গৌতম সরকার
উল্টোদিকের রিকশাটা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সওয়ারীর চমকে ওঠা দৃষ্টিটা চোখ এড়ালোনা পৃথ্বীশবাবুর। প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় একটু ঝুঁকে পিছন ফিরে দেখলেন রিকশাটা দাঁড়িয়ে গেছে। বিশুর পিঠে হাত ঠেকাতে তাঁর রিকশাও দাঁড়িয়ে গেল। পৃথ্বীশবাবু যতক্ষণে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়িয়েছেন ততক্ষণে অন্য রিকশাটা পিছিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ধবধবে চেহারার ভদ্রমহিলা, বয়স পঁয়ষট্টির আশপাশে হবে, এককালে অতি সুন্দরী ছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এখন মাথার সব চুল সাদা, সিঁথিতে দীর্ঘকালের চড়া পড়ার দাগ। অপ্রশস্ত কপালের নিচে দুটো উজ্জ্বল চোখ। ওই চোখে এসেই ধাক্কা খেলেন পৃথ্বীশবাবু, কেমন যেন চেনা চেনা, মনে হল কোথায় যেন এই চোখ দেখেছেন! পৃথ্বীশকে কল্পনার জগতে বেশি উড়ততে হল না, সামান্য ইতস্তত করে মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি, তুমি পৃথু না!” এবার পৃথ্বীশবাবুর পা কাঁপতে শুরু করল, বহুদূরের ওপার থেকে কী সংগীত ভেসে আসার মত মুখরা-অন্তরা মিলে মিশে একটা শব্দই কানে ঝংকৃত হতে লাগলো, “রাধিকা! রাধিকা! রাধিকা!”
গত চার দশকে এই মফস্বল শহরের ভোলবদল নিয়ে লিখতে বসলে একটা মহাভারত হয়ে যাবে। কলকাতার পালা চুকিয়ে এখানে যখন ফিরে এল তখন এটাকে গণ্ডগ্রাম বললেও কম বলা হবে। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা বাড়ি, দিনের বেলাতেই আশপাশের জঙ্গল থেকে শিয়াল বেরোত। পৃথ্বীশবাবুর বাবা ছিলেন এখানকার প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, বহু কষ্টে ছেলেমেয়ে মানুষ করে একচিলতে জমির উপর দুটো ঘর খাড়া করতে পেরেছিলেন। তারপর সেই এঁদো, পচা ডোবা, জঙ্গল, সাপখোপে ভরা গ্রামটা খোলস ছাড়তে ছাড়তে এখন একটা আধুনিক শহর হয়ে উঠেছে। এখন এখানে কি নেই? ট্রেন, বাস, সিনেমাহল, শপিং মল, স্কুল, কলেজ, ব্যাঙ্ক, সরকারি অফিস সব মিলিয়ে এক এলাহি কান্ড। কয়েকমাস আগে পশ্চিম পাড়ার দিকে কয়েকশো একর জায়গা নিয়ে একটা বৃদ্ধাবাস তৈরি হয়েছে। নামেই বৃদ্ধাবাস, ভিতরের ব্যবস্থা দেখলে মাথা ঘুরে যাবে। একটা ফাইভ স্টার হোটেলের সব সুযোগসুবিধা দিচ্ছে এই ‘ইটারনিটি ইন’। অতি বিত্তশালী মানুষদের শেষজীবনটা উপভোগ করার এক নয়া সংবিধান নিয়ে হাজির হয়েছে এই অত্যাধুনিক বৃদ্ধাবাস। কানাঘুষোয় শোনা যায় এখানে থাকতে গেলে কোটি টাকার উপরে ডিপোজিট রাখতে হয়, তাছাড়া মাসে মাসে অনেকগুলো টাকা দিতে হয়। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা টু-রুম ফ্ল্যাট বা কটেজ, চব্বিশ ঘন্টা কাজের লোক, সিনেমাহল, জিম, পার্ক, ক্লাব, লাইব্রেরি, বার, সুইমিং পুল, ইন্ডোর-আউটডোর গেম, অ্যানুয়াল ফাংশন, দুর্গাপুজো, এক্সারশন আরও অনেক কিছু মিলে ভরভরন্ত ব্যাপার। এই বৃদ্ধাবাসে ছমাস হল রাধিকা এসেছে। এ কথা শুনে পৃথ্বীশবাবুর মন খারাপ হয়ে গেল, ভাবলেন, ইশ! এতদিন পর দেখা হল! আগেই তো হতে পারত, তাহলে আরও কটাদিন রাধিকাকে বেশি দেখতে পেতেন।
এরকম বৈভব মেশানো লিভিং রুম পৃথ্বীশ আগে কখনও দেখেননি। ভিতরের ইন্টেরিয়র দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। দেওয়ালে স্বপ্ন রঙ মাখিয়ে শোপিসগুলো এমনভাবে ঝোলানো হয়েছে মনে হচ্ছে সেগুলো বাইরে থেকে নয়, দেওয়াল খুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। দুধসাদা কাপে শালিধান রঙের চা খেয়ে ঘরের মুগ্ধতা ছেড়ে দুজনে খোলা আকাশের নিচে এল।
রাধিকা বলল, “এই, এক জায়গায় যাবে?”
“কোথায়?”
“চলনা, গিয়েই দেখবে। আমার বড় প্রিয় জায়গা।“
এই আবাসের টিআরপি হচ্ছে প্রকৃতির সাথে বৈভবের অপূর্ব মেলবন্ধন। সেই মেলবন্ধন এতটাই ঐকান্তিক কোথাও এতটুকু অসামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই যেমন এখন যেখানে তারা এসেছে সেখানে একটা বড় দিঘিকে নদীর চেহারা দেওয়া হয়েছে। নদীতে কয়েকজন মাঝিকে মাহিনা দিয়ে রাখা হয়েছে আবাসিকদের ইচ্ছেমতো খেয়া পারাপার করানোর জন্য। অন্য পারে একটা মন্দির আছে। প্রতি সন্ধ্যায় রাধিকা আরতি দেখতে যায়। আজ সন্ধ্যায় তার সঙ্গী হল পৃথ্বীশ। ফেরার পথে অন্ধকারে জলের বুকে হালের ছপাৎ ছপাৎ শব্দ দুজনকেই ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল চারদশক আগের কোনও এক দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিনটিতে। সেদিনও তারা এরকম এক গ্রামে সারাটাদিন কাটিয়েছিল। রাধিকার সেই প্রথম গ্রাম দেখা, কাশফুল, গ্রামের দুর্গাপুজো, নৌকো চড়ে নদী পারাপার। রাধিকার মনে হল, আজকের এই সফর বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। বয়স হলে শারীরিক কষ্ট ছাড়া সবকিছুই কি বড় সংক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে!
ইদানিং সুমিতার মাথার যন্ত্রণা আবার বেড়েছে। রেগুলার চেকআপের ডেট আসতে আরও একমাস বাকি। মনে হচ্ছে তার আগেই একবার হসপিটালে দেখাতে হবে। মাথার যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারেনা। পৃথ্বীশের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে মুখ বুজে যন্ত্রণা সহ্য করে। প্রথম যখন রোগটা ধরা পড়ল তখন দুজনের মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছিল। আসলে রোগটার নাম শুনলেই ভয়ে যেকোনও মানুষের বুকটা ফাঁকা হয়ে যায়। আজকের পৃথ্বীশ, এই শিরদাঁড়া সোজা করে হেঁটে চলা সত্তর বছরের পৃথ্বীশ, সভ্য-ভদ্র-মধ্যবিত্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত পৃথ্বীশ সবকিছুই ওই ভদ্রমহিলার অক্লান্ত ত্যাগ স্বীকারের ফসল। কলকাতা ফেরত ছেলেটি, জীবনে চূড়ান্তভাবে হেরে যাওয়া ছেলেটি, মৃত্যুর কাছে বারবার ফিরতে চাওয়া ছেলেটি যখন জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়ে বয়স্ক বাবা-মায়ের ঘাড়ে এসে পড়ল, তখন সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ভেবে উঠতে পারলেন না তাঁদের কি করা উচিত! সেই দিনগুলোতে যদি সুমেধা না থাকতো তাহলে শুধু পৃথ্বীশই নয়, তাঁর বাবা-মাকেও অনিশ্চিতের পথে ভেসে যেতে হত। একদিকে পৃথ্বীশকে মানসিকভাবে চাঙ্গা করেছে, জীবনের মূল্য বুঝিয়েছে, সকালের শিশির ভেজা ঘাসের গন্ধ চিনিয়েছে, ঘামে ভেজা গ্রীষ্মের বিকেলে জুঁইফুলের আঘ্রান দিয়েছে, আবার বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দেখাশোনা করেছে। অথচ সুমেধা সাধারণ একটা মেয়ে, এতটাই সাধারণ যে পাশাপাশি বাড়িতে একসাথে বড় হওয়া সত্ত্বেও পৃথ্বীশ সেভাবে কোনওদিন চোখ তুলে তাকায়নি। অবশেষে যখন তাকালো তখন মেয়েটি পৃথ্বীশের চারদিকে সুরক্ষার বেড়ে তাকে জীবন চিনিয়েছে, নতুন করে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। আজ সেই মানুষটাই শুকোতে শুকোতে ছোট্ট হতে হতে বিছানার সাথে মিশে যাচ্ছে। এখন পৃথ্বীশকে ছাড়া তার একমুহূর্ত চলে না।
আজ তারা বসেছে একটা বাঁশের মাচায়। সামনের পুকুরটা জুড়ে পদ্ম আর শালুক ফুল ফুটে আছে। পাশের জমিতে ধানগাছের চারাগুলো হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপছে। এখন নিড়ানির কাজ চলছে। ধানচারার আশপাশে গজিয়ে ওঠা পরগাছাদের উপড়ে ফেলা হচ্ছে, তানাহলে তারাই মাটির সব পুষ্টি খেয়ে নেবে। রাধিকা-পৃথ্বীশ মুগধ চোখে তাকিয়ে আছে। এই রাজবৈভবের মধ্যে একটুকরো পল্লীজীবন এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে মনে হচ্ছে সময়ঘড়ির কাঁধে চড়ে তারা বেশ কয়েক দশক পিছনে ফিরে গেছে। তবে সেই মুগ্ধতার মেয়াদ বেশিক্ষণ থাকলোনা। রাধিকার কণ্ঠে উঠে এল বাস্তব জীবনের গল্প।
অগত্যা এনআরআই ছেলেটির সঙ্গে খুব ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল রাধিকার। এত আড়ম্বর হল, বাজি ফাটলো, সানাই বাজলো, মেয়েটির চোখের জল আর কান্নার আওয়াজ কারোর চোখে বা কানে পৌঁছল না। সেই মানসিক অবস্থাতেও রাধিকা সরসিজকে ভালোবেসে ফেলল। তাদের ভালোবাসার ফসলকে যখন অতি যত্নে নিজের শরীরে একটু একটু করে বড় করে তুলছে তখনই প্লেন দুর্ঘটনায় সরসিজ মারা গেল। মুহূর্তের মধ্যে রাধিকার কয়েক মাসের রঙিন পৃথিবী আবার সাদা-কালো হয়ে গেল। বাবা তখন সদ্য রিটায়ার করেছে, সন্তানের জন্ম পর্যন্ত কলকাতায় বাবামায়ের কাছে ছিল। তারপর দুমাসের ছেলেকে নিয়ে কার্শিয়াংয়ের কাছে একটা স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি নিয়ে চলে গেল। চাকরি করতে করতেই ছেলে বড় হতে লাগল, বাবা-মাও একসময় চলে এলেন। ছেলে কাজের মেয়ে সাংমা আর দাদা-দিদুর কাছে মানুষ হতে লাগল। তিতুমীরের যখন ক্লাস সিক্স তখন ম্যানেজমেন্টের দীর্ঘদিনের অনুরোধ ঠেকাতে না পেরে রাধিকা স্কুলের প্রিন্সিপাল হলেন। তিতুমীর প্রথম থেকেই পড়াশোনায় মনোযোগী ছাত্র। সেও টপাটপ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে জেএনইউ থেকে ইকনোমিক্সে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে মাস্টার্স করতে পাড়ি জমালো লন্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স। ততদিনে বাবা-মা চোখ বুজেছেন। তিতুমীর চলে যাওয়ার পাঁচ বছর পর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে এই বৃদ্ধাশ্রমে আসা। ছেলেকে নিজের উপার্জনে মানুষ করে তুলেছেন, সরসিজের স্বপ্নমতো ছেলেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছেন, বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর দেখলেন বাবামায়ের রেখে যাওয়া আর নিজের সঞ্চয় মিলে তিনি এখন অনেক টাকার মালিক। তিতুমীর সবসময় চায় মা ভালো থাকুক, মায়ের জীবনযুদ্ধ তাকে যেমন গর্বিত করে, তেমন কষ্টও দেয়। সেই ছেলেই ইংল্যান্ডে বসে সমস্ত খবরাখবর যোগাড় করে এই আস্তানার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কর্তৃপক্ষের সাথে এটাও চুক্তি করেছে এই ব্যবস্থা একদমই সাময়িক। পড়াশোনা এবং রিসার্চ শেষ করে যে মুহূর্তে চাকরি করতে শুরু করবে মাকে এখান থেকে নিয়ে চলে যাবে। পৃথ্বীশ এরমধ্যে একটা কথাও বলেনি। শেষ সূর্যের মেটে আলো পড়েছে রাধিকার মুখের এক পাশে। চোখটা খুবই অনুজ্জ্বল দেখাচ্ছে, অথচ একদিন ওর উজ্জ্বল দুচোখের প্রেমে পড়েছিল পৃথ্বীশ। মনখারাপ করা আলোয় পৃথ্বীশের ইচ্ছে করছিল রাধিকাকে একটু নিবিড় করে কাছে টেনে নিতে। মেয়েটি যে তার থেকেও দুর্ভাগা।
ডাক্তারবাবু বললেন, সুমেধা খুব ঠান্ডা লাগিয়ে ফেলেছে। বেশি জল ঘাঁটলে চলবে না। পৃথ্বীশের খুব রাগ হয়ে গেল। এই একটা ব্যাপারেই সে অসুস্থ মানুষটাকে না বকে পারেনা। দুটো কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও একটু সুস্থ বোধ করলেই রান্নাঘরে এবং বাথরুমে জল নিয়ে অকারণে ঘাঁটাঘাঁটি দেখে মেজাজ হারিয়ে চিৎকার করে ফেলে। তারপর রাতের বেলা জানলার ফাঁক গলে একফালি জ্যোৎস্না যখন সুমেধার মুখের ওপর পড়ে তখন পৃথ্বীশের মনটা খারাপ লাগে। মনে হয়, কাকে বকছি! ডাক্তার যার বাঁচার দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেই মানুষটা সবটা জেনেও দৈনন্দিন কাজকর্মে যোগদান দিচ্ছে তার জন্যই তো তাকে স্যালুট জানানো উচিত। সেদিন বাড়ি ফিরে সুমেধাকে রাধিকার সব কথা বলল পৃথ্বীশ। শুনতে শুনতে স্বল্প আলোতেও সুমেধার মুখে আলো-আঁধারের শেডসগুলো খেয়াল করতে পারছিল পৃথ্বীশ। সবটা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুমেধা বলল, “মেয়েটি বড় দুঃখী গো! ওকে একদিন নিয়ে এসো, দেখবো!”
এরমধ্যে বিধানসভা ভোট এসে গেল। অদ্ভুতভাবে বিরোধী দল তাদের ইলেকশন ইস্তাহারে এই ‘ইটারনিটি ইন’-কে নিয়ে একটা বড় ইস্যু করল। তারা জনগণকে বোঝাতে লাগল, নিম্ন-মধ্যবিত্ত তাদের শহরে সবচেয়ে বিসদৃশ হচ্ছে এই বৃদ্ধাবাস। বৃদ্ধাবাসের নামে এখানে মুনাফার নব নব চাষ হচ্ছে। অতি অল্প দামে স্থানীয় সম্পদ ক্রয় করে এরা বিরাট মুনাফা লাভ করে চলেছে, অন্যদিকে এদের সীমাহীন চাহিদায় বাজারে জিনিসপত্রের আকাল দেখা দিচ্ছে। এর ফলে দাম ক্রমাগত উর্ধমুখী হচ্ছে যেটা স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রার খরচ অনেক বাড়িয়ে তুলছে। বর্তমান সরকারের মদতে এই বেআইনি ব্যবসা চলছে। তাদের দাবি সত্ত্বর এই বিলাসবহুল বৃদ্ধাবাস তুলে দিয়ে এখানকার সম্পদ এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে ব্যবহার করা হোক। আশ্বর্য্যের কথা স্থানীয় মিডিয়াও ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিল এবং বেশ কিছুদিন ধরে এলাকার বৃদ্ধাবাসই মূল খবর হয়ে প্রিন্টিং ও ভিস্যুয়াল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়িয়ে বাজার গরম করতে লাগল।
সুমেধাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হল। বাড়িতে আর রাখতে সাহস হলনা। ব্রেন ক্যানসারের মূল সমস্যা হল মাথার উপর একটু চাপ পড়লেই অসুস্থ স্নায়ুকোষগুলো অসহযোগিতা করতে শুরু করে। তখন রোগী মাথার যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে ওঠে। পৃথ্বীশ বোঝে সুমনা তাকে নিয়ে খুব চিন্তা করে। আসলে নিজের অশেষ জীবনী শক্তি দিয়ে যে মানুষটাকে মৃত্যুর ঘাট থেকে জীবনের দ্বারে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল, আজ তারই জীবনীশক্তি শুকিয়ে যেতে বসার কারণে মানুষটিকে পুনরায় জীবনের ভরা মঞ্চ থেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে তার বড়ই কষ্ট হচ্ছে। আসলে সুমেধার যেটা অজানা সেটা হল, ও অসুস্থ হওয়ার পর থেকেই পৃথ্বীশ জীবনের সমস্ত ধরণের গরল পান করে নীলকন্ঠ হয়ে বসে আসে।
‘ইটারনিটি ইন’-এর বাইরে এখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ধর্ণায় বসে। তাদের
‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ স্লোগানের কারণে আবাসিকদের বাইরে বেরোনো বন্ধ। শীত শুরু হয়েছে, বেলা ছোট হয়ে গেছে। পৃথ্বীশের বিকেলবেলাটা আর কাটতে চায় না। রাধিকার সাথে দেখা হওয়ার পর প্রতিটি বিকেলই কেটেছে বৃদ্ধাবাসে। গত পনের দিন রাধিকার সাথে দেখা হয়নি, সুমেধার শরীর খারাপের খবরটাও জানানো হয়নি। শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল, রাধিকা উল-কাঁটা দিয়ে একটা সোয়েটার বুনছিল। কার জন্য বুনছে জিজ্ঞাসা করায় বলেছিল, আগে শেষ হোক তারপর জানতে পারবে।
সকালে ববের ট্রাঙ্ককল এসেছিল। এখানে সব খুব উন্নত হলেও ট্যাঙ্ককলের কোনও এক্সটেনশনের ব্যবস্থা নেই। তাই মেইন অফিসে কল এলে ওরা ইন্টারকমে ডেকে নেয়। বব খুব উত্তেজিত ছিল, গতমাসে লন্ডনের কিংস কলেজে যে ইন্টারভিউটা দিয়েছিল, তাতে ও সিলেক্টেড হয়েছে। সামনের মাসের এক তারিখে ওর জয়েনিং। কলেজ কর্তৃপক্ষ ববকে একটা ফ্ল্যাট দেবে যাতে দুটো বেডরুম, লিভিং, স্টাডি, কিচেন থাকবে। তাই শর্তমতো রাধিকাকে খুব শীঘ্র এখানকার সবকিছু চুকিয়ে ছেলের কাছে ফিরতে হবে। রাধিকা চুপ করে থাকে। বব অধৈর্য হয়ে চিৎকার করে ওঠে, “কি হল মা! তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না?” তড়িঘড়ি নিজেকে সামলে ছেলের সাফল্যে অনেক আশীর্বাদ জানিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলেন, অতি সত্বর এখানকার ব্যাপার মিটিয়ে তিনি লন্ডনে ফিরবেন।
অবশেষে সোয়েটারটা শেষ হল। আজ যেমন করেই হোক সিকিউরিটি অফিসারের অনুমতি নিয়ে একবার বেরোতে হবে। স্নান সেরে অনেকদিন পর আকাশ রঙা একটা ধনেখালি তাঁতের শাড়ি পড়ল। মুখে হালকা পাউডারের প্রসাধন। আজও এই বয়সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে ভালো লাগে। আজ তার খুব তাড়া। সোয়েটারটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল৷
প্রথমদিন রাধিকাও যথেষ্ট ইতস্ততার সাথেই পৃথ্বীশের সঙ্গী হয়েছিল। সুমেধাও কি প্রথমদিন তার আপ্যায়নে সহজ ছিল! রাধিকা বোঝে, কোনও মহিলার পক্ষেই স্বামীর পূর্বতন প্রেমিকার কাছে প্রথম থেকে সহজ-স্বাভাবিক আচরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপর! পৃথ্বীশ আশেপাশে থাকতো না, দুই নারী দিনের পর দিন নিবিড় সাহচর্যে কাটাতে কাটাতে কখন যেন বন্ধু হয়ে উঠল। না, সুমেধার আচরণে কখনও মনে হয়নি সে রাধিকাকে সতীনের চোখে দেখে। এই ভোটের ঝামেলার কারণে দুসপ্তা সে কোনও খোঁজখবর নিতে পারেনি। রিকশায় উঠে রিকশাওয়ালাকে তাড়া লাগালো৷
পৃথ্বীশ-সুমেধার কোনও সন্তান নেই, এটাকে পৃথ্বীশ ঈশ্বরের কৃপা হিসেবেই দেখে। সুমেধার মৃত্যুর পর বিষুবরেখার অন্যপারে কাউকে খবর দিতে হলনা বা মৃতদেহকে ‘পিস হাভেনে’ আটচল্লিশ ঘন্টা রাখতে হলনা ভেবে আরেকবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালো। তবে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল রাধিকাও খবরটা পেল না। এই মুহূর্তে ও পাশে থাকলে পৃথ্বীশ একটু মানসিক জোর পেত। এই সময়ে সুহৃদরা না চাইতেই এসে উপস্থিত হয়। পৃথ্বীশ কিছু ভাবার আগেই ফুল, খাট, গাড়ি, ধুপ, ধুনো, মালা আনুসঙ্গিক সবকিছু যোগাড় হয়ে গেল। সুমেধাকে নিয়ে যাওয়ার সময় যত কাছে আসতে লাগল, পৃথ্বীশ কেমন অস্থির হয়ে উঠল।
বাড়ির সামনে জমায়েত দেখে রিকশার গতি এমনিতেই কমে এসেছিল। মাড় দেওয়া শাড়িতে এই প্রথম গরম টের পেল রাধিকা। বুকের বাঁদিকে একটা চিনচিনে ব্যাথা। রিকশা থেকে নেমেই পৃথ্বীশের সাথে দেখা। একটু সময় চেয়ে নিয়ে আবার ওই এক রিকশাতেই ফেরা। একঘন্টা পর পুরোপুরি বিয়ের কনের বেশে সুমেধাকে গাড়িতে তোলা হল। পরনে রাধিকার ফুলশয্যার বেনারসি আর মাথায় চওড়া করে এই চল্লিশ বছর ধরে জমিয়ে রাখা ঠাকুমার দেওয়া সিঁদুর কৌটোর রাঙা সিঁদুর।
আজ আবার তাদের পথ বিপরীতমুখী। সেজন্য কেউ মনখারাপ করছে না। সময়ের অভিজ্ঞান তাদের শিখিয়েছে দুজনের উৎসমুখ কাছাকাছি হলেও তাদের বহতা সম্পূর্ন উল্টোদিকে। তাই এক ঊষাবেলায় যখন রাধিকার ফ্লাইট আকাশসীমার আশি হাজার কিলোমিটার উপরে উঠে নতুন জীবনের চৌকাঠে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তখন পৃথ্বীশের বিপরীতগামী ট্রেন তাকে এতদিনকার শহর ছাড়তে বাধ্য করল। তবে সুমেধার শেখানো বেঁচে থাকার মূল্যের কথা পৃথ্বীশ ভুলবে না, জীবন তাকে যেখানেই পৌঁছে দিক না কেন, বেঁচে থাকার আনন্দ সে খুঁজে নেবে।
কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।