘ তাঁকে নাড়া দেয় । 

 

প্রেসিডেন্সির দিনগুলো ও গ্রেড – 2 কান্সার থেকে সেরে ওঠা :

এক  বৃষ্টি ভেজা  শ্রাবন দিনে ( জুলাই , ১৯৫১ )  তিনি প্রেসিডেন্সি তে ভর্তি হন । এই কলকাতা তাঁর প্রথম মহানগর । যেখানে প্রথম একা থাকা , কলেজ জীবনের শুরু । এই শহর কলকাতায় থাকবেন কোথায় ?   ‘ হিন্দু হস্টেলে ‘ থাকা তাঁর পছন্দ নয় । “ I was resistant even to the symbolic aspect of settling myself somewhere – the Hindu Hostel – with a clear communal identification “ ( পৃষ্ঠা – ১৮২ ) । তিনি মেছুয়া বাজারের কাছে  YMCA হস্টেলে থেকে তাঁর কলেজ জীবনের পড়াশোনা  শুরু ।  প্রেসিডেন্সি তে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছেন ভবতোষ দত্ত , তাপস মজুমদার । অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক্স পড়াতেন দীনেশ ভট্টাচার্য । ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকার । বয়সে নবীন তাপস মজুমদার কে ‘ তাপস দা ‘ বলে ডাকতেন । শিক্ষকতার দু টি বিশেষ দিক তাঁকে খুবই প্রভাবিত করে । প্রথমটা  ভবতোষ বাবুর , ‘ How to teach ? । দ্বিতীয় টা ‘ ‘ তাপস দা ‘র ‘ How to question ? । 

সহপাঠী  সুখময় চক্রবর্তী তাঁর বেস্ট ফ্রেন্ড । দুজনের মধ্য  অর্থনীতির নানান বিষয়ের তর্কবিতর্ক চলে । তাঁরা দুজনেই   কলেজ স্ট্রিটের ‘ দাস গুপ্ত ‘র  বইয়ের দোকানে ফ্রীতে বই পড়ার সুযোগ পেতেন । অর্থনীতিবিদ Kenneth Arrow – এর নতুন প্রকাশিত বইগুলো  এই ‘ দাস গুপ্ত ‘ দোকান থেকে নিয়ে , পড়ে নিতেন ।  ফ্রী তে । সেই সময়কার কলেজ স্ট্রিট চত্বরে গভীর আলোচনার বিষয় ছিল – কার্ল মার্ক্স । জোরালো তর্ক বিতর্ক চলত – Marxism , Non Marxist & Anti – Marxist — নানান বিতর্ক সভায় ও কফি হাউসের আড্ডায় । এমন কি YMCA হোস্টেলেও অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনার বিষয় – কার্ল মার্ক্স , অ্যাডাম স্মিথ , অ্যারিস্টটল । যা তাঁকে বামপন্থী রাজনীতির দিকে আকর্ষণ করে । 

সময়টা নভেম্বর , ১৯৫১ । তাঁর ১৮ তম জন্মদিন । নিজেই  বুঝতে পারলেন মুখের ভিতরে  তালুতে একটা -অস্বভাবিক ফুলে ওঠা অংশ । এটা কি কারর্সিনোমা গ্রোথ ?  কলকাতার R.G.KAR Medical College & Hospital  এর OPD তে  বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা দেখলেন । এটা একটা নর্মাল গ্রোথ । চিকিৎসকরা   জানালেন ভয়ের কোন হেতু নেই । কিন্তু নিজের মনেই একটা বড় সংশয় , দ্বিধা । একটা আশঙ্কা অস্থির করছে  তরুণ অমর্ত্য কে । YAMC হোস্টেলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অনেক হবু ডাক্তারবন্ধু  আছে । এক বন্ধুর সংগে পরামর্শ করে , নিজেই কান্সারের উপর বই নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন । এবং  এই সিদ্ধান্তে এলেন যে , মুখের ভিতরে  তালুতে  অস্বভাবিক ফুলে ওঠা অংশ টি , সাধারন গ্রোথ নয় ।  ক্যান্সার হওয়ার সমূহ লক্ষণ আছে । 

১৪ই মে , ১৯৫২ বায়োপসি রিপোর্টে জানা গেল – ‘ Squamous Cell Carcinoma Grade – II ‘ । তারপরেই শুরু হল একরাশ দুঃসহ চিন্তা ।  কলকাতার হাজরা মোড়ে চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হসপিটালে  অপারেশন , রেডিয়েশান এবং চিকিৎসায় সেরে ওঠা । কেননা তিনি তো অমর্ত্য । মানব সভ্যতার ক্যানভাসে নিজেরই জীবনের ছবি আঁকছেন । ‘চলো , জীবন আঁকি ‘র কাজকর্ম থেমে গেল ।  মে থেকে আগস্ট — পড়াশোনা সব বন্ধ ছিল । সেপ্টেম্বর , ১৯৫২ তে ফিরে এলেন প্রেসিডেন্সির  ক্লাশ রুমে ।  প্রেসিডেন্সি পরে , পড়াশোনার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েগেছে । ‘ অমিয়’ কাকার ( অধ্যাপক অমিয় দাসগুপ্ত ) সংগে  আলোচনা করেছেন । ইংল্যান্ডে ইকোনমিক্স নিয়েই পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছা । এবং সেই মতো প্রস্তুতি । কিন্তু প্রথমবারে ট্রিনিটি কলেজ তাঁর আবেদন খারিজ করে দেয় । অনেক পরে আগাস্ট, ১৯৫৩ ,  টেলিগ্রাম পেলেন — “ some of the accepted Indian applications had dropped out and that I could study there after all , if I could make sure to get to Cambridge  by the beginning  of October. “ ( পৃষ্ঠা – ২৪১ ) ।  

দেশের সীমানা টপকে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে হাওড়া থেকে ট্রেনে বোম্বে । বোম্বে থেকে সমুদ্রপথে , জাহাজে করে ইংল্যান্ড । এই দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় তাঁর সহযাত্রী ছিলেন তপন রায়চৌধুরী ও রমিলা থাপার । এবং ভারতীয় মহিলা হকি দল । সেই হকি দলেরই এক তরুণী মহিলার সংগে জাহাজে আলাপ হয় । পড়াশোনার জন্য বিদেশ যাত্রা শুনে মহিলা টি খুব অবাক হয়েছিলেন । এত পড়াশোনার কি আছে ?  তার কাছে পড়াশোনা খুবই কষ্টের বিষয় । হকি অনেক সহজ খেলা , ইত্যাদি ।   অমর্ত্য সেন মজা করে সেই মহিলা বলেছিলেন , ‘ I don’t know how to play hockey ‘ , I said , ‘ so I had to choose education . “ 

 

অর্থনীতি , ইউরোপ ও ডি -স্কুলস অফ ইকোনমিক্স:

তাঁর ঢাকার বন্ধু সাহবুদ্দিনের সহায়তায়  কেমব্রিজে পৌঁছে সাময়িক কিছুদিন ‘ Park Parade’ হোটেলে তাঁকে থাকতে হয় । সাহবুদ্দিন তখন আইন নিয়ে কেমব্রিজে পড়াশোনা করছেন । হোটেলওয়ালি প্রতিদিনই অভিযোগ করেন যে, তাঁর বন্ধু দিনে পাঁচ বার স্নান করে, যা খুবই ব্যয়বহুল ।  বন্ধুটি  হোটেলওয়ালি কে ঠকাই ।  এবং ‘ that a bath cost one shilling “ । অমর্ত্য সেন হোটেলওয়ালি কে বোঝান যে তাঁর বন্ধুটি দিনে পাঁচ বার ‘ নামাজ’ পড়ে । নামাজের আগে , ‘ ওজু ‘ করার জন্য  স্নান ঘরে জলের শব্দ হয় । তা কখনই জল অপচয় নয় ।

ট্রিনিটি কলেজে তাঁর অর্থনীতির মনোদিগন্ত । দিকচক্রবাল । প্রথম দিনেই তাঁর শিক্ষক Piero Sraffa , তাঁকে জানিয়েদেন যে , এই কলেজে অর্থনীতিবিদেরা নিত্য নতুন অর্থনীতির মতবাদ  সৃষ্টি করেন ।  শিক্ষকদের মধ্যে মতের অমিল ছিল প্রচণ্ড । “ They did not agree each other. Dennis Robertson told me that he voted liberal .  Sraffa and Maurice Dobb was very much on left – Dobb was in fact , a member of British Communist Part . “ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে তখন  বামপন্থীদের জোরালো দমকা হাওয়া বইছে । এই সময়ে তাঁর খুব নিকট বন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের মাহাবুব উল হক । যিনি  অমর্ত্য সেন কে   New York – এ ‘Human Development Office ‘এ যোগদান করার জন্য অনুরোধ করেন , “ Amartya , drop everything and come here . We will make sense of the world .”  ( পৃষ্ঠা – ৪০১ )  এই দু জনের কাজের নিরিখে – Human Development Index ।  বিশ্বের চেতনাবোধ সজাগ হয়েছে । হয়েছে কি ? 

অমর্ত্য সেনের রিসার্চ পেপার সারা কেমব্রিজ জুড়ে  ত্মুল আলোচনার বিষয় । তা সেই সাত সমুদ্র তের নদীর টপকে কলকাতা , দিল্লীতেও ঝড় তুলেছে । তাঁর রিসার্চের মূল বিষয় , “ Choice of Capital Intensity in Development Planning “ । তাঁর গবেষণা পত্র Ph-D-এর জন্য অনুমোদনের এক সপ্তাহের মধ্যেই অক্সফোর্ডের ব্লাক ওয়েল পাবলিশিং হাউসের ডিরেক্টর   অমর্ত্য সেনের সংগে দেখা করেন এবং “ give me a fully written – up contract to sign for the publication of my thesis as a book . “ ( পৃষ্ঠা – ৩৩৮ ) । অল্প সময়ের  মধ্যেই ,  এই বইটি খুবই ভালো বিক্রি হয় ।   

 ট্রিনিটি কলেজে রিসার্চ পর্ব শেষ করে MIT – তে , শিক্ষকতা শুরু করেন । ইতিমধ্যে নবনীতা দবের সংগে বিয়ে হয় ( জুন ,১৯৬০ ) । নবনীতার সংগে তাঁর আলাপ হয় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে । সেপ্টেম্বর –  ১৯৬১ ,  অমর্ত্য সেন আবার ফিরে আসেন ট্রিনিটি কলেজে  লেকচারার হিসবে । এই ট্রিনিটি কলেজেই তিনি অর্থনীতির পড়াশোনা ও গবেষণার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন । সেটা হল  জনকল্যাণ অর্থনীতি ও সোশ্যাল চয়েস – “ I was also having my own battle at that time : to be permitted to teach welfare economics and social choice theory . “ ( পৃষ্ঠা -৩৭০ ) । 

মার্চ , ১৯৬৩ তে তিনি দিল্লীর স্কুল অফ ইকনমিক্সে যোগদান করেন । 

 দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপে বিশেষত ইংল্যান্ডে বড় পরিবর্তন হয় NHS – National Health Service । যা ১৯৪৮ সালে শুরু হয় । যদিও ব্রিটিশ ভারতে এই ধরনের কোন সুযোগ সুবিধা ছিল না । ‘ সভ্যতার সংকটে ( Crisis in Civilization ) ‘ রবীন্দ্রনাথ এই দ্বিচারিতামুলক বৈষম্যের কথা উল্লেখ করেন – “ I cannot help contrasting the two system og goverments , one based on co-operation , the other on exploitation , which have made such contrary conditions possible . “ 

( পৃষ্ঠা – ৩৯০ ) ।

নোবেল মিউজিয়ামে তাঁর দেওয়া বিদ্যমান বস্তু :

নোবেল মিউজিয়ামে দু টি উপহার দিয়েছেন । যে দু টি তাঁর ভাবনাচিন্তা ও কাজের সংগে সংশ্লিষ্ট । একটি হল –  তাঁর সাইকেল — শান্তিনিকেতনে তিনি ঘুরে বেড়াতেন । সাঁওতাল পল্লীতে পড়াতে যেতেন ।  দ্বিতীয়টা – “ I gave the Nobel Museum a copy of ‘ Aryabhatia ‘ ( one copy of the great Sanskrit classics on Mathematics from AD 499 ) ।  অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের এই দীর্ঘ  জীবনকথা তে পেয়েছি তাঁর জীবনের মাত্র তিরিশ টা বছরের মূল্যবান সময়ের বিবরণ ও বিশ্লেষণ । তাই আমরা অপেক্ষা করবো ‘ ‘ হোম ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড ‘ – এর  পার্ট -২ , পার্ট -৩ , পার্ট -৪ এবং  আরো অনেক সব মূল্যবান বই । 

“বিনা অনুমতিতে এই ওয়েবসাইটের কোন লেখা কপি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া লেখা কপি করে ফেসবুক কিংবা অন্য কোন প্লাটফর্মে প্রকাশ করেন, এবং সেই লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেন তাহলে সেই ব্যাক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে
ছাইলিপি ম্যাগাজিন।”

সম্পর্কিত বিভাগ

পোস্টটি শেয়ার করুন

Facebook
WhatsApp
Telegram
শূন্যতা

শূন্যতা

রুখসাদ আমীন পার্লি   কতটা একা হলে বুক  শূন্যতায় ফাটে? কতটা যন্ত্রণা পেলে সুখের জন্য হাশফাশ করা লাগে?   কতটা কষ্ট পেলে হাহাকারে বুক ভাসে? ...
কথা

কথা

মহীতোষ গায়েন যদি বলো শুধু কথা বলে কি লাভ হবে? আসলে সব কিছু লাভ দিয়ে বিচার হয় না,তাছাড়া কখন কিভাবে কাকে দিয়ে  কি লাভ হবে ...
একটি নষ্ট গল্প - [পর্ব-০২]

একটি নষ্ট গল্প – [পর্ব-০২]

আশিক মাহমুদ রিয়াদ (গত পর্বের পর থেকে) [১৮+ সতর্কীকরণ] গল্পটির প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন অফিসে ঢোকার সাথে সাথে বসের রুমে ডাক পড়ে তার। ...
বিস্মৃতির আড়ালে

বিস্মৃতির আড়ালে

 সুতপা ব‍্যানার্জী(রায়) তিলোত্তমা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে লেভেল ক্রসিংয়ের খুঁটি ধরে। গাড়ি চলে যেতেও ওর মধ্যে এগোনোর কোন লক্ষণ দেখা গেল না। ওর মনের মধ্যে ...
কবিতা- অজ্ঞাতনামা

কবিতা- অজ্ঞাতনামা

 রীতম দত্ত আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তোমার পানে তোমার চলনে নিজেকে খুঁজে ফিরি তোমার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত পথিক আমি হাজার বছর ধরে পাড়ি দিয়েছি কত গিরি। তোমাকে ...