সুতপা ব্যানার্জী(রায়)
তিলোত্তমা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে লেভেল ক্রসিংয়ের খুঁটি ধরে। গাড়ি চলে যেতেও ওর মধ্যে এগোনোর কোন লক্ষণ দেখা গেল না। ওর মনের মধ্যে একটা ট্রেন ছুটছে,এখানে এলেই প্রায়ই যেমন ছোটে। অনেক অনেক বছর আগের কথা মনে পড়ে যায়,সেইসাথে ও কী জন্যে বাইরে বেরিয়েছে তা সব ভুলে গিয়ে গুলোনো অবস্থায় থাকে। একবার এইভাবে অন্যমনস্ক হয়ে ও ট্রেনে চেপে কয়েকটা স্টেশন অব্দি চলেও গেছিল,তারপর মায়ের ফোনে হুঁশ ফেরে। এ যেন কেমন নিশি পাওয়া ঘোর এসে যায়।ও বুদ্ধি,বিবেচনা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছে তার ঠিক কী অবস্থা হয়। তবে যত ভেবেছে তত ঐ অবস্থাটা ওকে চেপে ধরেছে। যেমন আজ ওর কাঁধের ব্যাগে ওরই সেলাই করা ব্লাউজ নিয়ে যাচ্ছে ও দোকানে দিতে।কাঁধের ব্যাগ কাঁধেই পড়ে রইল,ও ভাবনায় বিভোর। ঐ তো দেখতে পাচ্ছে, দু বেণী স্কুলের পোশাকে ও যাচ্ছে, পাশে সাইকেল নিয়ে হাঁটছে কে। মুখটা চেনা যাচ্ছে না তবে ওর ভঙ্গিটা খুব চেনা তিলোত্তমার। মনে পড়ছে না কিছু, উ!ওর মাথায় চাপ পড়ছে। ওকি আবার বেহুঁশ হয়ে যাবে,এটা মনে হতেই হাতের কাছের খুঁটিটা শক্ত করে ধরল ও। পাশে ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা হাত ওকে ধরে ফেলল-“আরে তিলুদি,এত শরীর খারাপ নিয়ে বাইরে বেরিয়েছো কেন? চল তোমায় আমি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।” তিলোত্তমা তাকিয়ে দেখল ওর ভাইয়ের বন্ধু তন্ময় দাঁড়িয়ে, বাধ্য হয়ে ওর সঙ্গে ফিরে চলল বাড়িতে। আস্তে আস্তে ও নিজের মধ্যে ফিরে আসছে,কি কারণে আজ ও বাইরে বেরিয়েছিল সব মনে পড়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে তন্ময়কে বিরক্ত করার জন্য বিব্রতও হচ্ছে। কী যে হয় ওর,বাড়িতে ও প্রশ্ন করলে সবাই বলে-“এটা তোর একটা অসুখ,সময়ে ঠিক হয়ে যাবে।” তিলোত্তমার মনে হয়,এ ঠিক হবে না,ওর স্মৃতির কোন একটা জায়গায় ঝুলে আছে যা ওর বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে না। কারুর কাছ থেকেই ও ওর প্রশ্নের উত্তর পায় না কিন্তু সবার মুখ দেখে মনে হয় ওরা ওর অবস্থার কারণ সম্বন্ধে জানে। কদিন সবার নজর সীমায় খানিকটা বিশ্রামে কাটল তিলোত্তমার। যেদিন প্রথম বিছানার থেকে উঠে মায়ের রান্না করা কলমির শাক দিয়ে ভাত খেল সেদিন গায়ে জোর পেয়ে বাইরের দাওয়ায় বসল তিলোত্তমা। স্কুলের পোশাক পরে একদল ছেলেমেয়ে সাইকেল চালিয়ে গল্প করতে করতে যাচ্ছে।ওদের মধ্যে কি কেউ ওকে তিলু বলে ডাকল?পরক্ষণেই মনে হল ওরা তো অনেক ছোট,ওরা ওকে নাম ধরে ডাকতে যাবে কেন।তাহলে কে ওকে তিলু বলে ডাকত,কত দিন আগে?কে কে?মাথা ছিঁড়ে যায় তবু কিছু মনে পড়ে না। ওর এরকম অবস্থা বাড়লে মা ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। সবাই বলে উনি নাকি মানসিক রোগের ডাক্তার, তবে কি ও পাগল?এসব কথা সারাক্ষণ ঘুরপাক খায় তিলোত্তমার মনে।
ও সব সময় ভাবে এই স্মৃতির জটটা যদি খুলে যেত,আবার ভয়ও পায়, সেরকম ভয়ংকর কিছু ওঁৎ পেতে নেই তো ওর অতীতে। আজ একটু শরীরটা ভাল লাগতে তিলোত্তমা আগের দিনের অসমাপ্ত কাজ নিয়ে বেরোল। দোকানে পৌঁছাতে দোকানদার বলল-“অনেক দিন পরে এলে,এখন সবকিছু ভাল তো? যা কষ্টের দিন গেছে তোমার।” তিলোত্তমা ভাবে ঐ দোকানদার কোন্ কষ্টের উল্লেখ করছে যা সে নিজেও জানে না। তিলোত্তমা এখন ডাক্তার শ্রীকান্তের চিকিৎসাধীন। বেশ কয়েকটা সিটিং দেওয়ার পর ডাক্তারের কাছে আড়ষ্ট ভাবটা গেছে।এখন অনেক সহজ হয়ে ও ডাক্তারের সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। অনেকগুলো সিটিংয়ের পর তিলোত্তমার মা’কে ডাক্তার বললেন-“মনে হচ্ছে শীঘ্রই ওর মনের জট খুলে যাবে।” অন্য আর পাঁচটা দিনের মতোই একদিন শুরু হল তিলোত্তমার কাউন্সেলিং।ওর মা ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে বসে আছে। তিলোত্তমা ডাক্তারের সঙ্গে বকবক করছে।হঠাৎ ওর মা সতর্ক হল, এ কী বলছে তিলোত্তমা, এলাকায় পাঁচবছর আগে খুন হওয়া অতুলের নামে। তিলোত্তমা চিৎকার করছে-“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিই মেরেছি অতুলকে।”ডাক্তার নীচু স্বরে বলছেন-“কেন?কেন তুমি এ কাজ করেছিলে?”তিলোত্তমা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল-
“ও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। আমার
সঙ্গে ভালোবাসার নাটক করে তান্নির সঙ্গে একইরকম সম্পর্ক রাখছিল।তখন আমরা ক্লাস ইলেভেনে পড়ি।একদিন টিউশন থেকে ফেরার পথে ওদের হাতেনাতে ধরে আমার মাথা গরম হয়ে গেল।দিলাম ছুঁড়ে একটা আধলা ইট ওদের দিকে। তারপর..তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।”
তিলোত্তমার মা ছুটে এসে মেয়ের মুখ চেপে ধরল-
“এসব কী বলছিস,অতুলকে তুই মারতে পারিস না,চুপ কর..চুপ কর।”ডাক্তারবাবু আশ্বস্ত করলেন-
“ওর মনের কথা ওকে বলতে দিন,নাহলে ও পুরো সুস্থ হবে না। ও আইনের কাছেও আত্মসমর্পণ করবে।তারপর আমি ওর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রমাণ দিয়ে দেখব যাতে ও লঘু শাস্তি পায়।আপনি চিন্তা করবেন না এতেই ও শান্তি পাবে।নইলে ওর অপরাধবোধ সারাজীবন ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে।” তিলোত্তমাকে আইনের হাতে তুলে দিয়ে ডাক্তার শ্রীকান্ত মাথা নীচু করে বসে আছেন। ভেতর থেকে ভেসে এল এক নারী কন্ঠ-“অতুলের বাবা,খাবে এসো।” ডাক্তারবাবুর স্ত্রী বলল-“মেয়েটার মনে চাপা থাকা সব কথা আমি শুনেছি।কিন্তু ও তো ইচ্ছাকৃত খুন করতে চায় নি।যা করেছে রাগের বশে করেছে।”
শ্রীকান্ত মাথা নেড়ে বললেন-“দেখ একটু আগেও আমি জানতাম না এসব কিছু,এসব চিকিৎসারই অঙ্গ।আর এই অতুলই যে আমাদের ছেলে তাও জানি না। তবে ঐ ঘটনার প্রতিঘাতেই মেয়েটার আজকের এই অবস্থা।আজ সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ও ঐ সময়ের স্মৃতি ফিরে পেল। নিশ্চয়ই ও সুবিচার পাবে।”