মিরাজুল হক
এই প্রেক্ষিতে ঘটনাটি খুবই উল্লেখযোগ্য । সময়টা ১৯১০ সাল । সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে বি এ পাশ করার পর , কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন এক অব্রাহ্মন ছাত্র । ধর্মে মুসলমান । এই ছাত্রকে বেদ পড়ানো যাবে না । এই নিয়ে তখন প্রচুর বাদ , প্রতিবাদ ও প্ত্রপ্ত্রিকায় লেখালিখি হয় । অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিষয়টি সুরাহ করেন । সেদিনের সেই ছাত্রটি হলেন , ১৮ টি ভাষায় সুপণ্ডিত ভাষাত্বতবিদ ডক্টর মহম্মদ শহীদুল্লাহ ।
ডক্টর মহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একইসঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ এবং ব্যক্তিগত জীবনে নিষ্ঠাবান ধার্মিক । তিনি বলে গেছেন বাঙালী সত্তার কথা । তিনি ছিলেন বাঙালী মুসলমানের বাতিঘর । কিন্তু প্রশ্নটা হল , ‘ বাঙালী মুসলমান কারা ‘ ? সহজ কথায় , এক কথায় , এ ভাবে দেওয়া যায় যে , ‘ যারা বাঙালী এবং একই সংগে মুসলমান — তারাই বাঙালী মুসলমান । সুদূর অতীত থেকে এই বাঙালদেশে প্রচুর মুসলমান ছিলেন । তারা কিন্তু বাঙালী নয় । আর্থিক , সাংস্কৃতিক এবং নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তারা ঠিক বাঙালী ছিলেন না । অথচ আর্থিক , সামাজিক , রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা গুলো তাদের হাতে ছিল । এই উচ্চ বিত্তের মুসলমানদের রুচি , কৃষ্টি মনন বাঙালী মুসলমানদের চিন্তাভাবনা কে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল ।
অন্যদিকে বাঙালী ……। একমাত্রিক পরিচয় । মানুষ কখনই একমাত্রিক বিশিষ্ট নয় । মানুষ সর্বদা নিজেদের বিভিন্ন রূপে দেখতে পায় । যেমন একজন মুসলমান । শুধুমাত্র মুসলমানই নই । এই পরিচয়ে বাঁধা নই । সে বাঙালী – বাংলা ভাষা সাহিত্য ও গান বাজনা বিষয়ে যথেষ্ট গর্বিত । তার একটা রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গী আছে । ধনী – দরিদ্র , উপার্জনের সক্ষমতা – অক্ষমতা , স্বাস্থ্য – অস্বাস্থ্য , শিক্ষিত – অশিক্ষিত , উপকারী – বদমাশ , সামাজিক – অসামাজিক , উদার – সংকীর্ণ মনের ইত্যাদি অনেক বহুমাত্রিক পরিচয় আছে । এই বাঙালির প্রানের কথা হয় বাংলায় । মনের ভাষা বাংলা । প্রান জুড়িয়ে , আনান্দের ভাষা । পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মানচিত্রের সীমানার বাইরে , দেশে বিদেশে ছড়িয়ে আছে বাঙালী । সেই সংখ্যার একটি বড় শতাংশ বাঙালী মুসলমান । তা হিন্দু- বাঙালীর সংখ্যার থেকে অনেক বেশী ।
ইতিহাসের নিরিখে বাঙালী মুসলমান একটি পিছিয়ে পড়া নির্যাতিত মানবগোষ্ঠী । বেশীর ভাগ বাঙলার মুসলমানরা ছিলেন নব দীক্ষিত নিম্ন বর্ণের হিন্দু । আর্থিক সামাজিক শিক্ষার দৃষ্টিতে অনগ্রসর । তাই বেদ উপনিষদ কেন্দ্রিক বিশ্ব দৃষ্টিকোন থেকে নিজেদের কে আলোকিত করার সুযোগ ছিল না । অন্যদিকে ইসলাম যে একটা উন্নত ধারার দিক নির্দেশ , মধ্যপ্র্যাচে ইসলাম ভিত্তিক একটা বিপ্লব ঘটেছে । তার প্রভাব এই অনগ্রসর বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে প্রভাব পড়ে নি । মধ্যপ্র্যাচের দরবেশ সুফিদের একটা গৌণ প্রভাব ছিল উত্তর ভারতের দিল্লী লখনোউ অঞ্চলে । বাঙলাদেশে তার ছিটেফোঁটাও পৌঁছায় নি । বাঙালার শাসকরা ছিলেন বিদেশী । সেই শাসক শ্রেণীর কৃষ্টি ও ভাষাগত দিক থেকে স্থানীয় জনগণের সংগে কোন সম্পর্ক ছিল না ।
বাঙালী মুসলমানদের আরবী ভাষার প্রতি এক ধরনের ভ্রান্ত ভাবাবেগ কাজ করেছিল । তা এখনও করে । পবিত্র কোরানের ভাষা আরবী , হজরত মহম্মদ ( দঃ ) – এর ভাষা আরবী এবং হাদিস অনুযায়ী বেহেস্তের ভাষা আরবী । মূলত এই তিন কারনে ইসলাম ধর্মের প্রসারের সংগে সংগে আরবী ভাষা ও বর্ণমালা মিশর , আফ্রিকার দেশগুলোর মতো বাঙলাদেশেও প্রসারিত হয় । বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে । ইসলামের প্রথম দিকে ইসলাম ও আরবী ভাষা অভিন্ন ছিল । অনেকটা আরবী ভাষা গ্রহণ না করলে প্রকৃত মুসলমান হওয়া যাবে না । আমারা জানি কিছু মুসলমান , বাংলার উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল । উর্দু লেখা হয় আরবি হরফে । তাই কেউ কেউ বলতে থাকে আল্লার কালামের হরফে লেখা বড় পবিত্র ভাষা উর্দু । আরবি হরফে যদি বাংলা লেখা হয় , তবে তাও কি বড়ই পবিত্র হবে ? এই যুক্তির ভিত্তি নেই ।
কোরানের ভাষা আরবি । কিন্তু আল্লাহর ভাষা কেবল আরবি নয় । সকল মানুষের ভাষা আল্লাহর তরফ থেকে পৃথিবীতে এসেছে । সেই সময়ে কোন বাঙালী যদি হযরত মহম্মদের ( দঃ ) কাছে যেতেন , তিনি কি বাংলায় কথা বলতে পারতেন ? ভাষা – ভাব প্রকাশের মাধ্যম । উর্দু ভাষা হিন্দি ভাষার নামান্তর । দেবনাগরী হরফে লেখা হয় । মিশর ও আফ্রিকার দেশগুলোতে আরবী ভাষার যতটা জনগণের গ্রহণযোগ্যতা পয়েছে , ততটা ইরানে বা পারস্য দেশে জনপ্রিয় হয় নি । ইরানীরা অধিক মাত্রায় সংস্কৃতপ্রান জাতি ও জাতীয় বিশিষ্টতা ধরে রাখার ও জাত্যাভিমান বিষয়ে খুবই সচেতন । কোরানের শিক্ষা দর্শন ও বানী কে নিজেদের ভাষায় বিকশিত করার মতো ভাষাগত সহজাত গুন ছিল । ইরানীরা আরবী ভাষা গ্রহণ করে নি । ইরান থেকে শুরু করে আফগানিস্থান হয়ে ভারতে মুসলিম শক্তির জয় যাত্রার সাথে সাথে ভারতে ফার্সি ভাষার প্রবেশ । এমন কি মোগলরা , তাদের মাতৃভাষা তুর্কির পরিবর্তে ফার্সি কে সরকারী ভাষা হিসাবে চালু করেন । অভিজাত শ্রেণীর ভাষা । স্থানীয় মুসলমান জনগণের মধ্যে তা প্রসারিত হয় নি । স্যার সৈয়দ আহামেদের আলীগড় আন্দলনের পর উর্দু ভাষা মুসলমানদের ধর্মীয় লেখালিখিতে প্রভাবিত করে । ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফও সমাজে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে উর্দু ভাষার সুপারিশ করেন । আবুল কাশেম , ফজলুল হক প্রমুখ বাঙলার আধুনিক দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ , তারও বাড়ীতে উর্দু ভাষায় কথা বলতেন । এই প্রেক্ষাপটে বাঙলার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত কৃষিজীবী মুসলমান জনগণের কাছে আরবী অজানা , ফার্সির নাম শুনেছেন , উর্দু ভাষা কানে শুনেছেন মাত্র ।
উচ্চ বর্ণের শাসক মুসলমানদের সংগে বাঙলার নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত কৃষিজীবী মুসলমান জনগণের সংগে মিল কেবল ধর্মের । ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস । অন্য কোন যোগসূত্র গভীর ছিল না । ব্রিটিশ শাসনকালে হিন্দু সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিকশিত হয় । দেশের নানান সামজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে । তাতে মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিত্ব ছিল না । মুসলমান সমাজে তা প্রসার লাভ করে নি ।
উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালী হিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজে ইউরোপীয় ভাবধারা , জ্ঞান বিজ্ঞান , আধুনিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনার যে ঠেউ ওঠে ছিল , তা বাঙালী মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত মুসলমান সমাজকে প্রভাবিত করে নি । সেই সময়ে স্যার সৈয়েদ আহমেদ , সৈয়েদ আমীর আলি প্রমুখ মুসলমানদের জন্য চিন্তা করেছিলেন । কিন্তু তাঁরা নিচুতলার শ্রমজীবী মুসলমানদের জন্য চিন্তাভাবনার অবকাশ পান নি । সাধারন বাঙালী মুসলমান সমাজে মৌলিক চিন্তাভাবনা করার মতো মনিষী জন্মগ্রহণ করেন নি । তার কারন সামাজিক ভাবনাচিন্তার দ্বি বা ত্রি- মুখীনতা ।
কাজী নজরুল ইসলাম , কবি জসিমুদ্দিন প্রমুখ কবি সাহিত্যের ক্ষেত্রে অসাধারন সাফল্য পয়েছিলেন । একটু তলিয়ে দেখলে ধরা পরে উভয়ের সাহিত্য সৃষ্টিতে ভাবনায় আবেগ আছে বেশী । উপরন্তু এই দুই কবির প্রধান পৃষ্ঠপেষক ও গুণগ্রাহী ছিলেন বাঙালী হিন্দু পাঠক সমাজ , মুসলমান সমাজ নয় ।
বাঙালী মুসলমানরা যে দুটি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ও সাড়া দিয়েছিল , তা হল – তিতুমির পরিচালিত ওহাবী আন্দোলন এবং অনটি হাজী দুদু মিয়ার ফরাজি আন্দোলন । সাধারন বাঙালর কৃষক জনগণই ছিল এই আন্দোলনের হোতা । উঁচু শ্রেণীর মুসলমানেরা এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন , তার জোরালো প্রমান নেই ।
“বাঙালী মুসলমানদের মন যে এখন আদিম অবস্থায় , তা বাঙালী হওয়ার জন্য নয় , মুসলমান হওয়ার জন্যও নয় । সুদীর্ঘকাল ব্যাপী একটা ঐতিহাসিক পদ্ধিতির দরুন , তার মনের উপর একটা মায়াজাল বিস্তৃত হয়ে রয়েছে , সজ্ঞানে তার বাইরে আসতে পারে না । তাই এক পা যদি আগিয়ে আসে , তিন পা পিছিয়ে যেতে হয় । মানসিক ভীতি এই সমাজকে চালিয়ে থাকে । “ ( আহমদ ছফা , বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ) ।
বাঙালী মুসলমানরা দীর্ঘ একটা সময় যে বৈষম্যের মধ্য দিয়ে গেছে – রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে । এই সবকিছুই দায়ী ।
নির্দেশ – গ্রন্থ :
১। রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান চিন্তা – শামসুল আলম সাঈদ
২। বাংলার মুসলমানের কথা – কাজী আবদুল ওদুদ
৩। বাঙালী মুসলমানের মন – আহামদ ছফা
৪। হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক – রবীন্দ্র রচনার সংগ্রহ – নিত্যপ্রিয় ঘোষ ।
৫। ভারতে হিন্দু – মুসলমানের যুক্ত সাধনা – ক্ষিতিমোহন সেন ।