কবিতা- নদী-ফকির
এতো যে সর্দি কাসির দোষ, তবু শেষ অবধি জলের ধারার পাশে এসে
একচিলতে ঘর বেঁধে থিতু হলাম, কোনও রোগা নদীটিকে ভালবেসে
দেখলাম তো পাড় ছেড়ে, এলোমেলো গাছের পথ ছেড়ে কত যে লোক
চওড়া রাস্তা চড়ে অট্টালিকায় গিয়ে উঠেছে, কিন্তু আমার পছন্দ ছিল
আমার ভবিতব্য ছিল অথবা কর্মফল,গতি ,পরিণতি ছিল শিয়রে এক নদী।
এগিয়ে না গেলে, সে চাকার আয়ু ফুরিয়েছে মানুষ ধরে নেয়, ফেলে দেয়
গাড়ির গ্যারেজের আশপাশের জঞ্জালে জমে থাকা চাকার স্তূপ দেখেছি
যা বরাবর যন্ত্রণার, যা আয়নার মতো লেগেছে আমার, পিছিয়ে নদীর কাছে
যেতে ভালবাসা এসেছে আমার, স্কুলের দিনের মতো, কৈশোরের মতো
আমাকে যেতেই হতো হয়তো একটা আটপৌরে নদী-জল-পানার মিছিলে।
চিলতে ঘর আমার, তিলমাত্র উঠোন, কোজাগরী চাঁদ যখন নদীর কপালে
সন্ধের টিপ্ দেয়, নদী আমার বারান্দায় বয়ে যায়, শরীর আমার নৌকো হয়ে
বিনি বৈঠায় পাক খায়, নাচে দুঃখের কুশ-পুতুল,হেসে গড়িয়ে যায় জ্যোছনায়
হাজার বছরের গরিব-ঘর অসংখ্য নদী থেকে একটি নদীর চড়ায়, তখনই এই
জীবন আমার পুরোনো এক একতারা, যে তার-টি ছুঁয়ে ছুঁয়ে রাত্রি হলো সারা ।
এখন হিম পড়ে সূর্য ডুবে গেলে, এখন হেমন্তের শুকনো ঘাট অন্ধকার গায়ে
পায়ের শব্দ-স্মৃতি মিলিয়ে নিতে চায়, মধ্য বয়সী মানুষের মতো নির্জলা কাঁদে
নির্জন পাড়ে, ঢালু মাটির বুক কখনও হঠাৎ ভারী পাথরের ভার হয়, মৃদু বাতাস
ছোপ ছোপ ঘাসের ডগায় লেগে ফিরে যায়, আমার একতারাটা এমনিই বাজে
হাত ছোঁয়ানোর বিলম্বের তীব্র অভিমানে, কী ব্যথা গাওয়া হয়নি, সে শুধু জানে।
এক জমিদারির রাখাল ছিলাম, মজুর ছিলাম বন্দরের, মালী ছিলাম বাগানে
নদীর পারে ফুটছে এখন পানাফুল, বর্ষার স্রোত গিয়েছে থেমে, ডিঙি বেয়ে
একটি ঢোঁড়া ডাঙার পথ ধরেছে, এই ঘাটে ওপারের কিছু মাটির মানুষ নামবে
মাঝি লগিতে ঠেলবে কাদা, জেলের জালে ঝুলে থাকবে কিছু সরল সাদা খয়রা
আমি ভাববো এই ভরা বাগান, এই বাণিজ্য নগরের গান,দেখব বাঁকা একটি গাছ।
সব হারিয়ে যায় না, সবটাই বিচ্ছেদের উড়ন্ত ধুলোর মতো ধূসর গন্ধ মেশা না
অনাথের নাথ তার গান, নির্জনে ঘর বেঁধে উঠোনে নদীর যাতায়াতে, ভিজে সুরে
যে গভীর পাওয়া বুকে অপেক্ষা করে, তাকে ফসলের মাঠের মতো দু’হাতে জড়িয়ে
ঘুমিয়ে পড়া, সেই সব কিছু ফিরে পাওয়া, গরিবের শাক-ভাত পেট পুরে খাওয়া সুখ
অনেক অনেক জীবন আরও পরে, শুয়ে থাকব জ্যোছ্না রাতে, এই নদীর বাহুতে ।