মোহাম্মদ হোসেন
আসিফ ওকে ক্যাবলার মতন হা করে পরিপূর্ণ নয়নে দর্শন করে আপন হিয়ার মাঝে পুলক জাগিয়েছিল এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়েছিল তার এখানে ওখানে সবখানে। যেমন ছবি শুধু ছবি নয় তেমনি এ তো শুধু মুগ্ধতা নয়, সে বুঝতে পেরেছে তৎক্ষণাৎ, তার চেয়েও বেশিকিছু। এটা যে ভালবাসা। যাকে বলে, প্রথম দর্শনেই প্রেম। লাভ এট ফার্স্ট সাইট। দেখিল, প্রেমের পতিত জমিতে পতিত হইল এবং উদরাধিক বুকসমান সুখ লাভ করিয়া হাঁসের ন্যায় ক্যাঁৎ ক্যাঁৎ করিতে লাগিল। হৃদয়-মন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল পুলকের ঝলকা হাওয়ায়। সেই প্রথম সে বুঝতে পেরেছিল ঠিক ঠিক, সেও হতে পারে এক প্রেমিক, প্রেমিক-কেশরী। তারও একটা মন আছে যে কিনা উদ্দাম সাঁতার কাটতে পারে ভালবাসার নীল দরিয়ায়। সেলিম ফরহাদ মজনু কিংবা রোমিও সেও হতে পারে। এই নবযাত্রায়, জীবন চলার পথে আশ্চর্য বাঁকবদলে সে দারুণ খুশি। তাই মনটা বেশ ফুরফুরে, চাঙ্গা।
ওর যে আগুন-রূপ তা নয়। রূপের ডালিও নয় ও। কিংবা নয় পুরাণোক্ত ভয়ংকর সুন্দরী উর্বশীতুল্য কেউ। নিতান্তই আটপৌরে সুন্দরী কিংবা তার চাইতে সামান্য বেশিকিছু। তবে ওর শ্যামল বরণ মুখে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ভোর বেলাকার আশ্চর্য কোমল ও প্রশান্ত ভাব। হাসিতে ঝরে পড়ে সজীবতায় ভরা পিউলি ফুলের রূপ-রস-রঙ। বনলতা সেনের মতন মায়াবী আঁখিযুগল। হাসলে ওর ভরাট গালে ছোট্ট করে টোল পড়ে। তখন যে রমণীয়তার দেখা মেলে, কান্তিময়তার উদ্ভব হয় তা অপলক নেত্রে চেয়ে দেখার মত। একটা প্রেমিক হৃদয়ে উতলা ভাব উদয় হওয়ার জন্য এগুলোই কি যথেষ্ট নয়? এই রূপ দর্শনে যে এক পুলক জাগে অনুপম, শিহরণ খেলে দুর্দম হৃদয়ের বসন তাতে না খসে পারে? আপন মনে গুণগুণ করে সে গাইবে তখন, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি…..।
ও মানে রুবাবা। পুরো নাম রুবাবা খানম। তো রুবাবা বসেছিল চেয়ারে অপেক্ষাকৃত নির্জন কোণে। দেখলেই বুঝা যায় অন্তর্মুখী স্বভাবের মেয়ে। মাথার কাপড় কপালের উপরিভাগ পর্যন্ত টেনে দেয়া। মুখে কোন মেকাপ নেই। ছোট্ট ভ্যানিটি ব্যাগটা কোলে নিয়ে চুপ করে বসে দেখছে মানুষজনের কোলাহল, বিশেষ করে স্টেজে বসে থাকা বর-কনের কায়কারবার।
কারো গলা খাকারি শুনে পাশে ফিরে তাকায় রুবাবা। দেখে, এক যুবক বসে আছে তার থেকে এক হাত দূরত্বে। একটু সংকুচিত হয় ও। মাথার কাপড়টা আরেকটু ভালভাবে টেনে দেয়।
‘ বসতে পারি?’
‘ বসেই তো গেছেন।’, রুবাবার রসকসহীন কাঠখোট্টা জবাব। একটু যেন বিরক্তির ভাব চোখে-মুখে।
‘ সরি, অনুমতি না নিয়েই আপনার পাশে বসে পড়েছি।’
এই কথার জবাব দেয়ার গরজ বোধ করে না রুবাবা। জানে, কিছু বলা মানে প্রসঙ্গ জোগান দেয়া। তা না করে ও নজর দেয় বর-কনের দিকে। কনের সাথে চোখাচোখি হওয়ায় তার উদ্দেশ্যে হাতও নাড়ে একবার।
এভাবে নীরবতায় কেটে যায় কিছু সময়।
রুবাবা বুঝতে পারছে, যুবকটি উসখুস করছে কিছু বলার জন্য। কিন্তু স্বেচ্ছায় সুযোগ দিতে নারাজ ও।
এদিকে আসিফেরও জেদ চেপে বসেছে। ভাব করার চেষ্টার ত্রæটি করবে না সে। যতক্ষণ শ^াস ততক্ষণ আশ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, ‘ বরের চেয়ে কনে কিছুটা লম্বাই হবে মনে হয়, তাই না?’
কিছু না বুঝার ভাণ করে এদিক ওদিক তাকিয়ে রুবাবা বলল,‘ জ¦ী, আমাকে বলছেন?’
‘ আমার পাশে তো আপনিই বসে আছেন। ভাব বিনিময় তো আপনার সাথেই করব, তাই না?’
‘ কী যা তা বলছেন! আপনার সাথে আমি ভাব বিনিময় করতে যাব কোন দুঃখে?’
‘আহা হা, রাগ করছেন কেন? এটা ওটা না। এ হচ্ছে কথা বিনিময়। এখানে আমারও কেউ নেই একটু কথা বলব, আপনারও কেউ নেই। সময় কাটাতে হবে তো।’
‘ আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, সময় বসে থাকে কারো কথা বলার জন্য! আর সময় কাটাতে আপনার অসুবিধা হলেও আমার কিন্তু হচ্ছে না। আমি একাও নই। আমার বান্ধবীরা আছে, আশেপাশেই আছে। ভালয় ভালয় কেটে পড়–ন। নইলে কিন্তু খবর আছে। আমাকে টিজ করছেন দেখলে কাঠ কাটার মত চিরে ফেলবে আপনাকে। ওরা একেকজন একেকটা করাতের মত মনে রাখবেন।’
‘আমি অসহায় মাসুম বাচ্চা কতকগুলো নাদান বালিকার হাতে নির্যাতিত হব, আর আপনি বসে বসে তাই দেখবেন!’
‘ কেন নয়?’
‘ যাহ্, আপনি তা করতেই পারেন না।’
‘ কেন, আমি কি মানুষ না? ক্রোধের ক্রিয়া বিক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কি আমার মধ্যে হওয়ার কথা না?’
‘ আপনি মানুষ অবশ্যই। নিষ্পাপ সুন্দর চেহারার এক মানবী, রমণীয় রমণী। আর যার মুখ এত মায়াবী, তার মনঝাঁপিতেও বোধ করি লুকিয়ে আছে অনেক মায়া। তো মায়ার ছায়া মাড়িয়ে আপনি নিশ্চয় দূরে সরে যাবেন না আমাকে অহেতুক লাঞ্চিত হতে দেখেও। কারণ আমি তো আপনার কোন ক্ষতি করছি না। এই এখানে এত্তো এত্তো মেয়ের মধ্যে আপনাকে দেখেই আমার ভাল লেগেছে। তাই দুটো কথা বলতে এসেছি আপনার সাথে। এটা কি আমার অপরাধ বলুন?’
মনে মনে ভাবে রুবাবা, লোকটি তো বেশ গুছিয়ে কথা বলতে জানে! আর ওঁর উদ্দেশ্য সৎ বৈ বদ বলেও মনে হচ্ছে না। ওঁকে বিশ^াস করাই যায় বোধ করি।
‘ কিছু বলছেন না যে!’
পলকের জন্য রুবাবা পাশ ফিরে তাকায় আসিফের দিকে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল,‘ আপনার কথায় জাদু আছে। কবিরাই মূলত এরকম হয়। আচ্ছা, আপনি কি কবি?’
আসিফ হেসে জবাব দেয়,‘ আরে না না, যদি চান তো বলুন লেখক।’
‘ তাই!’, নড়েচড়ে বসে রুবাবা,‘ কি লিখেন আপনি?’
‘ প্রতিদিন কত কী লিখি!’
‘ গল্প, উপন্যাস, নাটক নাকি ছড়া- কোনটি লিখেন? নাকি আপনি আব্দুল মান্নান সৈয়দ সাহেবের মত সব্যসাচী লেখক?’, আগ্রহভরে জানতে চায় রুবাবা।
‘ আমার বিদ্যা মেধা সময়Ñসব তো কোম্পানীর কাছে দায়বদ্ধ। ওসব করার সময় কই বলুন। পেটের তাগিদে অফিসের কাজ সারতেই বেলা গড়িয়ে পশ্চিমে হেলে পড়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। রাত হয়। তার উপর এই টার্গেট ওই টার্গেট পারসু করতে করতেই বিপন্ন হয়ে পড়ে মন ও মনন। আর জানেন তো, পরিচালকদের উদর হচ্ছে ভোঁদড়ের পেট। তার সেবা করতেই আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। বোধ ও বোধনের দায় মেটাবার সাধ থাকলেও সাধ্য যে নেই।’, আক্ষেপ ঝরে পড়ে আসিফের কথায়।
একটু যেন হতাশ রুবাবা,‘ আচ্ছা আপনি কি সাহিত্য ভালবাসেন?’
‘তা বাসি বটে। আগে একটু আধটু চর্চাও করতাম। ওটা খরচা হয়ে গেছে জীবন থেকে। সময়ের আকাল যে বড়। অফিস শেষ করে রাতে যখন বাসায় ফিরি, ক্লান্ত থাকে শরীর। শ্রান্ত থাকে মন, অবসাদগ্রস্তও। কোষসমূহ থাকে নিস্তেজ ও নির্জীব পানির অভাবে নেতিয়ে পড়া টবগাছের পাতার মত। জ্যামের ভারে মস্তিষ্ক হয় নাকাল, করে না কাজ। আচ্ছা আপনিই বলুন, এই জটগ্রস্ত মাথা থেকে হাইড্রোজেন বোমা মারলেও কি মহৎ কিছু বেরুবে?’
‘ কেন নয়? আমাদের জাতীয় কবির দিকে তাকান। অভাব ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে তাঁর প্রিয় পুত্র বুলবুল। লাজ-লজ্জার মাথা খেয়ে দশটা টাকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন বন্ধুকে। দেশের চিন্তা, দশের চিন্তা, বৃটিশ সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন। সব মিলিয়ে তাঁর মাথা কি জ্যামমুক্ত ছিল, বলুন? তবুও তো কালজয়ী কত লেখা, গান তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন, অমর হয়ে আছেন।’
‘এই দেখ, কীসের সাথে কী পান্তা ভাতে ঘি। সিঙ্গাপুরের সাথে উজিরপুরের তুলনা করলে কেমন শোনাবে বলুন! কাজী সাহেবের কথা আলাদা। উনার তুলনা উনি। উনার মত প্রতিভার দেখা মেলে কালে-ভদ্রে। আর আমরা হতভাগার দল এসব প্রতিভাকে অতি যতœ সহকারে অযতœ করি, অবহেলার চাদরে মুড়িয়ে দিই, ভাগ্যাহত কর্ণের মর্যাদা দান করি। মরণপূর্ব কিংবা মরণোত্তর যোগ্য সম্মান দেওয়ার ক্ষেত্রে হীনমন্যতায় ভূগি, ছোট মনের পরিচয় দিয়ে নিজেরাই হাস্যস্পদ হই, ছোটত্ব প্রমাণ করি নিজেদের।’
এরকম আরও অনেক কথা হয় আসিফ ও রুবাবার মধ্যে দেশ কাল রাজনীতি ধর্মনীতি অর্থনীতি সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে। এরই ফাঁকে নাম জানাজানি হয়। সেল নাম্বার দেয়া-নেয়া হয়। কোন এক মুহূর্তে রুবাবার দুই বান্ধবী এসে কানে কানে টিপ্পনী কেটে আপন আপন কাজে ফিরে যায়। যখন বিদায় নেয়ার সময় হয়, রুবাবার নাম ও নাম্বার মোবাইলে সেভ করতে করতে আসিফ বলে, মাঝে মাঝে যদি আপনাকে মোবাইলে স্মরণ করি, বিরক্ত হবেন না তো?’
‘ মাঝে মাঝে মানে কখন?’
‘ আমার সুখে কিংবা দুঃখে, হাসি কিংবা কান্নায়, কাজের ফাঁকে, অবসরে- যখনই সময় পাই।’
‘ আরেব্বাস! না না, তা হবে না। হপ্তায় একবার কী দুইবার। এর বেশি কোনভাবেই নট।’
‘এমন করে বলবেন না প্লীজ’,আবেগ কর্তৃক সবেগে তাড়িত হয়ে পড়ে আসিফ,‘এই প্রথম একজন ভাল মনের মানবীর দেখা পেয়েছি যার সাথে মনের মিল-ম্যাচিং হয়। আনন্দ বেদনা শেয়ার করা যায়। রূপ যার ভিতরে বাইরে সমান সুন্দর। এধারে এসে কৃষ্ণচূড়াও হাসবে ¤øান হাসি।’
রূপ-গুণের তারিফ শুনে যেন নড়েচড়ে বসে রুবাবার মন, চাঙ্গা হয়। রাঙ্গা হয় মুখ। দখিনা ঝিরিঝিরি বাতাস এসে আলতো করে ছুঁয়ে যায় ওকে। বৃষ্টির ঝাপটায় সিক্ত হয় মনোদেশের কোমল ভূমি। তারপরও আবেগের উত্তাল ¯্রােতে ভেসে যায় না ও। নিজেকে সংযত রাখে। মন-ঘুড়িকে বেশি উড়তে না দিয়ে বলে,‘ যা বলেছি তাই।’ তারপর বিদায় নেয় আসিফের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে।
আসিফও হাসি দিয়ে বিদায় জানায় রুবাবাকে। আর আপন মনে বলে, কান খাড়া করে শোন জান, তোমাকে আমি স্বস্তিতে নাহি দিব থাকিতে। জালে তুমি আটকা পড়েছ জানি। অতএব নিস্তার নেই তোমার। প্রেমের অশ^াদি-বাহিত ত্রিচক্ররথে তোমাকে আমার পাশে চাই-ই চাই।’
সেদিনের পর থেকে তিন দিন পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে আসিফ রুবাবাকে ফোন করেছে অন্তত সাতবার এবং প্রতিবারই রুবাবা সাড়া দিয়েছে, যদিও অনুযোগও করেছে প্রত্যেকবার। তাতে কী? আসিফ কি কেয়ার করে ওসব? সে যে হাওয়ায় ভাসছে এখন। ষোলআনা দিওয়ানা, যদিও ভালবাসার কথা এখনও বলা হয়নি ওকে। তবুও ভাল লাগে কথা বলতে, ওর মধুর কন্ঠ শুনতে, রিনিঝিনি হাসির শব্দে হারিয়ে যেতে।
আজ ছুটির দিন। অফিস নেই, কাজ নেই, কাজের তাড়াও নেই আসিফের। কাজের মধ্যে আড়াই, খাই শুই আর বেড়াই। এই অবসরে রুবাবার সাথে আলাপনে মেতে উঠার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে সে। যেই ভাবা সেই কাজ। সেলফোনটা হাতে তুলে নেয়। নাম খুঁজে বের করে কল দেয়। রিং হয়। ওপাশ থেকে ভেসে আসে কোকিলকন্ঠ,‘ হু, মনে হচ্ছে, আপনার জ¦ালায় মোবাইলই বন্ধ রাখতে হবে।’
‘ হায়, ওটা করলে যে আমি বাঁচিয়া মরিয়া থাকিব। প্লীজ প্লীজ প্লীজ, তা করবেন না যেন।’
‘ উপায় নেই যে। কারণ আপনার জ¦ালাতন ভয়ংকর ভীষণ।’
‘ জ¦ালাতন যদি বলেন তবে সেটা এক পিঠের ব্যাপার। উল্টোপিঠে কি কিছু নেই? আপনি কি উপযোগ পান না বলুন? সত্যি করে বলবেন কিন্তু।’
‘ ধেৎ, এসব ফালতু উপযোগ।’
‘ তাই, না? ঠিক আছে, এই রাখলাম তবে।’ এই কথা বলেই মোবাইল অফ করে দেয় আসিফ। বালিশের পাশে ওটা রেখে আধশোয়া হয়ে সিলিংয়ে চোখ রাখে সে। ওখানে দুটো টিকটিকি একটা আরেকটাকে ধাওয়া করছে। শেষ পর্যন্ত কী হল জানার আগ্রহ তার নেই। সে বারবার তাকায় মোবাইলের দিকে এবং প্রতিবারই হতাশ হয়। এভাবে এক মিনিট যায়, দুই মিনিট যায়, আধা ঘন্টা, পৌনে এক ঘন্টা, দেড় ঘন্টা…। আহা, রুবাবার কল আর আসে না। মোবাইল সুরে সুরে বেজে উঠে না মধুর ব্যঞ্জনায়। তারও লম্ফ দিয়ে দম বন্ধ করে আকাশ ছোঁয়া হয় না।
এখন একটু একটু করে আফসোস জাগছে মনে। লাইন কেটে দিয়ে সে কি তবে ভুল কাজটি করেছে? হয়তো তাই। কারণ জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতে মানুষ কত ভুলই না করে বসে। নিয়তি যে তার হাতে নেই।
আসিফ এখন টিকটিকি দুটোকে খুঁজে বেড়ায়। না, কোথাও নেই। ধাওয়াকারী সামনেরটিকে ধরতে পেরেছে কিনা কে জানে। সেও কি পারবে তার পছন্দের মানুষটিকে বগলদাবা করতে? নাকি ঘোড়ার ঘাস কাটতে হবে বসে বসে?
সেই থেকে পাঁচ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। রুবাবা একটা কল পর্যন্ত করছে না। ও কি তবে শিলা প্রকৃতির মেয়ে? কিংবা তার মায়াজালে জড়িয়ে যায়নি? তবে কি সে ভূলেছে আশার ছলনে? কথায় যে বলে তাই ঠিক আসলে, কারও মন্দ কেউ করে না, যার মন্দ সেই করে। কী দরকার ছিল মানের ভাণ করে ফোন রেখে দেয়ার? ভালই তো চলছিল।
জ¦ালার মালা বুনন শুরু হয় আসিফের বুকে। প্রথমে তা ছিল এক কোণে। এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বুকে। প্রেমের কী প্রদাহ বা জ¦লুনি, আসিফ তা বুঝতে পারছে হাড়ে হাড়ে। মনে হয় বুকের ভিতর আগুন জ¦ালিয়ে দিয়েছে কেউ। আর সেটা জ¦লছে দাউ দাউ করে। এখন তার মনে পড়ছে গানের কথাগুলোঃ প্রেমের নাম বেদনা, সে কথা বুঝিনি আগে। কিংবা হাসানের ‘এত কষ্ট কেন ভালবাসায়’।
এমন আবেগ বা অনুভূতি বা তীব্র দহনের অভিজ্ঞতা আসিফের জন্য এই প্রথম। সে বুঝতে পারছে না কী করবে। প্রচন্ড অস্থিরতা অনুভব করে ভিতরে ভিতরে। একবার জানালার পাশে দাঁড়ায়। একবার ব্যালকনিতে গিয়ে মনমরা হয়ে বসে থাকে। পরক্ষণেই হয়ত আবার ফুল স্পীডে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে। চোখ ফেটে বোধ হয় কান্নাও বেরিয়ে আসে।
নাহ, আসিফ আর পারে না সইতে। সে মোবাইল তুলে নেয় হাতে। কল করতে যাবে এমন সময় একটা মেসেজ এসে হাজির। চমকে উঠে আসিফ। আর মেসেজ পড়ে তো তার মাথায়ই হাত। রুবাবা লিখেছে, আপনি কি আমার একটা উপকার করে দেবেন? আমার সবচেয়ে কাছের ফেসবুক ফ্রেন্ড, যার সাথে আমি প্রতিদিন চ্যাট করি রাত-বিরাতে, আজ এখানে আসছে দল বেঁধে। ওর সাথে আমার দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু একটা বিশেষ কারণে তা পারছি না। ওর মোবাইলও অফ দেখছি। খুব অস্থির লাগছে আমার। কী যে করব বুঝতে পারছি না। আপনি কি দয়া করে আমার একটা চিঠি ওর কাছে পৌঁছে দেবেন?
মেসেজ পড়ে আসিফের কান্না পায় খুব। সে বুঝতে পারছে, রুবাবা তাকে তো ভালবাসেই না, উল্টো তাকে ডাক হরকরা বানিয়ে অপমান করতে চাইছে। রাগে ক্ষোভে হতাশা আর যন্ত্রণায় মাথার চুল টেনে ছিড়তে ইচ্ছে করছে তার। মোবাইলটা সজোরে ছুঁড়ে মারে বিছানায়। দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে।
হায়! কেন এমন হয়! ভালবাসি যারে সে কেন এমন করে মুখ ফিরিয়ে নেয়! পাঁচে পাঁচে দশের হিসাব কেন মিলে যায় না! ভেবে কূল পায় না আসিফ। নতুন করে ভাবতে বসে, কি দিয়া সুন্দরী মোরে করিল পাগর? ভেবে দেখে, বিশেষত্ব তেমন নেই। নাথিং স্পেশাল। তখনই কড়া সিদ্ধান্ত নেয় সে, ওর চিঠির বাহক তো হবেই না, কোন সম্পর্কও রাখবে না ওর সাথে। আজ থেকে দুই উল্টো দিকে দুজনার পথ। তোমার ভাল তুমি দেখ, আমার ভাল আমি। গুডবাই, মনে মনে বলে আসিফ।
তারপর মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়। সময় বয়ে যায় আপন গতিতে। কিন্তু আসিফের জ¦ালার কোন ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটে না। কমে আসে না মনের অস্থিরতাও। এরূপ অবস্থাতেই সে ভাবে, আমি যারে ভালবাসি তার যাতে ভাল হয় সেই চেষ্টাই তো আমার করা উচিত। হ্যাঁ, ওর চিঠি আমি পৌঁছে দেব ওর বন্ধুর কাছে। এতে নিশ্চয়ই ওর কোন কল্যাণ নিহিত আছে।
তখনই আসিফ এসএমএস পাঠায়, চিঠি দাও, পৌঁছে দেব।
দুই মিনিটের মাথায় কল এসে হাজির। মোবাইল হাতে নিয়ে রিসিভ বাটন চাপে আসিফ, কিন্তু উচ্ছ¡সিত হয় না। খুশির তোড়ে খুব জোরে ভেসে যায় না। উদোম গায়ে উদ্দাম নৃত্য করতে করতে বলে না, হ্যালো।
‘ আপনি তো দেখি আচ্ছা লোক! বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ তুমি বলা শুরু করে দিয়েছেন!’
‘ সরি, কী বলবেন বলুন।’
‘ আপনার গলা পরপর ঠেকছে কেন? কী ব্যাপার বলুন তো। আপন ভাবটা গেল কোথায়?’
‘ পর হয়ে গেলে তো আপনকেও পর মনে হয়, তাই না?’
‘ না না, ব্যাপার ঠিক ভাল ঠেকছে না। মনে হয়, ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। আচ্ছা বলুন তো, আমার এসএমএসের জবাব দিতে এত দীর্ঘ সময় লাগল কেন আপনার?’
‘ প্লীজ আসল কথা বলুন।’ বিরক্ত হয়ে বলল আসিফ।
‘ বলব?’
‘ হ্যাঁ বলুন।’
‘ সইতে পারবেন তো?’
‘ আজব কথা! সইতে না পারার কী আছে এখানে!’
‘ চিঠি নয়, আপনি স্বয়ং আমাকে নিয়ে যাবেন আমার বন্ধুর কাছে।’, তারপর একটু থেমে সুরে সুরে বলে,‘ আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা, আমি যে পথ চিনি না। হি হি।’
‘ডাকপিয়ন বানাতে চেয়ে একবার আমাকে অপমান করেছেন। এখন আবার করছেন। কী, পেয়েছেনটা কী, এ্যাঁ?’, বেজায় ক্ষুব্ধ আসিফ।
‘এখনও কিছু পাইনি।’, শান্ত ও রোমান্টিক গলায় জবাব দেয় রুবাবা,‘ তবে যেদিন আপনি আবেগের মই বেয়ে তুমি বলে আমাকে প্রাণের সই করে নেবেন, আমার হাত ধরে জোলো হাওয়ায় ভেসে দূর পাহাড়ের দেশে কিংবা ম্যাপল পাতার ছায়াতলে নিয়ে যাবেন, কৃষ্ণচূড়ার রঙে রাঙ্গিয়ে দেবেন, বরষার প্রথম দিনে বৃষ্টিসিক্ত কদম ফুল খোপায় গুঁজে দিয়ে প্রেমের কথা বলবেন সেদিনই মনে হয় কিছু একটা পাব।’
এা্যঁ, এ কী শুনছে আসিফ! নিজের কানকেই যে বিশ^াস হচ্ছে না তার। সে জেগে আছে তো, না স্বপ্ন দেখছে? নাকি গুল মারছে রুবাবা, তাকে বোকা বানাতে চাইছে?‘ আপনি সত্যি বলছেন?’
‘না, মিথ্যে বলছি, উজবুক কোথাকার। জানি, আপনার মত জোলাকে নিয়ে পথ চলতে আমার কষ্ট হবে তোলা তোলা। তবু কী আর করা? অদৃষ্ট বলে কথা। কপালের লিখন না যায় মুছন।’
‘ উ-উ-উ, খুশিতে আমার নাচতে ইচ্ছে করছে। আমি পাগল হয়ে যাব জান। তোমায় সঙ্গে নিয়ে আমি ছোঁব দূর আকাশের মেঘ, ডিঙ্গি নায়ে চড়ে বেড়াব, সর্ষে ক্ষেতের আল ধরে ছুটতে ছুটতে হারিয়ে যাব দূর অজানায়।’
‘ আহ মরণ, মরদের মর্দামি জেগেছে দেখছি। আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচিনে।’
‘ যাই বল, ওসব আর কানে তুলছি না। আমি আসছি রুবাবা, আমি আসছি। তুমি তৈরী হয়ে থেকো।’
‘একটা পাগল বুদ্ধু।’ ভালবাসার রং মিশিয়ে স্বগোক্তি করে রুবাবা। পরক্ষণেই আশংকা জাগে মনে, সেলিম মোল্লা যদি এ সম্পর্কে অবগত হয় তবে ওর কিংবা ওঁর কোন বিপদ হবে নাতো! মোল্লা লোকটি যে বিশেষ সুবিধের নয়। দলবল নিয়ে চলাফেরা করে। পালের গোদা। রাজনীতিও করে। তার রাজনৈতিক গুরুর দীক্ষা হচ্ছে, যুক্তির শেষ শক্তি ও কটুক্তি। মোল্লা এখন একথা বিশ^াস করে মনেপ্রাণে। ষোলয়ানা থেকে এক আনাও কম নয় এমন দিওয়ানা সে রুবাবার প্রেমে। হন্যে হয়ে আছে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে ওকে ধন্য করবে কিংবা নিজে ধন্য হবে বলে। এখন কী হবে জানে না রুবাবা। শুধু জানে, জটিল নয় কুটিল নয়, শত প্যাঁচ খাওয়া লতাপাতা নয়, একজন সহজ সরল ভাল মানুষের দেখা পেয়েছে ও। অনেক পূণ্য করলেই বোধ করি এমন একজন সঙ্গীর দেখা মেলে জীবনে। রুবাবা বিশ^াস করে দৃঢ়ভাবে, জীবনের কঠিন বেড়াপাকে সহজতায় স্বস্তি আসে, সরলতায় মুক্তি।
‘ও আমার বুড়বক গো।’ সুখের আতিশয্যে ভালবাসার উষ্ণতায় রুবাবার একেবারে ভিতর থেকে কথাগুলো উঠে আসে জলবিম্বের মত। শান বাধানো ঘাটে পুষ্করিণীর জলে দুই পা ডুবিয়ে হাসে পরিতৃপ্তির হাসি। ওর এই হাসিই যেন ছোট ছোট ঢেউ খেলে ছড়িয়ে পড়ে সারা পুকুরময়। এসময় একটা কাঠালিচাঁপা টুপ করে ঝরে পড়ে ওর ঘন কালো চুলে। ওটা হাতে নিয়ে আলতো চেপে ধরে নাকে, আর বিভোর হয়ে থাকে ম ম করা ঘ্রাণে। শেষ বিকেলের আলতো হাওয়া কোমল পরশ বুলিয়ে যায় ওর চোখে-মুখে। প্রকৃতির এহেন সংলগ্নতায় আর প্রেমের সংসর্গতায় চোখের পাতা এক করে ও হারিয়ে যায় ভাললাগার অজানা ভূবনে। সেখানে আসিফ ওকে স্বাগত জানায় লাস্যময় হাস্যমুখে। কেমন বোকা বোকা পাগলপারা হাসি!
সিনিয়র অফিসার,
প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড.
বাঁশখালী শাখা, চট্টগ্রাম।