পুরুষ মাত্রই কামনা করে একজন ‘বনলতা সেন’ , যার কাছে তার ক্লান্ত প্রাণ ‘দু দণ্ড শান্তি’ ভিক্ষা করতে পারে। সব পুরুষেরই কল্পচোখে সেই নারীর অহরহ আনাগোনা ‘ যার চুল ছিল কবেকার অন্ধকার বিদিশার নেশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ‘। হাজার বছর ধরে পুরুষ ‘পাখির নীড়ের মতন’ চোখের সন্ধানে ডুবে থেকেছে যে চোখ শুধু কামনার ঝিলিকই তুলবেনা, ক্লান্ত, শ্রান্ত, ভেঙে পড়া দয়িতদের আশ্রয়েরও আশ্বাস দেবে ; হাল ভাঙা দিশাহীন পুরুষেরা যখন পৃথিবীর শেষ কিনারায় পৌঁছায়, যখন ‘দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে’, পৃথিবীর সব রং মুছে যায় এমনকি ডানার কালো রঙও মুছে ফেলে চিল , ঠিক তখনই ঘরে ফেরার জন্য প্রাণ আকুলি বিকুলি হয়, সব রং ধুয়ে গেলে ঘন অন্ধকারে বসে যে বেঁচে ওঠার গান শোনায়, সেই মানুষটিই কবির ভাষায় ‘ ‘মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
এই বনলতা সেন কে? এই জিজ্ঞাসা কবিতাটি সৃষ্টির পর থেকেই বাংলা সাহিত্যের ঘর-বারান্দা-উঠোন পেরিয়ে দিক চক্রবালে ছড়িয়ে গেছে। ঠিক যেমন লিওনার্দোর ‘মোনালিসা’ , শেক্সপিয়রের ‘ দ্য ডার্ক লেডি ‘ কে নিয়ে মানুষের অসীম আগ্রহ, ঠিক একই রকম অসীম কৌতুহলে পাঠক, গবেষক, সমালোচক খুঁজে ফিরেছে ধরা না ধরা দেওয়ার দূরত্বে দাঁড়ানো এই ধুসর নারীকে। এই চর্চা যখন আম-আদমির কৌতূহল ছাড়িয়ে সাহিত্য ও গবেষণার জগতে ছড়িয়ে পড়ে তখন তথাকথিত বিদগ্ধ আলোচনায় উঠে আসে অনেক তথ্য। সেই তথ্যগুলো সম্যক বিশ্লেষণ করলে ধোঁয়ামাখা এই নারী পাঠকের কাছে আরো বেশি স্বপ্নমাখা আরো বেশি রহস্যময়ী হয়ে ওঠে। কোনো কোনো বিশ্লেষকের চোখে তিনি চরিত্রহীন, আর বনলতা সেন ছিলেন একজন গণিকা, আবার কারো কারো মতে এই কল্পনা নারী কবির মানস জগতে আনা গোনা করতো । বস্তু জগতের কোনো কোনো নারী হয়তো তার কবিতার বনলতা চরিত্রকে মূর্ত করতে সাহায্য করেছে, কিন্তু রক্ত মাংসের কোনো বনলতা সেনের সাথে কবির কোনো সম্পর্ক ছিল এ ব্যাপারে জোরদার প্রমাণের যথেষ্ট অভাব আছে। তবে এই নিয়ে চাপানউতোরে কিছু সত্যি,কিছু কল্পনা, কিছু ঈর্ষা , কিছু বিদ্বেষ আর কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি রয়ে গেছে। কবির বনলতা সেনকে বুঝতে গেলে আমাদের তাদেরই দ্বারস্থ হতে হয়।
জীবনানন্দের ‘ বনলতা সেন’ সম্পর্কে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। জীবদ্দশায় যে মানুষের কবিতা প্রচুর সমালোচিত হয়েছে, মৃত্যুর পরই তাঁর কবিতার বিভিন্ন আঙ্গিক নিবিড় গবেষণার পরতে পরতে খুলে গেছে। সজনী কান্ত দাস ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড় সমালোচক, ১৯৪২ সালে ‘ বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থটি বেরোনোর পরে তিনি বলেছিলেন, ‘ এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল কবিতা লিখতে লিখতে অকস্মাৎ অকারণ এক একজন ভদ্রমহিলার নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক আর উৎসাহিত করে তোলা।’ এছাড়া ‘জীবনানন্দ এবং বনলতা সেন’ সেন সংক্রান্ত গবেষণা এবং লেখালিখিতে তিনজনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
আলি আকবর খান তাঁর ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ের ‘লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি’ প্রবন্ধে বনলতা সেনকে ‘বিনোদবালা’ বলে অভিহিত করেছেন। কর্মসূত্রে তিনি ১৯৬৮-৬৯ নাগাদ নাটোরে গিয়েছিলেন। একটা প্রচলিত গল্প আছে,বাংলাদেশের ঝিনাইদহ জেলার লোকেরা মামলা করতে খুব পছন্দ করে, তারা নাকি বলে, ‘গঞ্জে যখন এসেছি, চাচার নামে কেসটা করেই যাই’। আকবর আলী খানেরও এক অবস্থা হয়েছিল। তিনি সম্ভবত ভেবেছিলেন, নাটোরেই যখন এলাম তখন কবির রহস্যময়ীর একটু সন্ধান করা যাক। মহুকুমা প্রশাসনের ‘উত্তরসূরিদের অবগতির জন্য’ রক্ষিত স্মারক ঘেঁটে তিনি দেখিয়েছিলেন ,নাটোর উত্তরবঙ্গের রূপোপজীবনীদের একটা বড় কেন্দ্র ছিল। তাঁর মতে নাটোরের কাঁচাগোল্লা এবং জমিদারীর বাইরেও নাটোরকে বিখ্যাত করার জন্যে এদের অবদান কম ছিলোনা। এই বারবিলসিনীরাই নাটোরের ও আশপাশের জমিদারদের ‘দু দণ্ড শান্তি’ দিতেন। আকবর আলীর ভাষ্যে কবি এখানেই বনলতা সেনের সাক্ষাৎ পান, এবং আমরা অবগত হই কিভাবে কবি ‘দু দন্ড শান্তি’ পেয়েছিলেন,বুঝতে পারি কেন কবির অভিসার ‘নিশীথের অন্ধকারে’ এবং ‘দূর দূরান্তরে’। আলী আকবরের মতে, তাঁর কবিতায় ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ একটি সৌজন্যমূলক প্রশ্ন ছিলোনা, এটা ছিল বিপর্যস্ত কোনো নারীর অন্তরের আর্তনাদ। যে মুহূর্তে বনলতার পরিচয় মেলে সেই মুহূর্তে কবিতার শেষের দিকের আর্তি ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’ পরিষ্কার হয়ে যায় পাঠকের সামনে। আলিসাহেবের মতে -বনলতাদের সাথে দুদন্ড সময় কাটালেও শেষপর্যন্ত জীবনানন্দদের(বিবাহিত পুরুষদের) লাবণ্যপ্রভাদের ( স্ত্রীদের)কাছে ফিরতেই হয়। সমাজের চোখের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে যেহেতু বনলতাদের সাথে মেলামেশা সম্ভব নয়, তাই কবির কলমে উঠে এসেছে , ” থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”
আলী সাহেবের বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করেছেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক মোঃ আবু তাহের মজুমদার। তাঁর রচিত ‘জীবনানন্দ’ নামক গ্রন্থে তিনি আলী আকবর কৃত গবেষণালব্ধ ফলকে বিরক্তিকর, স্থূল, দূরান্বয়ী এবং নান্দনিক ধ্যানধারণাবিযুক্ত বলে মতামত দেন। তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যায় বনলতা সেন বরিশালের এক ভদ্র পরিবারের মেয়ে। এই মেয়ের বর্ণনা জীবনানন্দের ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে আছে। তিনি ছিলেন জীবনানন্দের প্রতিবেশী। এর উত্তরে আলী আকবর খান নতুন উদ্যমে এবং শানিত কলমে “অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো: নতুন আলোকে বনলতা সেন’ প্রবন্ধে তাহের সাহেবের মন্তব্য গুলি ভুল এবং তাঁর মন্তব্যগুলিই সঠিক এই তত্ত্ব পুরোনো এবং নতুন যুক্তির আঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
আরেক বিদগ্ধ মানুষ এই ব্যাপারে বেশ কিছুটা আলোকপাত করেছেন, তিনি হলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র। তাঁর ‘আপিলা চাপিলা’ গ্রন্থের একটি প্রবন্ধ ছিল ‘বনলতা সেন’। বনলতা সেন কবিতার ৭৫ বছর পূর্তিতে তিনি লিখেছেন, ‘ এক নিভৃত সন্ধ্যায় জীবনানন্দের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বনলতা সেন নামটি কবিতায় ব্যবহারের জন্য তাঁর কী করে মনে এলো; সেই সঙ্গে এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবিতাটির অন্তঃস্থিত অন্ধকারের প্রসঙ্গ তাঁর কি আগে থেকেই ভাবা ছিল, না কি বনলতা সেন নামটি বেছে নেওয়ার পর কবিতাটি নিজের নিয়তি নির্ধারণ করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনো জবাব পাইনি। জীবনানন্দ শুধু জানিয়েছেন, সেই সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় মাঝে মাঝে নিবর্তক আইনে বন্দিরা কে কোন কারাগারে আছেন, বা কোন জেল থেকে কোন জেলে স্থানান্তরিত হলেন, সে সমস্ত খবর বেরোত। হয়ত ১৯৩২ সাল হবে , নয়তো তার পরের বছর , বনলতা সেন নাম্নী এক রাজবন্দি রাজশাহী জেলে আছেন, খবরটা তাঁর চোখে পড়েছিল। রাজশাহী থেকে নাটোর তো এক চিলতে পথ।” শোনা যায় প্রাক স্বাধীনতা যুগে রাজবন্দিনী সেই মহিলা পরে গণিতের অধ্যাপিকা হয়েছিলেন এবং কলকাতার নামকরা এক কলেজে পড়িয়েছিলেন। অবশ্য জানা যায়নি সেই মহিলা এই কবিতার ব্যাপারে আদৌ ওয়াকিবহাল ছিলেন কিনা, আসলে কিছু কিছু রহস্যকে অন্ধকারে ঢেকে রাখার শ্রেয়।
খোদ নাটোরে এই বনলতা সেনকে নিয়ে অনেক গল্পকথা চালু আছে। এরকম এক গল্পে বলা হয় কবির সাথে বনলতার দেখা হয়েছিল ট্রেনে। কবি একবার দার্জিলিং যাচ্ছিলেন, তখন দার্জিলিং যাওয়ার গাড়ি নাটোরের ওপর দিয়ে যেত। নাটোর স্টেশনে জীবনানন্দের কামরায় ওঠে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক আর সঙ্গে এক বিধবা মহিলা। পরিচয় হতে জীবনানন্দ জানতে পারেন ভদ্রলোকের নাম ভুবন সেন, সঙ্গের মহিলা ওনার ভগিনী। ভুবনবাবু কর্মসূত্রে নাটোরের সম্ভ্রান্ত সুকুল পরিবারের ম্যানেজার। ট্রেনের স্বল্প আলাপে ওই ভদ্রমিহিলা কবির কল্পনায় এক গভীর ছাপপ ফেলে, পরবর্তীতে যার প্রতিফলন ঘটেছে এই বিখ্যাত কবিতায়।
আরেকটি প্রবাদ গল্পে বলা হচ্ছে নাটোর বেড়াতে গিয়ে কবি একদা সুকুল পরিবারের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময়ে এক দুপুরে ভুবন সেন নিজ বাড়িতে কবিকে দ্বিপ্রাহরিক আহারে নিমন্ত্রণ করেন। বাড়িতে কবির আতিথেয়তার ভার গ্রহণ করেন বিধবা বনলতা। জীবনানন্দ সেই দুপুরের আনন্দ স্মৃতি নিয়ে দেশে ফেরেন। ওই নারীকে নিয়ে কয়েক মুহূর্তের স্মৃতি মাঝেমাঝেই তাঁকে মেদুর করে তুলতো, তাঁকে চিরস্থায়ী করতেই কবির এই কবিতা রচনা।
আরেকটি গল্পে দেখা যাচ্ছে জীবনানন্দ নাটোরের এক রাজার নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে রাজবাড়িতে উঠেছেন। ওই সময় কয়েকজন মহিলা কবির দেখভাল করতেন, তাঁর মধ্যে কবির মানসীও ছিলেন। কবি সেই মহিলার রূপ ও ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন। সেই মহিলা সম্মত হননি। অবশ্য কবি নাম বদলে লিখলে কোনো আপত্তি নেই এটাও জানাতে ভোলেননা। অনেকের মতে এই নারীই ছিল ‘বনলতা সেন’ কবিতার প্রেরণা। তবে এইসব গল্পের কোনো ভিত্তি নেই, এসব নিছক মানুষের মনগড়া কল্পনা হলেও হতে পারে।
গল্পকথাই হোক বা দীর্ঘ গবেষণার পরিশীলিত ফলই হোক , ‘বনলতা সেন’ যে দীর্ঘদিন ধরে পাঠককুলের হৃদয় হরণ করেছে সেকথা বলাই বাহুল্য। কবিতার ছত্রে ছত্রে যে নিবিড় শিল্পকল্প সৃষ্টি হয়েছে, শব্দ ও বাক্যের জাদুতে পরতে পরতে যে ছবি তিনি এঁকেছেন, সাধারণ মানুষের কাছে তার আর্তি বহুগুণ। কি এসে যায় বনলতা সেন রক্ত মাংসের এক নারী ছিলেন না কবি মানস চোখে তাঁকে কামনা করেছেন সেসব ভাবার, কি প্রয়োজন বনলতা সেন বারবনিতা ছিলেন না ভদ্রঘরের মেয়ে ছিলেন সেই উত্তর খোঁজার! সব সন্ধান তো ফলপ্রসূ হওয়ার দরকার নেই, বরঞ্চ কোনো কোনো সন্ধান কালজয়ী এই কবির গায়ে অকারণ কালির দাগ ছিটোবে, তাতে ‘ বনলতা সেনে’-এর মতো অমর সৃষ্টিকলা ক্লিশে হয়ে যাবে। তাতে ক্ষতি আমার – আপনার মত সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আপামর সাহিত্য প্রেমীদের। একটু ভেবে দেখতে অনুরোধ জানাচ্ছি।
লেখক: অর্থনীতির অধ্যাপক, কলকাতা।
তথ্যঋণ: ইন্টারনেট