জোবায়ের রাজু
নোবেলকে এতটা বছর পর আজ এই বোটানিক্যাল গার্ডেনের বেে কালো চশমা পরে বসে থাকতে দেখে রাগে আর ঘৃণায় জ্বলতে থাকে শায়লা। এই সেই নোবেল, যে শায়লার সাথে প্রতারণা করেছিল। বলেছিল বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে যেন রেলস্টেশনে বসে থাকে। তারপর তারা দুজনে ট্রেনে চড়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে। নানান কেলেংকারির জন্ম দিয়ে অবশেষে দু পরিবার সে বিয়েটা মেনেই নিবে।
তাহলে শুরুর সেই গল্পটা বলা যাক। শায়লা তখন চারুকলার ছাত্রী। ভালোবাসার রং ছড়াতে তার জীবনে হঠাৎ করে নোবেল আসে। সুদর্শন নোবেলকে অপছন্দ করার কিছুই ছিল না। প্রথম ডাকেই সাড়া দেয় শায়লা। দুজনের প্রেম পর্বটা চলতে থাকে সমান গতিতে।
পরিবার থেকে শায়লাকে জানানো হয় তার জন্যে পাত্র পাওয়া গেছে। দিদারই উপযুক্ত পাত্র। আসছে মাসে দিদারের সাথে শায়লার বিয়ে। মায়ের মুখ থেকে এই ঘটনা শুনে বেঁকে বসে শায়লা। কেননা সে তখন নোবেলকে ছাড়া তার জীবনে অন্য কোনো পুরুষকে ভাবতে পারতো না। নোবেলকে ছাড়া তার বেঁচে থাকাই বৃথা।
নোবেল শান্তনা দেয়, ‘চলো পালাই।’ ভরসা পায় শায়লা। কথা ছিল বাইশে আগষ্ট সোনাইমুড়ি রেল স্টেশনে ভোরে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসবে শায়লা। নোবেলও আসবে। তারপর ভোরের ট্রেনে করে দুজনে চলে যাবে শহরে। সেখানকার কোনো এক কাজী অফিসে গিয়ে দুজনে বিয়ে করবে।
সব কিছু ঠিকঠাক ছিল। বাইশে আগষ্ট নির্জন ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে শায়লা সোনাইমুড়ি রেল স্টেশনে অধীর প্রতিক্ষায় বসে থাকে। বার বার নোবেলের পথ পানে চোখ চলে যায়। কিন্তু নোবেল আসে না। প্রতিক্ষার ট্রেন আসছে দেখে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করে শায়লা। কখন আসবে নোবেল! কোথায় সে! এতো দেরি কেন?
কিন্তু বাইশে আগষ্ট নোবেল আর আসে না। চোখের নোনা জলে ট্রেনের চলে যাওয়া দেখে শায়লা। এই ট্রেনের কোনো এক বগিতে নোবেলের পাশে বসে থাকার কথা ছিল তার। অথচ নোবেল আসেনি। স্বার্থপর আর প্রতারক কোথাকার! প্রেমের নামে মিথ্যে নাটক করেনি তো! হ্যাঁ, ওই পাষাণটা তার সাথে নাটকই করেছে। এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে আসে শায়লা।
ধুমধামে দিদারের সাথে বিয়ে হয় শায়লার। বিয়ের পরপরই দিদার শায়লাকে নিয়ে শহরে চলে আসে। ঢাকার মিরপুরের কোনো এক চার তলায় সংসার সাজায় দুজনে। সুখে দুঃখে দিন ভালোই পার হয়। দিদার টেলিভিশনের সংবাদ পাঠক। রাত দুপুরে বাসায় আসে। শায়লা মানুষটার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করে। ঠিক এভাবে নোবেলের জন্যে অস্থির অপেক্ষা সেদিন করেছিল রেলস্টেশনে বসে।
দিদারের সংসারে শায়লার কোনো দুঃখ নেই। কিন্তু রোজ যখন নোবেলকে মনে পড়ে, তখন সে দুঃখ পায়। নোবেল কেন সেদিন স্টেশনে আসেনি! কেন কথা দিয়ে কথা রাখেনি!
শায়লার বাসার পাশেই বোটানিক্যাল গার্ডেন। রোজ বিকেলে এখানে সে একবার হলেও আসে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আজ এখানে এভাবে সেই প্রতারক নোবেলের সাথে দেখা হয়ে যাবে, ভাবেনি। ওই যে নোবেল বসে আছে। কালো চশমার আড়ালে নোবেল কী তাকে দেখছে! নাকি দেখেও এতোটা বছর পর চিনতে পারছে না!
মূর্তির মত ঠায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে নোবেলকে দেখে শায়লা। হঠাৎ তোরো চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ে নোবেলের কাছে এসে কি যেন বলে। কিছুক্ষণ পর নোবেল অন্ধ লোকদের মত হাত নাড়িয়ে আকার ইঙ্গিতে মেয়েটার হাত ধরে দাঁড়ায় এবং মেয়েটার কাঁধে ভর করে চলে যেতে থাকে।
-কি ব্যাপার! নোবেল এভাবে হাঁটছে কেন? ভাবে শায়লা। মেয়েটার খুব কাছে গিয়ে শায়লা বলে
উনি এভাবে তোমার উপর ভর করে হাঁটছে কেন? তোমার কী হয়?
-আমি মিম। উনি আমার নোবেল মামা। উনি চোখে দেখেন না।
-হোয়াট? কিভাবে এমন হলো?
-আম্মুর মুখে শুনেছি ২০০১ সালের বাইশে আগষ্ট খুব ভোরে মামা ব্যাগভর্তি জামা কাপড় নিয়ে বেবিট্যাক্সীতে চড়ে কোথাও যাবার সময় অ্যাক্সিডেন্ট করেন। আঘাতটা দু চোখেই বেশি পেয়েছিলেন বলে চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যান।
-বলো কী? বাইশে আগষ্ট?
-হ্যাঁ। প্রতিমাসে ডাক্তার দেখানোর জন্যে মামাকে ঢাকায় আমাদের বাসায় আনা হয়। আজ আমি মামাকে এখানে জোর করে নিয়ে এসেছি। রাতে ডাক্তার দেখানো হবে। আমরা মিরপুরে থাকি।
-মিমের সাথে শায়লার আলাপচারিতার এক ফাঁকে নোবেল বললÑ‘কার সাথে কথা বলছো মিম? উনি কে? গলাটা বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে।’ শায়লা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখে পানি চলে এসেছে। মনে মনে বলছে ‘আমি যে তোমার পরিচিতই নোবেল। আচ্ছা সেদিন বাইশে আগষ্ট ভোরে তুমি নিশ্চয় আমার কাছে আসছিলে! তাই না?’
-মিম বলল ‘মামা চলো। আমার হোমটিচার আসবেন।’ নোবেল মিমের কাঁধে ভর করে চলে যাচ্ছে। শায়লা তাদের চলে যাওয়া দেখছে। এতটা বছর নোবেলের স্মৃতি তাকে যন্ত্রণা দিয়ে আসছিল। আজ থেকে নতুন আরেকটি নতুন যন্ত্রণার জন্ম হয়েছে। নোবেল সেই বাইশে আগষ্ট স্টেশনে তার কাছে আসতে চেয়েও আ্যক্সিডেন্টের কারণে আসতে পারেনি। না, নোবেল স্বার্থপর নয়। প্রতারকও নয়। সে আজ শুধুই অন্ধ মানুষ।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।