এম এস ফরিদ
বাংলাদেশ ঋতু বৈচিত্রের দেশ। ষড় ঋতুর দেশ। এমন দেশটি যেনো ঋতুর আগমনে এক এক রূপ ধারণ করে। বাংলা সনের মাস হিসেবে আষাঢ় শ্রাবণ এই দুই মাস নিয়ে শুরু হয় বর্ষাকাল। কেউ কেউ বর্ষাকালকে বৃষ্টি বাদলের কাল বলেও আখ্যায়িত করে। বর্ষার রূপবৈচিত্র সবাইকে মোহ মুগ্ধ করে তোলে। চারদিকে জলরাশি আর থৈথৈ পানির ফোয়ারা। নদী, সাগর,পুকুর-নালা, পথ-ঘাট ডুবে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। অনেকের যাতায়াতের মাধ্যম হয় ছোট ছোট কোষা নৌকা বা ডিঙি নৌকা। কোনো কোনো দিন রাত বৃষ্টি মুখর থাকে। বৃষ্টির টুপটাপ, রিনিঝিনি, রিমঝিম গান যেনো কানে বেজেই চলে। হঠাৎ আকাশ পরিষ্কার আবার হঠাৎ বৃষ্টি। আর আষাঢ় শ্রাবণ এই দুই মাসের বৈশিষ্ট্যই হলো তা। বর্ষার ঋতুতে ফুলেল তালিকায় রয়েছে- কদম,শাপলা,ঘাসফুল,বকুল,দোঁলনচাঁ পা,স্পাইডার লিলি,সন্ধ্যা মালতি,গুল নার্গিস ও অলকনন্দাসহ প্রভৃতি বাহারি ফুল। তবে বর্ষার ফুল হিসেবে কদম আর শাপলা ফুলই যেনো বেশ পরিচিত। বর্ষার মজার দৃশ্য হলো- নৌকায় চড়ে প্রকৃতি অবলোকন। প্রকৃতির নৈসর্গিক ভালোবাসা পেতে বর্ষায় নৌ ভ্রমণের জুড়ি নেই। চারদিকে সবুজ সমারোহে ঘন গাছগাছালি আর উথলে উঠার জলরাশির জলাঙ্গীর ঢেউ। নদীমাতৃক দেশ যার সেতো হারিয়ে যায় নদীর কিনার ঘেঁষে ঘেঁষে। নদী যে কাছে টানে দূর অজানায় হারিয়ে যেতে। এই সময় কচুরিপানা ভাসে নদী-নালাগুলোতে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় আর জলের ¯্রােতে ভেসে বেড়ায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। ঘন কচুরিপানার উপর বসে থাকা ডাহুক আর সাদা বকের দৃশ্য যেনো মন কেড়ে নেয়। শুক্রবার ছুটির দিন। অমিত ভাবল একটু ঘুরে আসা যাক কোথাও। কিন্তু বর্ষার এই বাদল দিনে কোথায় যাওয়া যায় তাই ভাবছে আনমনে। অমিত কখনো একা ঘুরতে বের হয় না তার বন্ধুদের ছাড়া। ফোন দিলো নিলু আর স্বজনকে। বলল, ঘুরতে বের হবি। চল আজ নৌকা নিয়ে তিতাসের বুকে ভেসে বেড়াবো। যদি যাস্ তাহলে তাড়াতাড়ি সম্মতি দে। নিলু আর স্বজন রাজি হলো। কিন্তু নৌকা পাবে কোথায় এই ভাবনা মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। নিলু খুবই চঞ্চল আর হাসি খুশি মেয়ে। স্বজন ছেলেটাও বেশ মজার। নিলু বলল, আমি তোদের সাথে একা যাবো? অহনাকে ফোন দে সে যাবে কিনা? তাহলে আমিও তোদের সাথে ঘুরতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করব। অমিত অহনাকেও ফোন দিলো। অহনাও ঘুরতে যাবার কথা শুনে রাজি হলো। সবাই প্রস্তুতি নিয়ে বের হলো বাড়ি থেকে। সিএনজি করে গেলো হোমনার লঞ্চঘাটে। সেখানে ছোট বড় ট্রলার ও নৌকা পাওয়া যায়। সিএনজির ভাড়া চুকিয়ে গেলো মাঝিদের সাথে কথা বলতে। অমিত বলল, আজ সারাদিন ঘুরে বেড়াবো তিতাস নদীর বুকে। আমরা নৌকা খুঁজ করছি। একজন মাঝি সাড়া দিয়ে বলল, যাবো। আসেন। অমিত ভাড়া ঠিক করে সবাইকে নৌকায় উঠে পড়তে বলল। দুপুরে খাবারের জন্যে দোকান থেকে শুকনো খাবার কিনে নিলো অমিত। মাঝি নৌকা ছাড়লেন। তিতাসের বুক বেয়ে বেয়ে যেতে লাগলো মাঝি। নিলু মাঝিকে বলল, মাঝি ভাই, লগি ছাড়া পাল তুলে নৌকা চালান । অনেক দিন হয় এই দৃশ্যটা দেখি না। মাঝি বলল, এখনতো তেমন বাতাস নেই আপা। তবে বাতাস চালালেই পাল তুলে দেবো। আজ আকাশটা পরিষ্কার হলেও কেমন যেনো কদমের পাপড়ির মতো সাদাটে হয়ে আছে। বৃষ্টি হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। বৃষ্টি হলেও সমস্যা নেই। নৌকার ছইয়া বা ছাউনি আছে। আসুক বৃষ্টি তাতেও বেশ মজা হবে আজ। মাঝি দেখে হালকা বাতাস বইছে পুব থেকে। তাদের নৌকা যাবে পশ্চিমে কালা পাহাড়িয়ার দিকে। ভাবল এবার পাল তুলে দেয়া যাক। মাঝি পাল তুলে দিলেন। আর হাতে বৈঠা নিলেন গতি ঠিক রাখার জন্য। সবাই চারদিকের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছে আর মুখে নানান রকম গান ধরেছে। স্বজনের কণ্ঠ ভালো। সবাই তাকে অনুরোধ করল গান গাইতে। স্বজন গান গাইল-‘‘ মাঝি বাইয়া যাওরে, অকূল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙা নাওরে, মাঝি বাইয়া যাওরে। স্বজনের গান শুনে সবাই আরো বেশ আনন্দ পেলো। মাঝি তার আপন গতিতে চলল তিতাসের পাড় ধরে। বর্ষার মৌসুমে নদীর দুই পাড়ে জমিনের উপর গলাসম পানি থাকে। আর তাতে শাপলা শালুক থাকে প্রচুর। অহনা খেয়াল করে জমিনের উপর ফুটে থাকা শাপলাগুলোর দিকে। বাংলার জাতীয় ফুল শাপলা যেনো বাংলার কথা বলে। উপরের দিকটা সাদা আর পাতার নিচের অংশটা ঘন সবুজ বর্ণের। এই কারণেই বোধহয় শাপলা জাতীয় ফুল। বাংলার শুভ্রকাশ আর সবুজ মিশে আছে এই ফুলে। সবাই অনুরোধ করল মাঝিকে। শাপলা তুলবে তারা। মাঝি নিয়ে গেলো জমিনের উপর। সেখানে সবাই নিজ হাতে শাপলা ফুল তুললেও শালুক তুলতে পারেনি। কারণ শালুক থাকে পানির নিচে। তাই কেউ সাহস করল না। শাপলা ফুলের ডগা কাচা ও তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। তাই সবাই বেশি করে তুলে নিলো। দুপুরের খাওয়া শেষ করে ফের ঘুরতে লাগলো নদীর বুক চিরে। জলরাশি আর জলের ছোট ছোট ঢেউ যেনো মুগ্ধ করে দিচ্ছে সবাইকে। অহনা মাঝিকে একটা গান গাইতে অনুরোধ করল। মাঝি তার কণ্ঠ ছেড়ে ভাটিয়ালি গান গাইল। সবাই প্রকৃতির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে আর বাংলার জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতার কথাগুলো ভাবছে। নিলু হঠাৎ বলে উঠল, আমি জীবনানন্দের ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতাটি আবৃত্তি করতে চাই। সবাই বলল, করো নিলু। নিলু প্রাণ ভরে আবৃত্তি করল কবিতাটি। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে লাগলো। অমিত মাঝিকে বলল, নৌকা ঘাটের দিকে মুখ করে বাইতে। কারণ বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। মাঝি কথামতো নৌকা ঘুরালো। এবার বাড়ি ফেরার পথে। সবাই গান গাইল, আরো অনেক কবিতা আবৃত্তি করল। ঠিক আসরের আযান দিলো ঘাটে। মাঝির ভাড়া চুকিয়ে বাড়ি ফিরল সবাই। এই আনন্দ যেনো মনে রাখার মতো। আজকের দিনটা তাদের খুব আনন্দে কেটেছে। অমিত ভাবল বাসায় গিয়ে রোজনামচায় এই ভ্রমণ কাহিনীটি লিখে রাখতে হবে। সে তাই করল। যা এই গল্পের আলোচনায় উঠে এসেছে। নদীমাতৃক দেশে নদী কাছে টেনে আনন্দ দেয়। তাইতো নদীমাতাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি দেশকে আর ভালোবাসি এমন ভ্রমণকে।
কুমিল্লা, বাংলাদেশ ।