মানজুলুল হক
আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে শহর পেরিয়ে গ্রামে। মানুষগুলোর ক্ষেত্রেও এর ব্যাতিক্রম নয়। এ যেন এক প্রতিযোগিতা চলছে।
মফস্বল শহরের মেয়ে নীনা। নীনা দেখতে মাশাল্লাহ রূপবতী। সে যে কতটা সুন্দর তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। রাত-বিরেতেও তার বাড়ির সামনে ছেলেরা ঘোরাফেরা করে যদি নীনাকে একবার দেখা যায়।
নীনার ভালো লাগে যখন তাকে কেউ সুন্দর বলে তার প্রশংসা করে। অনেক ছেলে আবার তার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে ফেসবুকের ইনবক্স থেকে শুরু করে ছবির কমেন্টেও বড় বড় কবিতা লিখে ফেলে। আর নীনাও এগুলো খুব উপভোগ করে তাইতো সে প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল-দুপুর-বিকেল এমনকি রাতে ঘুমাতে যাবার আগেও ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে যায়।
নীনা সত্যিকারের রিলেশন কারও সাথে না করলেও অনেক ছেলের সাথেই তার ভাব দেওয়া নেওয়ার একটা সম্পর্ক আছে।
আর নিজেকে আরও সুন্দর প্রমাণ করার জন্য তার কিছু নিয়ম ও মেনে চলতে হয়, এই যেমন কোন ড্রেসে তাকে স্মার্ট দেখাবে, কিভাবে সাজলে ছেলেদের কাছে বেশি আকর্ষণীয় হওয়া যাবে।
এভাবেই চলছিলো তার দিনগুলো ;কিন্তু হঠাৎ একদিন নীনা জানতে পারলো তার নানু মারা গেছে। নীনা দেরি না করেই নানু বাড়ী চলে যায় নানুকে শেষ একবার দেখবে বলে। তবে নীনা নানু বাড়ী যাবার আগেই তার নানুকে মাটি দেওয়া হয়। তাই আর নানুর লাশ দেখতে পায়নি নীনা। নীনা নানুবাড়ী গিয়ে একাকী নানুর কবরের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিরবে কাঁদল। তারপর একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। নীনার বার-বার মনে পড়ছে নানুর সাথে গল্প করার মুহুর্তগুলো। নীনা কথাগুলো ভাবছে আর অঝরে কাঁদছে। নীনার ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ করে গাছ থেকে একটি শুঁকনো পাতা ঝরে নীনার পায়ের কাছে এসে পড়লো। হয়তো জীবন নীনাকে কিছু একটা উপলব্ধি করাতে চায়। নীনা পাতাটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করে দেখলো। তারপর ভাবতে লাগলো, মানুষের জীবনও তো এমনই, এই পাতার মতই। নীনার বার বার মনে পরছে নানুর কিছু কথা। এই যে তার নানু অনেকটা বয়স্ক ছিলো। তার কথা বলার মত তেমন কোন মানুষ ছিলো না শেষ দিকে। নীনাই নানুবাড়ী আসলে নানুকে সঙ্গ দিত,গল্প করতো তার সাথে৷ কিন্তু বাকি সময়ে নীনার নানু একাকী থাকতো। বয়সের সাথে সাথে তার বন্ধুরাও হারিয়ে যায়। একটা সময় সে ভীষণ একা হয়ে যায়। নানুর মুখে নীনা নানুর ছোটবেলার অনেক গল্প শুনেছে। যৌবনকালে তার নানু অনেক সুন্দর ছিলো। এতটা সুন্দর ছিলো যে প্রতিদিনই ১টা,২টো বিয়ের প্রস্তাব আসতো বাড়িতে। সবাই বলে নীনা নাকি হুবহু তার নানুর মতই সুন্দর হয়েছে।
নীনা পাতাটির দিকে তাকিয়ে আরও ভাবতে লাগলো- ‘জীবন তো একসময় ফুড়িয়ে যায়। এই যে এত এত বন্ধু, তারা একসময় আর থাকবে না। যখন চামড়ার ভাঁজ পড়তে শুরু করবে তখন কেউ আর সৌন্দর্যের প্রশংসা করবে না।’
‘গাছের পাতাগুলো যখন সবুজ থেকে হলুদ হয় এবং শুঁকিয়ে যায় তখন গাছের কোন ক্ষমতা নেই তাকে ধরে রাখবার।মানুষেকেও এইভাবেই চলে যেতে হবে মৃত্যুর পরের অনন্ত কালের জীবনের পথে।’
নীনা বুঝতে পেরেছে তার এই সৌন্দর্য খোদার অপরূপ দান। এই সৌন্দর্য সবার জন্য উন্মুক্ত নয়।
মাগরিবের আজান হয়েছে। নীনা নানুর কবরের পাশ থেকে বাড়িতে গিয়ে অযু করে নামাজ পড়লো। তারপর নামাজ শেষ করে নীনা ফেসবুকে ঢুকে তার প্রফাইল থেকে সব ছবি ডিলিট করে দিলো। একটা সময় তার জীবনে অতুলনীয় এক পরিবর্তন চলে এলো। সে পর্দা করা শুরু করলো এবং আস্তে আস্তে সে একটা সুন্দর জীবনের মধ্যে নিজেকে গুছিয়ে নিলো।
ঢাকা,বাংলাদেশ।